বাজারমূল্য বৃদ্ধি : রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজবদ্ধভাবে একত্রে মিলেমিশে বসবাস করে। প্রয়োজনের তাগিদে একে অন্যের সাথে পারস্পরিক লেনদেন এবং জিনিসপত্রের আদান-প্রদান করে থাকে। প্রাত্যহিক লেনদেনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ব্যবহারিক জীবনে ব্যবসায়-বাণিজ্যে পণ্য ও মূল্যের বিনিময় হয়ে থাকে। ক্রেতা ও বিক্রেতার মাঝে পণ্য ও মূল্যে যৌক্তিক বিনিময় আদান-প্রদান কাম্য হওয়া সত্ত্বেও যখন বিক্রেতা অতি মুনাফার লোভে চড়ামূল্যে বিক্রয় করার জন্য পণ্যসামগ্রী কুক্ষিগত করে, তখন একে বলে মজুদদারি। এর ফলে পণ্যের মূল্য বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায় এবং জনজীবন বিপর্যন্ত হয়ে পড়ে।

পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের মধ্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখার স্বার্থে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ইসলাম নিয়মণ্ডনীতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে ব্যবসায়-বাণিজ্য। ইসলাম ব্যবসায়-বাণিজ্য উৎসাহিত করতে যেমন বিভিন্ন রকম জাগতিক ও পারলৌকিক প্রাপ্তির ঘোষণা দিয়েছে তদ্রুপ বিভিন্ন ধরনের নৈরাজ্যকর ও অবাঞ্ছনীয় পদক্ষেপ প্রতিরোধে জাগতিক এবং পারলৌকিক শাস্তিও ঘোষণা করেছে। পণ্যসামগ্রী জমা রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সমাজের দুর্ভোগ বৃদ্ধি ও অতি মুনাফা অর্জন করাকে দণ্ডনীয় কাজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের অর্থব্যবস্থা চালু রয়েছে। অর্থব্যবস্থার ভিন্নতার পরিপ্রেক্ষিতে মজুতদারিতেও বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় রাষ্ট্র দ্রব্যসামগ্রী মজুত করে রাখে। আবার পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি পণ্য মজুত করে থাকে। তবে দুই অর্থব্যবস্থাতেই মজুতদারির পরিণতি ভয়াবহ। এ ছাড়াও আরো কিছু ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

ব্যক্তি ও রাষ্ট্রসমূহের মাঝে প্রতিযোগিতার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়। কেননা প্রতিযোগিতা না থাকলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হয় না এবং উৎপাদনও বৃদ্ধি পায় না। ফলে জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়। অনেক সময় আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমে যাওয়ার আশঙ্কায় আমদানিকৃত পণ্যসামগ্রী ধ্বংস করে দেয়া হয়। কেননা আমদানিকৃত পণ্যের অবাধ প্রবাহের ফলে দ্রব্যমূল্য কমে যায়। মুনাফা স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ীরা আগুনে পুড়িয়ে বা সমুদ্রে ফেলে পণ্য ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যের মারাত্মক সংকট ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।

মজুতদারি সমাজে লোভ, হিংসা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হয়। ফলে সামাজিক মূল্যবোধ হ্রাস পায়। মানুষের মাঝে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এক সময় সমাজের কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বেড়ে যায়। ফলে আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতি ঘটে। আর অর্থনীতিতে চরম মন্দা ও অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করে।

বাজার ও দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক গতিতে চলুক এটাই ইসলামের দাবি। স্বাভাবিক অবস্থায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা বা মূল্য নির্ধারণ করার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার সরকারের নেই এবং প্রয়োজনও নেই। বাজারে পণ্যসামগ্রীর আমদানি ও তার চাহিদার আলোকে দ্রব্যমূল্যের উত্থান-পতন হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সরকার দ্রব্যমূল্যে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। ক্রেতা ও বিক্রেতার পারস্পরিক চাহিদার ভিত্তিতেই পণ্য দ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হবে।

রসূলুল্লাহ স. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ থেকে বিরত থেকেছেন। তাঁর আমলে একবার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে লোকেরা এসে বলল, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাদের জন্য দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন নবী স. বললেন, ‘প্রকৃতপক্ষে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণকারী হচ্ছেন স্বয়ং আল্লাহ। তিনিই মূল্য বৃদ্ধি করেন। তিনিই সস্তা করেন। রিজিকদাতা তিনিই। আমি তো আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই এ অবস্থায় যে, কোনো রূপ জুলুম, রক্তপাত বা ধন-মালের অপহরণ ইত্যাদির দিক দিয়ে আমার কাছে দাবিদার কেউ থাকবে না’। সাহাবাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রসুলুল্লাহ স. দ্রব্যমূল্য নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করেননি। কেননা দ্রব্যমূল্য নির্ধারণের অধিকারী হচ্ছে ক্রেতা ও বিক্রেতা। দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করতে গেলে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ হবে, যা কোনো মতেই সমীচীন নয়। বরং তা আরো জুলুমের শামিল। তবে ব্যবসায়ীরা যদি স্বেচ্ছাচারী হয়ে মাত্রাতিরিক্ত চড়া মূল্যে পণ্য বিক্রি করে ভোক্তাসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগ সৃষ্টি করে তাহলে জনগণকে মূল্য বৃদ্ধির শোষণ থেকে মুক্ত করতে এবং তাদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ করতে সরকার বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে এবং ব্যবসায়ীদের তা মানতে বাধ্য করবে। আল্লামা ইউসুফ আল-কারযাভী বলেন, ‘গণঅসন্তোষ সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে যদি কোনো হালাল বস্তুর উচ্চ মূল্য চাপিয়ে দেয়া হয়, তবে তাও হবে হারাম। পক্ষান্তরে লোকদের মধ্যে সুবিচার ও ইনসাফ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে যদি মূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হয় এবং প্রচলিত দামে (Standard Price) বিক্রয় করতে ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয় কিংবা প্রচলিত বিনিময় মূল্যের অধিক গ্রহণ থেকে তাদের বিরত রাখা হয় তাহলে তা শুধু জায়েযই নয়, ওয়াজিবও।

