ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চিকিৎসা ব্যয়ে লাগাম টানুন

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবা নেয়া দুরূহ
চিকিৎসা ব্যয়ে লাগাম টানুন

দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে হিমশিম খাওয়ার খবর নতুন নয়। এবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেল, চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে বছরে দরিদ্র হচ্ছে ৬১ লাখ মানুষ। এছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৬১ শতাংশ মানুষ অর্থসংকটে পড়েছেন এবং ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন। সম্প্রতি বিআইডিএসের ‘বিপর্যয়কর স্বাস্থ্য অভিঘাতের ফলে বাংলাদেশে দারিদ্য’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা মেটাতে গিয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খরচ করতে হয় বাংলাদেশে এবং এ সেবার ৭৩ শতাংশ ব্যয় মানুষের পকেট থেকে মেটাতে হয়। সার্ক অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের সর্বোচ্চ ব্যয়ের বিষয়টি আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা নিতে গিয়েও খরচের ঘানি সাধারণ মানুষকে টানতে হয় আর বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা নেয়া দুরূহ।

আমাদের সংবিধানেও চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা কিংবা চিকিৎসাসেবার পথ যে দেশে কাক্সিক্ষত মাত্রায় মসৃণ নয় এবং বৃহদাংশের সাধ্যের মধ্যেও নেইÑ এরই ফের সাক্ষ্য মিলেছে, বিআইডিএসের গবেষণা প্রতিবেদনে। স্বাস্থ্য খাতে এরইমধ্যে লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও এখনো যে এ ক্ষেত্রে ঘাটতি রয়েছে তাও অসত্য নয়। আমরা সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই দেখছি, সেবাপ্রত্যাশীদের নানারকম বিড়ম্বনা ও হেনস্তার চিত্র। কোনো কোনো সরকারি হাসপাতালে সেবাপ্রত্যাশীদের সেবার ক্ষেত্রে কিছু চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল অনেকের পাশাপাশি দালালচক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে ভোগান্তির খবর সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই উঠে আসছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা ব্যয়ের যে চিত্র দেখা যায়, তা অনেক ক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক।

নিকট অতীতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ ইকোনমিকস ইউনিটের প্রতিবেদনেও ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসা খরচের যে হিসাব তুলে ধরা হয়েছিল তাও স্বস্তির নয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সহায়সম্বল হারিয়েছেন অনেকেই। আবার উল্লেখযোগ্য একটি অংশের সহজে চিকিৎসাসেবা নেয়ার সুযোগই নেই। আমরা দেখছি, আস্থা সংকটের কারণেই চিকিৎসার জন্য প্রতি মাসে কয়েক হাজার রোগী বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছে। এর ফলে দেশের অর্থ বাইরে চলে যাচ্ছে এবং চলমান ডলার সংকটকালে তা আরো বৈরী প্রভাব ফেলেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে মোট বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে বলতে গেলে একেবারে ন্যূনতম অংশ। এ বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি প্রতি বছর বাজেট প্রণয়নের আগে বিভিন্ন মহল থেকে উঠে এলেও বাজেটে এর যথাযথ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায় না। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের অনিয়মণ্ডঅব্যবস্থাপনা-দুর্নীতির খবরও সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। এসব দূর করতে না পারলে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে নাÑ এ কথাও আমরা অতীতে এ সম্পাদকীয় স্তম্ভেই বলেছি। সরকারি ডানেক হাসপাতালেই যন্ত্রপাতি বিকল, ওষুধপত্রের সংকট, সেবাপ্রাপ্তির দুর্লভ চিত্র দৃশ্যমান। অভিযোগ আছে, কমিশনের লোভে একশ্রেণির চিকিৎসকের রোগ নির্ণয়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা আর ব্যবস্থাপত্রে অতিরিক্ত ওষুধ লেখার প্রবণতার। স্বাস্থ্যসেবার যে চিত্র উঠে এসেছিল তা আরো বিস্ময়কর। কীভাবে ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কমিশন নিয়ে কোনো কোনো চিকিৎসক রোগীর জন্য কী রকম হেনস্তাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন তাও ওই প্রতিবেদনগুলোয় উঠে এসেছিল।

বিভিন্ন সংকটে বিপর্যন্ত জনজীবনে চিকিৎসা খরচ আরেকটি নতুন বিড়ম্বনার মাত্রা যোগ করেছে। দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহের পর হাতে চিকিৎসার জন্য বরাদ্দ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি যেন শূন্যের কোঠায়। এ অবস্থায় গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো যোগ হয়েছে চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতি। চলমান মূল্যস্ফীতির অভিঘাতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত তখন সবকিছুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চিকিৎসা খরচ যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই, তাও আমরা বলেছিলাম। স্বাস্থ্য বিমা কর্মসূচির আওতার পরিসর বাড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা খরচের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে এজন্য ব্যক্তিপর্যায়ে ব্যয় কীভাবে কমানো যায় এ তাগিদও আমরা দিয়েছিলাম। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং পরিষেবাগুলো আরো সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা শক্তিশালী করা অত্যন্ত জরুরি। চিকিৎসাসেবায় কোনোরকম বৈষম্যকাম্য না হলেও এর ছায়াও কম বিস্তৃত নয়। চিকিৎসাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের নানামাত্রিক কৌশল আমাদের স্বাস্থ্য খাতের জন্য বড় সংকট।

সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবার জন্য যে জনবল ও অবকাঠামো আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, আর এরই সুযোগ নিচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। যদি অধিকারের ক্ষেত্রে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে জিইয়ে থাকা নেতিবাচক অনেক কিছুরই নিরসন সম্ভব। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন যৌথভাবে প্রচেষ্টা। চিকিৎসা ব্যয়ে লাগাম টানতে হবে দেশের জনগোষ্ঠীর বৃহৎ কল্যাণের স্বার্থে। জনমনে ফেরাতে হবে স্বস্তি। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন যথেষ্ট অর্থ ও সুচারু ব্যবস্থাপনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত