ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে শান্তি পাবে শহীদদের আত্মা

ড. মাহবুব মোমতাজ
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলে শান্তি পাবে শহীদদের আত্মা

তোমাদের যা বলার ছিল-বলছে কি তা বাংলাদেশ? প্রজন্ম ’৭১-এর স্লোগান এটি। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের সংগঠন প্রজন্ম একাত্তুরের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা। একত্তুরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি বারবার সরকারকে একই কথা বলেছে।

স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর হলেও আজ ৩১ জুলাই নিষিদ্ধ হচ্ছে তাদের রাজনীতি। এটি ১৭ কোটি মানুষের জন্য সুখকর একটি বার্তা। বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার কলঙ্কজনক অধ্যায় হচ্ছে এদেশের কুলাঙ্গার পাকিস্তানের স্বাপদ সন্তান জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অধিকার। গত ২৯ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হবে। এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। প্রধানমন্ত্রীসহ ১৪ দলীয় জোটের নেতৃবৃন্দকে ধন্যবাদ।

১৯৪২ সালে ভারতে জামায়াতের প্রতিষ্ঠা হয় মাওলানা মওদুদীর হাতে। কিন্তু ইতিহাস অনেক পেছনের। জামায়াতের থিসিস মধ্যপ্রাচ্যের ইবনে তায়েমীয়ার (১২৬৮-১৩২৮)। তিনি বসবাস করতেন মিশরে জন্ম ইরাকে। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যাকারী এই প-িত (?) ইসলামকে চার খলিফার যুগে ফিরিয়ে নিতে ফতোয়া দেন। ইবনে তায়েমীয়ার মতে, ‘শরীয়া অবহেলা করা মানেই মুসলমানিত্ব হারানো এবং সঠিকভাবে শরীয়া পালন না করাই মুসলিম বিশ্বের স্থবিরতার কারণ। তিনি বলেন, শুধু কালেমা নামাজ পড়লেই হবে না। শরীয়া মানতে হবে। শরীয়া মানার একটি উদাহরণ হলোÑ কুয়া থেকে পানি খাওয়ার সময়ও ভাবতে হবে, এটি খননে বিধর্মীদের টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল কি না।’ ইমাম তায়েমীয়ার এসব অপব্যাখ্যা শুনে তাকে এবং তার থিসিসকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছিল, সে সময়ের ইসলামী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা। এমন এক সময় ইবনে তায়েমীয়া এইসব ব্যাখ্যা দেন, যখন ইউরোপজুড়ে অন্ধকার সময়। প্রোটো রেনেসাঁস শুধু শুরু হয়েছে। সেন্ট ফ্রান্সিস যখন রোমের পোপকে গীর্জার আনুষ্ঠানিকতা থেকে ধর্মকে বের করে সমাজে মানব কল্যাণে কাজে লাগাতে পরামর্শ দেন এবং ইউরোপে নবজাগরণের ঢেউ ওঠা শুরু হয়েছে। তখন ইবনে তায়েমীয়া মুসলমানদের পুরোনো পথে আহ্বান করেন। বিজ্ঞানচর্চা বন্ধ করার পরামর্শ দেন। আধুনিক বিজ্ঞানচর্চাকে ইবনে তায়েমীয়া জাহিলিয়াতের ও বর্বরতার চর্চা বলে ব্যাখ্যা দেন।

মওদুদী ইবনে তায়েমীয়ার এই থিসিস ১৯৩০-এর দশকে আবার জাগ্রত করেন। চল্লিশের দশকে জামায়াতের এই ধারণাকে রাজনৈতিক ফ্রেমে নিয়ে আসেন। দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের লাহোরে মওদুদী ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন। শরীয়াভিত্তিক রাষ্ট্র ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বৈধ নয় বলে প্রচার করেন। শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে জিহাদের ডাক জরুরি বলে ঘোষণা করেন। পঞ্চাশের দশকে কারমাইকেল কলেজের অধ্যাপক গোলাম আজমের মাধ্যমে জামায়াতের রাজনীতিকে পূর্ব পাকিস্তানে চালান করেন।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ (২) (ঙ) বর্ণিত ১৯৭২ সালের (ট্রাইব্যুনাল) ‘যুদ্ধাপরাধের দায়ে কোনো ব্যক্তি এ দেশের কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না’ বলে যে বিধান ছিল জিয়াউর রহমান তা বাতিল করে যোদ্ধাপরাধীদের নির্বাচন করার সুযোগ করে দেয়। ১৯৭২ সালের ‘দালাল’ আইন প্রত্যাহার করে জেলখানা থেকে যোদ্ধাপরাধীদের মুক্তকরে বিদেশি দূতাবাসে চাকরির ব্যবস্থা করে জিয়াউর রহমান। সংবিধানে ৬ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযুক্ত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিলুপ্তি ঘটায় এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ থেকে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ সংবিধান থেকে বাতিল করে দেয়। জিয়াউর রহমান সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল (১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু যা নিষিদ্ধ করেছিল) করার সুযোগ করে দেয়। ১৯৭৭ সালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসসলামী ছাত্রশিবির রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে।