মজুতদারির ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যে অস্থিতিশীল ও অরাজকতাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়, তা অর্থব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে যে নৈরাজ্যকর ও বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তা সমাজব্যবস্থাকে পর্যুদস্তু করে ফেলে। ইসলাম এ ক্ষেত্রে শাশ্বত ও যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। মজুতদারিকে নিষিদ্ধ করেছে এবং এ অবস্থা নিরসনে নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ ছাড়াও এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আরো কিছু পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন: সরকার মজুতদারির কুপ্রভাব সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরবে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী বিধি-নিষেধগুলো প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মজুতদারদের শরয়ী নির্দেশনা পালনে পদক্ষেপ নিবে এবং ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট থাকবে। দেশে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলে সরকার মজুতদারদের নীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে মজুতকৃত পণ্য সুলভ মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। মুজতদার শ্রেণি যদি তা অস্বীকার করে, তাহলে জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে এবং তাদের স্বার্থ ন্যায়সঙ্গতভাবে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকার মজুতকৃত পণ্যসামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে তা ন্যায্য মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সেসব পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে যা মজুতদারির কারণে দুষ্প্রাপ্য এবং দেশের অভ্যন্তরে সব পণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাবে। সরকার অন্যান্য দেশের সাথে পণ্য বিনিময় করবে বা তাদের ব্যবসায়ের জন্য উদ্বুদ্ধ করবে। বিশেষত দুষ্প্রাপ্য পণ্যসামগ্রী বাণিজ্যিকীকরণে তাদের উৎসাহিত করবে এবং পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করবে। যদি মুজতদারির কারণে পণ্যসামগ্রীর মূল্য বেড়ে যায় এবং বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে, তাহলে সরকার ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শক্রমে দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দিবে। আর মজুতদার শ্রেণিকে পণ্য ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য করবে। কিন্তু বাজার যখন স্থিতিশীল হয়ে যাবে তখন ক্রেতা-বিক্রেতাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, যাতে তাদের চাহিদার আলোকে পণ্যমূল্য নির্ধারিত হয়। সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি মনিটরিং সেল গঠন করবে। মনিটরিং সেলের অধীনে নিজস্ব জনবল দিয়ে প্রতিনিয়ত বাজার পরিদর্শনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যদি পরিদর্শকদলের নিকট কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

খাদ্য নিজস্ব উদ্যোগে আমদানির জন্য সরকার একটি বোর্ড গঠন করতে পারে। এ বোর্ডের মাধ্যমে পণ্য আমদানি করবে বা যারা পণ্য আমদানি করবে এ বোর্ড তাদের মনিটরিং করবে। এতে আমদানিকারকরা বেশি মূল্যে পণ্য বিক্রির সুযোগ নিতে পারবে না।

এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে নৈরাজ্যকর ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করবে এবং ক্রেতা-বিক্রেতার অধিকার সুনিশ্চিত হবে।

ইসলাম মানব জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম যুগোপযোগী বিধান দিয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্যের মতো অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডেও কল্যাণকর নীতি-আদর্শ উপহার দিয়েছে। এ নীতির অন্যতম দিক হলো- মজুতদারি, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী ও যে কোনো প্রতারণামূলক ব্যবসায়-বাণিজ্যের নিষিদ্ধকরণ। ইসলাম অতি মুনাফার লোভে প্রতারণা করে ও অপকৌশল অবলম্বন করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী আটক রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। আধুনিককালেও যেখানে পৃথিবীর নানা স্থানে মজুতদারির প্রভাবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনসাধারণ বিপর্যপ্ত, সেখানে ইসলাম বহুকাল পূর্বেই এর আইনগত বিধান বর্ণনা করে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করেছে। পরিশেষে আমরা বলতে পারি, ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় যদি ব্যবসায়-বাণিজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা হয় তাহলে শুধু মজুতদারির অপতৎপরতাই নয়, ব্যবসায়-বাণিজ্যে কোনো ধরনের নৈরাজ্য থাকবে না।

লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবা : ০১৯৬৩৬৭১৯১৭