ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবা : ০১৯৬৩৬৭১৯১৭
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ

দেশে দেশে পরাশক্তিগুলোর অব্যাহত জুলুম ও নির্যাতনে অতিষ্ঠ মানবতা যখন ইসলামের শান্তিময় আদর্শের দিকে ছুটে আসছে, তখন ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসাবে প্রমাণ করার জন্য তারা তাদেরই লালিত একদল বুদ্ধিজীবীর মাধ্যমে কোরআন-হাদিসের অপব্যাখ্যা করে চরমপন্থি দর্শন প্রচার করছে। অন্যদিকে নতজানু মুসলিম সরকারগুলোকে দিয়ে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক কার্যকলাপগুলো চালাচ্ছে। অতঃপর জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে একদল তরুণকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাসী তৎপরতায় লাগানো হচ্ছে। আর তাকেই জঙ্গিবাদ হিসাবে প্রচার চালিয়ে ইসলামকে সন্ত্রাসবাদী ধর্ম বলে বদনাম করা হচ্ছে। অতঃপর সন্ত্রাস দমনের নামে বিশ্বব্যাপী নিরীহ মুসলমানদের রক্ত ঝরানো হচ্ছে। বাংলাদেশে একই পলিসি কাজ করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের পরামর্শগুলো নিম্নরূপ :

এক. এটি হতে পারে সংশ্লিষ্টদের চরমপন্থি আক্বিদা সংশোধনের মাধ্যমে। দুই. দেশে সুশাসন কায়েমের মাধ্যমে। তিন. গুম, খুন, অপহরণ ও নারী নির্যাতনসহ ইসলামের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক সব কার্যক্রম বন্ধের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। নইলে সমাজের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে সন্ত্রাসবাদ জনগণের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করবে। শেষের দুইটি সরকারের দায়িত্ব। প্রথমটি সমাজ সচেতন আলেম-ওলামা ও ইসলামী সংগঠনসমূহের দায়িত্ব। নিম্নে জিহাদ ও ক্বিতাল বিষয়ে চরমপন্থিদের বই-পত্রিকা ও ইন্টারনেট ভাষণসমূহের জবাব দানের মাধ্যমে আমরা জনগণকে সতর্ক করতে চাই। যাতে তাদের মিথ্যা প্রচারে মানুষ পদস্খলিত না হয়। আমরা সবার হেদায়াত কামনা করি। নিঃসন্দেহে হেদায়াতের মালিক আল্লাহ।

মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের ব্যাপারে শৈথিল্যবাদী ও চরমপন্থি দুইটি দল রয়েছে। যার কোনোটাই ইসলামে কাম্য নয়। এদের বিপরীতে ইসলামের সঠিক আক্বিদা হলো মধ্যপন্থা। যা আল্লাহ পছন্দ করেন এবং প্রকৃত আহলেহাদিসরাই যা লালন করে থাকেন। চরমপন্থিরা পবিত্র কোরআনের কয়েকটি আয়াত ও কয়েকটি হাদিসকে তাদের পক্ষে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। যে সবের মাধ্যমে তারা কবিরা গোনাহগার মুসলমানকে ‘কাফের’ বলে এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য করে। যেমন, (১) সূরা মায়েদাহ ৪৪ : যেখানে আল্লাহ বলেন, ‘যারা আল্লাহর নাজিলকৃত বিধান অনুযায়ী বিচার বা শাসন করে না, তারা কাফের’ (মায়েদাহ ৫/৪৪)। এর পরে ৪৫ আয়াতে রয়েছে ‘তারা জালেম’ এবং ৪৭ আয়াতে রয়েছে, ‘তারা ফাসেক’। একই অপরাধের তিন রকম পরিণতি : কাফের, জালেম ও ফাসেক।

ওই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর নাজিলকৃত বিধানকে অস্বীকার করল সে কুফরী করল। আর যে ব্যক্তি তা স্বীকার করল, কিন্তু সে অনুযায়ী বিচার করল না সে জালেম ও ফাসেক। সে ইসলামের গন্ডী থেকে বহির্ভূত নয়’ (তাফসীর ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)। বিগত যুগে এই আয়াতের অপব্যাখ্যা করে চরমপন্থি ভ্রান্ত ফের্কা খারেজীরা চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)-কে ‘কাফের’ আখ্যায়িত করে তাকে হত্যা করেছিল। আজও ওই ভ্রান্ত আক্বীদার অনুসারীরা বিভিন্ন দেশের মুসলিম সরকার ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। রাসূল (ছা.) খারেজীদের ‘জাহান্নামের কুকুর’ বলেছেন (ইবনু মাজাহ হা/১৭৩)। মানাবী বলেন, এর কারণ হল তারা ইবাদতে অগ্রগামী। কিন্তু অন্তরগুলো বক্রতায় পূর্ণ। এরা মুসলমানদের কোনো কবিরা গোনাহ করতে দেখলে তাকে ‘কাফের’ বলে ও তার রক্ত হালাল জ্ঞান করে। যেহেতু এরা আল্লাহর বান্দাদের প্রতি কুকুরের মতো আগ্রাসী হয়, তাই তাদের কৃতকর্মের দরুণ জাহান্নামে প্রবেশকালে তারা কুকুরের মতো আকৃতি লাভ করবে’ (ফায়যুল ক্বাদীর)। তওবা ৫ : ‘অতঃপর নিষিদ্ধ মাসগুলো অতিক্রান্ত হলে তোমরা মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর, পাকড়াও কর, অবরোধ কর এবং ওদের সন্ধানে প্রত্যেক ঘাঁটিতে ওত পেতে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, ছালাত আদায় করে ও জাকাত দেয়, তাহলে ওদের রাস্তা ছেড়ে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবা ৯/৫)। আয়াতটি বিদায় হজের আগের বছর নাজিল হয় এবং মুশরিকদের সঙ্গে আগেকার সব চুক্তি বাতিল করা হয়, এর ফলে মুশরিকদের জন্য হজ্জ চিরতরে নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরের বছর যাতে মুশরিকমুক্ত পরিবেশে রাসুল (সা.) হজ করতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হয়। এটি বিশেষ অবস্থায় একটি বিশেষ নির্দেশ মাত্র। কিন্তু তারা এর ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছে, ‘যেখানেই পাও’ এটি সাধারণ নির্দেশ। অর্থাৎ ভূপৃষ্ঠের যেখানেই পাও না কেন তাদের বধ করো, পাকড়াও কর হারাম শরীফ ব্যতীত’ (যুগে যুগে শয়তানের হামলা ৯২ পৃ.)। (৩) তওবা ২৯ : ‘তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবদের মধ্যকার ওইসব লোকের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তার রাসুল যা হারাম করেছেন, তা হারাম করে না ও সত্য দ্বীন (ইসলাম) কবুল করে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বিনীত হয়ে করজোড়ে জিযিয়া প্রদান করে’ (তওবা ৯/২৯)। আয়াতটি ৯ম হিজরীতে রোমকদের বিরুদ্ধে তাবূক যুদ্ধে গমনের প্রাক্কালে নাজিল হয়। এটিও বিশেষ পেরিপ্রেক্ষিতের নির্দেশনা। কিন্তু তারা এর ব্যাখ্যা করেছে, মদিনায় হিজরতের পরে আল্লাহ জিহাদের অনুমতি প্রদান করেন। পরে জিহাদ ও ক্বিতাল ফরয করে দেন। নবী ও ছাহাবিরা আল্লাহর ওই ফরয আদায়ের লক্ষ্যে আমরণ জিহাদে লিপ্ত ছিলেন। এই জিহাদের মাধ্যমেই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়’ (ঐ, ৯৪ পৃ.)।

ওই আয়াতের পরেই তারা (৪) একটি হাদিস এনেছেন যে, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, আমি লোকদের সঙ্গে লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি, যে পর্যন্ত না তারা সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল। আর তারা ছালাত কায়েম করে ও জাকাত আদায় করে। যখন তারা এগুলো করবে, তখন আমার পক্ষ হতে তাদের জান ও মাল নিরাপদ থাকবে ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের (অন্তর সম্পর্কে) বিচারের ভার আল্লাহর ওপর রইল’ (বু.মু. মিশকাত হা/১২)। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় তারা বলেছেন, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ‘উক্বাতিলান্নাস’ অর্থাৎ ‘মানব সমাজের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য’। রাসুল (সা.) যেহেতু শেষ নবী, তার পরে আর কোনো নবী নেই। অতএব, এই নির্দেশ কেয়ামত পর্যন্ত চলবে’ (ঐ, ৯৪ পৃ.)।

অথচ ওই হাদিসে ‘আন উক্বাতিলা’ (যেন পরস্পরে লড়াই করি) বলা হয়েছে, ‘আন আক্বতুলা’ (যেন আমি হত্যা করি) বলা হয়নি। ‘যুদ্ধ’ দু’পক্ষে হয়। কিন্তু ‘হত্যা’ এক পক্ষ থেকে হয়। যেটা চোরাগুপ্তা হামলার মাধ্যমে ক্বিতালপন্থিরা করে থাকে। অত্র হাদিসে বুঝানো হয়েছে যে, কাফির-মুশরিকরা যুদ্ধ করতে এলে তোমরাও যুদ্ধ করবে। কিংবা তাদের মধ্যকার যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে তোমরা যুদ্ধ করবে। কিন্তু নিরস্ত্র, নিরপরাধ বা দুর্বলদের বিরুদ্ধে নয়। কাফির পেলেই তাকে হত্যা করবে সেটাও নয়। তাছাড়া ওই হাদিসে ‘যারা কালেমার স্বীকৃতি দিবে, তাদের জানমাল নিরাপদ থাকবে বলা হয়েছে, ইসলামের হক ব্যতীত এবং তাদের বিচারের ভার আল্লাহর ওপর রইল’ বলা হয়েছে। এতে স্পষ্ট যে, আমাদের দায়িত্ব মানুষের বাহ্যিক আমল দেখা। কারু অন্তর ফেড়ে দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। অতএব, সরকার যদি বাহ্যিকভাবে মুসলিম হয় এবং ইসলামী দাওয়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান না নেয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদের সুযোগ কোথায়? তারা ইমাম মাহদীর আগমন ও ঈসা (আ.) কর্তৃক দাজ্জাল নিধন সম্পর্কিত হাদিছ এনেছেন এবং বলতে চেয়েছেন যে, কেবল জিহাদ ও ক্বিতালের মাধ্যমেই ইসলামের অগ্রযাত্রা সম্ভব। তাওহীদী দাওয়াতের মাধ্যমে নয়’ (ঐ, ৯৫ পৃ.)। অতঃপর আরেকটি হাদিছ এনেছেন, ‘নিশ্চয়ই এই দ্বীন সর্বদা প্রতিষ্ঠিত থাকবে এবং মুসলমানদের একটি দল কেয়ামত পর্যন্ত এর জন্য লড়াই করবে’ (মুসলিম হা/১৯২২)। তারা এর অনুবাদ করেছেন, ‘মুসলমানদের একদল কেয়ামত পর্যন্ত এ দ্বীনের জন্য যুদ্ধে রত থাকবে’ (ঐ, ৯৯ পৃ.)। প্রশ্ন হল, ঈসা (আ.) কর্তৃক দাজ্জাল নিধনের আগ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় মুসলমানরা কার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রত থাকবে? তারা কি তাহলে সব কবিরা গোনাহগার মুসলমানকে হত্যা করবে? মাথাব্যথা হলে কি মাথা কেটে ফেলতে হবে? নাকি মাথাব্যথার ওষুধ দিতে হবে? অথচ উক্ত হাদিছের ব্যাখ্যা এসেছে একই অনুচ্ছেদের অন্য হাদিছে। যেখানে রাসুল (সা.) বলেন, ‘চিরদিন আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমতাবস্থায় কেয়ামত এসে যাবে, অথচ তারা ওইভাবে থাকবে’ (মুসলিম হা/১৯২০)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যারা তাদের শত্রুতা করবে, তারা তাদের উপরে বিজয়ী থাকবে’ (মুসলিম হা/১০৩৭)। যার ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন, তারা হল শরী’আত অভিজ্ঞ আলেমরা। ইমাম আহমাদ (রহ.) বলেন, তারা যদি আহলুল হাদিছ না হয়, তাহলে আমি জানি না তারা কারা? (শরহ নববী)। এখানে লড়াই অর্থ আদর্শিক লড়াই ও ক্ষেত্র বিশেষে সশস্ত্র লড়াই দুইই হতে পারে। কেবলমাত্র সশস্ত্র যুদ্ধ নয়। রাসুল (সা.) তাই বলেন, ‘খারেজীদের থেকেই দাজ্জাল বের হবে’!

নিসা ৬৫ : তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে...’ (নিসা ৪/৬৫)। খারেজী আক্বীদার মুফাসসিররা অত্র আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন ‘তাগূতের অনুসারী ঐসব লোকেরা ‘ঈমানের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যাবে। মুখে তারা যতই দাবি করুক না কেন’। অথচ এখানে ‘তারা মুমিন হতে পারবে না’-এর প্রকৃত অর্থ হলো, ‘তারা পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না’। কারণ ওই আয়াত নাজিল হয়েছিল দুইজন মুহাজির ও আনছার ছাহাবীর পরস্পরের জমিতে পানি সেচ নিয়ে ঝগড়া মিটানোর উদ্দেশ্যে (বুখারী হা/২৩৫৯)। দুইজনই ছিলেন বদরী ছাহাবি এবং দুইজনই ছিলেন স্ব স্ব জীবদ্দশায় ক্ষমাপ্রাপ্ত ও জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। অতএব, তাদের কাউকে মুনাফিক বা কাফির বলার উপায় নেই। কিন্তু খারেজী ও শী’আপন্থি মুফাসসিররা তাদের ‘কাফের’ বলায় প্রশান্তি বোধ করে থাকেন। তারা আয়াতের প্রকাশ্য অর্থ নিয়েছেন ও সকল কবিরা গোনাহগার মুসলমানকে ‘কাফের’ সাব্যস্ত করেছেন। ফলে তাদের ধারণায় কোন মুসলিম সরকার ‘মুরতাদ’ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে তার রাষ্ট্রে কিছু কুফরী কাজের প্রকাশ ঘটাল’ (যুগে যুগে শয়তানের হামলা ১৪৫ পৃ.)। অথচ তারা আরবীয় বাকরীতি এবং হাদিসের প্রতি লক্ষ্য করেননি। যেমন রাসুলুল্লাহ (ছা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! ঐ ব্যক্তি মুমিন নয় (৩ বার), যার প্রতিবেশী তার অনিষ্টকারিতা হতে নিরাপদ নয়’ (বু.মু. মিশকাত হা/৪৯৬২)। এখানে ‘মুমিন নয়’ অর্থ পূর্ণ মুমিন নয়। তারা বলেছেন, মক্কার মুশরিকরা আল্লাহকে বিশ্বাস করার পরেও মূর্তিপূজার অপরাধে তাদের জান-মালকে হালাল করা হয়েছিল। তদ্রুপ বাংলার শাসকবর্গ ঈমান আনয়নের পর মূর্তি ও দেবতা পূজায় লিপ্ত হওয়ার জন্য মুশরিকে পরিণত হয়ে ‘মুরতাদ’ হয়েছে। তাদের জান ও মাল মুসলিমের জন্য হালাল’ (ঐ, ১৫১ পৃ.)। অথচ মক্কার মুশরিকরা ইসলাম কবুল করেনি।