জামায়াত-শিবিরের নখ দন্ত যেভাবে প্রকাশ পায়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর পরই পাকিস্তান সরকার তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দূরত্বের কারণে এদেশে ‘ইসলাম পছন্দ’ ব্যক্তিদের নিয়ে সহযোগী বাহিনী গড়ে তোলে। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পিডিপি ও মুসলিম লীগের সমর্থক কর্মী ও বিহারী উর্দুভাষীরা বিভিন্ন বাহিনীতে যোগ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। শান্তি কমিটি ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভাপতি নূরুল আমিনের নেতৃত্বে জেনারেল টিক্কা খানের পরামর্শে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। ফরিদ আহমেদ (পিডিপি), মাওলানা নূরুজ্জামান (নেজামে ইসলাম) হামিদুল হক চৌধুরী (অবজারভার পত্রিকার মালিক) গোলাম আজম (জামাতে ইসলামী) পীর মোহসিন উদ্দিন প্রমুখ শান্তি কমিটির নেতৃত্ব দেন। শান্তি কমিটির পরিকল্পনা ও নির্দেশে রাজাকার, আলবদর, আল শামস্ বাহিনীর কার্যক্রম পরিচালিত হতো। শান্তি কমিটির মূল কাজ ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের তালিকা প্রস্তুত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে দেয়া, লুটতরাজ করা, অগ্নিসংযোগ, স্কুল-কলেজেপড়–য়া মেয়েদের আর্মি ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়া এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা। পাকিস্তানের অখণ্ডতার নামে বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। ১৯৭১ সালের ২৪ আগস্ট শান্তি কমিটির মূল হোতা গোলাম আজম ‘পাকিস্তানের দূষমন’দের মহল্লায় মহল্লায়, তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলোপ করার নির্দেশ দেয়।

রাজাকার ১৯৭১ সালের মে মাসে জামায়াত নেতা এ, কে, এম, ইউসুফের নেতৃত্বে খুলনায় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তান সরকার জুন মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অধ্যাদেশ ১৯৭১’ জারি করে। ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকারদের তিনটি প্রধান কাজ ছিল (ক) পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার স্বার্থে নির্বিচারে বাঙালি হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। (খ) লুটপাট, চাঁদাবাজি, তহবিল সংগ্রহ করা, প্রতিশোধ গ্রহণ, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ করে সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করা এবং (গ) সমাজের দরিদ্র শ্রেণিকে প্রলুব্ধ করে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করা।

আলবদর বাহিনীর সভাপতি ছিল মতিউর রহমান নিযামী। কামারুজ্জামান (যোদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) মীর কাশেম, আশরাফুজ্জামান, আশরাফ হোসেন প্রমুখ সংগঠন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়েজিত ছিল। গভর্নরের উপদেষ্টা রাওফরমান আলীর তত্ত্বাবধানে ও সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে আলবদর বাহিনী গড়ে তোলা হয়। কুখ্যাত খুন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ছাত্রসংঘের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে (যোদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি কার্যকর হয়েছে)। মুজাহিদ ছিল সশস্ত্র ক্যাডার ও হিংস্র। ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা ও সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নির্যাতন করে হত্যায় সরাসরি কাজ করত আলবদর ও ছাত্রসংঘের ক্যাডাররা। ডেথ স্কোয়াড হিসেবে কাজ করেছে আল শামস। আলবদর ও ছাত্রসংঘের মতোই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও বুদ্ধিজীবী হত্যার পেছনে এই বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়ন, বাসায় বাসায় চিঠি পাঠানো ও গোপন তথ্য সংগ্রহ করে সেনাবাহিনীকে অবহিত করা ছিল প্রধান কাজ। মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগ কর্মী ও হিন্দুদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও মালামাল লুণ্ঠন করে সমাজে ত্রাস সৃষ্টি করত।

কাদের চৌধুরী (মুসলিম লীগ, কাইয়ুম) খান এ সবুর খান, জামায়াত ইসলামীর গোলাম আজম, শাহ আজিজ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী, মওলানা আব্দুল মান্নান, মওলানা আব্দুর রহিম, আব্বাস আলী প্রমুখ ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী সংগঠক।

১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্যদিয়ে এদেশে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার চক্রান্ত শুরু হয়েছিল। যার অনেকটাই সফল হয়েছে পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই সাল পর্যন্ত। এখন সময় এসেছে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার। যখন এই লেখা লিখছি, তখন বাংলাদেশ সরকারের নির্বাহী আদেশে আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার। তিপ্পান্ন বছর পর হলেও ৩০ লাখ শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে, এই ঘোষণার মধ্যদিয়ে। কলঙ্কমোচন হবে বাঙালির।

লেখক : শিক্ষক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও

প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত