ঢ্যাঁড়শ চাষ : লাভজনক ব্যবসা

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঢ্যাঁড়শ মালভেসি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এক প্রকারের জনপ্রিয় সবজি। সারা বছর এই সবজি ব্যাপকভাবে চাষ করা হয়। ঢ্যাঁড়শ লেডিস ফিংগার নামেও পরিচিত। ঢ্যাঁড়শ সাধারণত সবজি হিসাবে বহুল প্রচলিত। পরিণত কাণ্ড বা ডাঁটা থেকে তন্তু বের করা যায়। ঢ্যাঁড়শ টাটকা সবজি হিসাবে দেশের বাইরে রপ্তানি করে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন সম্ভব।

খাদ্যগুণ : প্রতি ১০০ গ্রাম ঢ্যাঁড়শের মধ্যে ৬.৪ গ্রাম শর্করাজাতীয় পদার্থ, ১.৯ গ্রাম প্রোটিন, ১.২ গ্রাম খাদ্য তালিকাগত তন্তু-ফাইবার, ০.২ গ্রাম উদ্ভিজ্জ তৈল এবং ০.৭ গ্রাম খনিজ পদার্থ বর্তমান। এই সবজিতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন (এ,সি,কে,বি) এবং মৌলিক পদার্থ (সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, দস্তা, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গনিজ) ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে থাকে।

ঔষধিগুণ : ঢ্যাঁড়শে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি থাকায় মানব শরীরে নতুন কোশ উৎপাদন এবং বজায় রাখতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি ভ্রূণের বৃদ্ধি, শিশুর সুষ্ঠু গঠন, মানব শরীরে ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়াতে, দাঁত ও মাড়ির রক্ষণাবেক্ষণে উপকারী। মানব শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে, রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে এবং বহুমূত্র রোগীদের পক্ষে অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য। এই সবজিতে সোডিয়াম পরিমাণে কম থাকায় হার্ট এবং বৃক্কের রোগীর পক্ষে উপকারী। চোখের দৃষ্টিশক্তি, কোষ্ঠকাঠিন্য, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা যেমন হাঁপানি, কাশি বা শ্বাসপ্রশ্বাসে কষ্ট, পাচনশক্তি বাড়াতে এবং কোলন ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মাতে সাহায্য করে।

মাটি ও জলবায়ু : ঢ্যাঁড়শ সাধারণত সব ধরনের মাটিতে চাষ করা যায়। তবে বেলে-দোআঁশ বা কাদা দোআঁশ মাটিতে উৎপাদন ভালো হয়। এই সবজি চাষের জন্য মাটির পি এইচ ৬.০-৬.৮ হওয়া উচিত। উৎপাদন ভালো হওয়ার জন্য মাটিতে জৈবিক পদার্থের সঠিক মাত্রা থাকা উচিত। উষ্ণ বা আর্দ্র তাপমাত্রাযুক্ত অঞ্চলে এ সবজির উৎপাদন ভালো হয়। আমাদের দেশে সাধারণত গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে এই সবজির চাষ করা হয়। সবজি চাষের সময় তুষারপাত হলে উৎপাদন কমে যায়। এই ফসল চাষের জন্য ২২-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ২৫০০-৩০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের প্রয়োজন। কিন্তু তাপমাত্রা কুড়ি ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে বীজের অঙ্কুরোদগমের হার কমে যায়। বীজ অঙ্কুরোদগমের জন্য ২৮-৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায়ও এই সবজির চাষ করা যায়।

জমি প্রস্তুতি ও সার প্রয়োগ : উচ্চ ফলনের জন্য সঠিকভাবে জমি প্রস্তুতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুশীলন। জমিতে ভালোভাবে পাঁচ থেকে ছয়বার লাঙল দিয়ে অথবা পাওয়ার টিলার দিয়ে দুই থেকে তিনবার আঁড়াআঁড়িভাবে চাষ দিতে হবে যেন কুড়ি থেকে পঁচিশ সেন্টিমিটার গভীর পর্যন্ত মাটি ঝুরঝুরে হয়ে যায়। জৈবিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য জমি কর্ষণের সময় কুড়ি থেকে পঁচিশ টন জৈব সার বা গোবর সার হেক্টর প্রতি জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। এরপর মই দিয়ে জমির উপরিতল সমান করে দিতে হবে। পানি নিষ্কাশনের নালাগুলো সুবন্দোবস্ত রাখা উচিত। রাসায়নিক পদ্ধতিতে চাষের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ইউরিয়া অ্যামোনিয়াম ফসফটে, মিউরেট অফ পটাশ হিসাবে নিম্নলিখিত অনুপাতে হেক্টর প্রতি প্রয়োগ করা যেতে পারে।

গ্রীষ্মকাল-নাইট্রোজেন-ফসফরাস : পটাশিয়াম, ৮০ : ৪০ : ৫০ কিলোগ্রাম। উন্নত জাত- ভ্যারাইটি-নাইট্রোজেন : ফসফরাস : পটাশিয়াম, ২০ : ৫০ : ৩০ কিলোগ্রাম। সংরকরবীজ বা হাইব্রিড-নাইট্রোজেন : ফসফরাস :পটাশিয়াম, ১০০:১০০:১০০ কিলোগ্রাম। রাসায়নিক সার দুটি ভাগে, দু’বার ফসলের জীবনকালে দেওয়া হলে সার ব্যবহারের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অর্ধেক পরিমাণ নাইট্রোজেন এবং পুরো ফসফরাস ও পটাশিয়াম ভালোভাবে মিশিয়ে জমিতে প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের ত্রিশদিন পর বাকি পরিমাণ নাইট্রোজেন জমিতে প্রয়োগ করা উচিত।

বীজ শোধন : বীজগুলোকে ছত্রাকগঠিত রোগের জন্য আট থেকে ১০ গ্রাম ট্রাইকোডার্মা ভিরিডি এবং ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগের জন্য ১৫ থেকে কুড়ি গ্রাম সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স ভালোভাবে প্রতি কিলোগ্রাম বীজের সঙ্গে মিশিয়ে ছায়াযুক্ত জায়গা শুকিয়ে বীজ শোধন করতে হবে। যদি সম্ভব হয় চারশো গ্রামে অ্যাজোসপাইরিলাম প্রতি কিলোগ্রাম বীজের সঙ্গে মিশিয়ে বীজ বপন করলে উৎপাদন ভালো হয়। রাসায়নিক পদ্ধতিতে বীজ শোধনের জন্য প্রতি কিলোগ্রাম বীজের সঙ্গে দুই গ্রাম কার্বেন্ডাজিম বা কেপটানভ ভালো মিশিয়ে জমিতে বপন করতে হবে।

বীজের হার : গ্রীষ্মকালীন-১৫-১৫ কিলোগ্রাম-হেক্টর। বর্ষাকালীন-৮-১০ কিলোগ্রাম-হেক্টর। ভ্যারাইটি-৮-১০ কিলোগ্রাম-হেক্টর। বীজ বপনের সময়-গ্রীষ্মকালীন-জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। শীতকালীন-আগস্ট-সেপ্টেম্বর। খরিফ-জুন-জুলাই। বীজবপন পদ্ধতি- সাধারণত দুটি পদ্ধতিতে বীজ বপন করা যেতে পারে। সমতল এলাকায় শোধন করা বীজগুলোকে সারি বরাবর বপন করা যায়। সারিতে জৈবসার বা রাসায়নিক সার প্রয়োগ করলে সারের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। সার প্রয়োগের পর সারির মাটির সঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে বীজ বপন করা প্রয়োজন। প্রবল বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায় ১-১.৫ মিটার চওড়া এবং ২০-২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতাযুক্ত উঁচু জমি তৈরি করে বপন করা যেতে পারে।

গ্রীষ্মকালীন-৩০ সেন্টিমিটার ঙ৩০ সেন্টিমিটার অথবা ৪৬ সেন্টিমিটার ঙ৩০ সেন্টিমিটার। বর্ষাকালীন-৬০ সেন্টিমিটার ঙ৪৫ সেন্টিমিটার। খরিফ-৬০ সেন্টিমিটার ঙ ৩০ সেন্টিমিটার।

সংকর বীজ-৭৫ সেন্টিমিটার ঙ৩০ সেন্টিমিটার অথবা ৬০ সেন্টিমিটার ঙ ৪৫ সেন্টিমিটার। অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত এলাকায় উঁচু এবং খাঁজ কাটা ক্ষেত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবজি উৎপাদন করা যায়। এই পদ্ধতিতে ১-১.৫ মিটার চওড়া এবং ২০-২৫ সেন্টিমিটার উচ্চতাযুক্ত উঁচু জমি তৈরি করা হয়। উঁচু জমি তৈরির জন্য পাশের ১-১.৫ মিটার জমি থেকে মাটি উঠিয়ে উঁচু জমি তৈরি করা হয়। খাঁজ কাটা বা নিচু জমিতে ধান লাগানো হয় এবং উঁচু জমিতে সবজি লাগানো হয়। সাধারণত যে সব এলাকায় বৃষ্টিপাত বেশি হয়, শুধুমাত্র ধান ছাড়া অন্য কোনো সবজি লাগানো যায় না, সে সব এলাকায় এই প্রযুক্তি অবলম্বন করে ধান এবং সবজি একই সঙ্গে ফলানো যায়। পতিত বা অনুবর্ব নিস্ফলা জমিতে উপযুক্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করে উঁচু এবং খাঁজ কাটা ক্ষেত্র প্রযুক্তিতে ফসল ফলানো যায়। এক্ষেত্রে মাটির অমøতা এবং উর্বরতা পরীক্ষা করে নেওয়া উচিত। মাটির উর্বরতার উপর নির্ভর করে সার প্রয়োগ করা আবশ্যক।

যদি জমির অমøতা বেশি থাকে তবে ৪৫০-৫০০ কিলোগ্রাম চুন হেক্টর প্রতি প্রয়োগ করতে হবে। ফসলের চাহিদা থেকে বেশি পরিমাণে নাইট্রোজেন সার ব্যবহার করলে ফসলের অতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটে এবং পাতার বর্ণ গাঢ় সবুজ হয়ে যায়। এর ফলে বিভিন্ন ধরনের রোগ ও কীটশত্রু আক্রমণের প্রবণতা থাকে। বৃষ্টিপাত বহুল অঞ্চলে উঁচু ঢাল এবং খাত ক্ষেত্র প্রযুক্তির সাহায্যে ফসল ফলানো যায়।

এক্ষেত্রে বীজ বপনের পর বা চারা গাছ উঠার পর উঁচু ঢালের মতো করে দেওয়া হয়। ফলে অতিরিক্ত পানি দুটি ঢালের মধ্যে ৩০ সেন্টিমিটার ব্যবধানে রাখা উচিত। এই প্রযুক্তিতে সংকরবীজের ক্ষেত্রে ৭৫ঙ৩০ অথবা ৬০ঙ৪৫ সেন্টিমিটার ব্যবধান রাখা হয়। আজকাল অবশ্য সবজি ধানখেতের কিনারা বরাবর উঁচু আলের উপর সারি বরাবর লাগাতে দেখা যায়।