শূরা ১৩ : আল্লাহ বলেন, ‘... তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহ্বান কর, তা তাদের কাছে কঠিন মনে হয়...’ (শূরা ৪২/১৩)। অত্র আয়াতে বর্ণিত ‘আক্বীমুদ্দীন’ অর্থ ‘তোমরা তাওহীদ কায়েম কর’। নূহ (আ.) থেকে মুহাম্মাদ (সা.) পর্যন্ত সব নবী-রাসূলকে আল্লাহ একই নির্দেশ দিয়েছিলেন। সব মুফাসসির এই অর্থই করেছেন। যেমন- আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যেক জাতির কাছে রাসুল পাঠিয়েছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং ত্বাগূতকে বর্জন করো’ (নাহল ১৬/৩৬)। এর দ্বারা সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব তথা ‘তাওহীদে ইবাদত’ বুঝানো হয়েছে। কিন্তু খারেজীপন্থি লেখকরা ‘তোমরা দ্বীন কায়েম কর’-এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন ‘তোমরা হুকূমত কায়েম করো’ (আবুল আ’লা মওদূদী, খুত্ববাত ৩২০ পৃ.)। এর পক্ষে তারা একটি হাদিসেরও অপব্যাখ্যা করেছেন, যেখানে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই বনু ইসরাইলকে পরিচালনা করতেন নবীরা। যখন একজন নবী মারা যেতেন, তখন তার স্থলে আরেকজন নবী আসতেন’ (বোখারী হা/৩৪৫৫)। এখানে এর অর্থ তারা করেছেন ‘নবীরা বনু ইস্রাঈলদের মধ্যে রাজনীতি করতেন’। আর এটাই হল ‘সব ফরযের বড় ফরজ’। আসল ফরজটি কায়েম না থাকায় নামাজ-রোজা সমাজে ফরযের মর্যাদায় নেই, ‘মুবাহ’ অবস্থায় আছে- যার ইচ্ছা নামাজ-রোজা করে’ (অধ্যাপক গোলাম আযম, রসুলদের আল্লাহতায়ালা কী দায়িত্ব দিয়ে পাঠালেন? সূরা হাদীদ-২৫ আয়াতের ব্যাখ্যা)। অর্থাৎ নবীরা সবাই ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেছেন। বস্তত এটি নবীগণের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়।

মায়েদাহ ৩ : ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম...। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। বিদায় হজ্জের দিন সন্ধ্যায় অত্র আয়াত নাজিল হয়। অতএব ইসলাম যেহেতু সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয়ভাবে পূর্ণতা পেয়েছে, সেহেতু আমাদের সর্বদা সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্র কায়েম করতে হবে’। অথচ রাসুল (সা.)-এর পূর্ণ জীবনই মুসলমানের জন্য অনুসরণীয়, কেবলমাত্র শেষ আমলটুকু নয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ বস্ততঃ রাসুল (সা.) মাক্কী ও মাদানী উভয় জীবনে আমর বিল মারূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর নীতিতে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন। শ্রেষ্ঠ উম্মত হিসাবে আমাদেরও সেটাই কর্তব্য!

আত্মঘাতী হামলা : রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে মুসলমান ...তার দ্বীন রক্ষার্থে নিহত হয়, সে শহীদ..’ (তিরমিযী হা/১৪২১)। এজন্য তারা আত্মঘাতী হামলা জায়েয মনে করেন। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না’ (নিসা ৪/২৯)। আত্মহত্যা করা মহাপাপ। জিহাদের ময়দানে আহত হয়ে তীব্র যন্ত্রণায় কাতর জনৈক সৈনিক আত্মহত্যা করলে রাসুল (সা.) তাকে ‘জাহান্নামী’ বলে আখ্যায়িত করেন। কেন না, তার শেষ আমলটি ছিল জাহান্নামীদের আমল। অতঃপর রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ অবশ্যই ফাসেক-ফাজেরদের মাধ্যমে এই দ্বীনকে সাহায্য করে থাকেন’ ।

পরিশেষে বলব, বিদেশি আধিপত্যবাদীদের চক্রান্তে ও তাদের অস্ত্র ব্যবসার স্বার্থে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে এবং তাদেরই এজেন্টদের মাধ্যমে এটি সর্বত্র লালিত হচ্ছে।

অতএব সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও আল্লাহভীরু সৎসাহসী প্রশাসনের পক্ষেই কেবল এই অপতৎপরতা হতে দেশকে রক্ষা করা সম্ভব। সেই সঙ্গে আবশ্যক আলেম-ওলামাদের মাধ্যমে ব্যাপক আল্লাহ আমাদের সহায় হোন- আমিন!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত