ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজনৈতিক সহিংসতা ও অর্থনৈতিক সংকট

মইনুল ইসলাম, লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি
রাজনৈতিক সহিংসতা ও অর্থনৈতিক সংকট

কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে সংঘাতমুখর পরিস্থিতি দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণে এলেও দেশের অর্থনীতি দ্রুত সচল হবে- এটি এখনই বলা যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বন্দরে ‘কনটেইনারজট’ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সচিত্র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কারফিউ জারির পটভূমিতে প্রায় সব শিল্প কারখানার উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে বেশি বেকায়দায় পড়েছে রপ্তানি খাত। সংকটের আগে উৎপাদিত রপ্তানি পণ্য ব্র্যান্ড-ক্রেতারা নিতে না পারায় সেগুলো কারখানা কিংবা বন্দরে পড়ে আছে। পরিবহন সচল থাকার সময় চট্টগ্রামবন্দরে পৌঁছানো রপ্তানি পণ্যও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না। একই কারণে শিল্পের জন্য আমদানি করা কাঁচামালও বন্দর থেকে হচ্ছে না ছাড়। এতে শুধু তৈরি পোশাক খাতেই দিনে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অন্তত ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকার। ব্যান্ড-ক্রেতারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে থাকলে তারা এ দেশ থেকে রপ্তানি আদেশ বিকল্প দেশে সরিয়ে নিতে পারেন।

এ পরিস্থিতির নেপথ্য কারণ সবারই জানা। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থাবিষয়ক ২০১৮ সালের পরিপত্রটি এ বছরের জুন মাসে বাতিল করেন হাইকোর্ট। এর প্রতিবাদে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারা দেশে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে। তারা কোটা ব্যবস্থার সংস্কারে সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। কিন্তু সরকার আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিতে অস্বীকার করে আসছিল।

১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর এক বক্তব্যের সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ মিছিল শুরু হয়। ছাত্রলীগ সেটি দমন করতে গেলে তীব্র আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সান্ধ্য আইন জারি করে, যা এই নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত চলছে (কিছুক্ষেত্রে শিথীল)। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত বন্ধ ছিল। পরে তা খুলে দেওয়া হয়। দেশজুড়ে এক ধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এখনো অচলাবস্থা পুরোপুরি কাটেনি।

আমার মতে, মেধার ভিত্তিতে সরকারি চাকরি পাওয়া শিক্ষার্থীদের ন্যায্য ও সাংবিধানিক অধিকার। তাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে তাদের দাবি ছিল খুবই ন্যায্য। কিন্তু সেটি চাইতে গিয়ে দেশের যে পরিস্থিতি হলো, সেটি কারো কাম্য ছিল না। অবশ্য এরই মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কোটা ব্যবস্থা নিয়ে নতুন রায় দিয়েছেন। এতে ৯৩ শতাংশ মেধার ভিত্তিতে, পাঁচ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান, এক শতাংশ প্রতিবন্ধী, এক শতাংশ কোটা আদিবাসী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য রাখা হয়েছে। কিন্তু রায় দেওয়ার আগেই দেশজুড়ে যে চরম ধ্বংসাত্মক ও সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ড চলেছে, সেটা অপূরণীয়।

সন্দেহ নেই, এ পরিস্থিতির রাজনৈতিক ক্ষতি ব্যাপক। বিশেষত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য। কারণ এই আন্দোলন এবং সেটি দমনে বেছে নেওয়া পদ্ধতি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে সরকারের বিপক্ষে নিয়ে গেছে। বিক্ষোভ ও আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। শিক্ষার্থীরাও ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আদালতের রায় এবং সরকারের নমনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে কতখানি ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ সম্ভব, এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।

ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ক্ষতি অন্যদিক থেকেও ঘটেছে। দুই পক্ষের সংঘাতে দেশজুড়ে ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে বিএনপি-জামায়াত বা ছাত্রদল-ছাত্রশিবির এবং কোথাও কোথাও উগ্রপন্থি ও জঙ্গিবাদীরাও আন্দোলনকারীদের কাতারে ঢুকে পড়ে। ধারণা করা যায়, কোটা সংস্কার চাওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা নয়; পরবর্তী সময়ে যুক্ত হওয়া রাজনৈতিক শক্তিগুলোই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।

বোঝাই যাচ্ছে, সরকারবিরোধী শক্তি তাদের সর্বশক্তি দিয়ে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে দেশব্যাপী জ্বালাও-পোড়াও করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন ভাঙচুর, ছাত্রলীগ নেতাদের রগ কাটা, ছাদ থেকে ফেলে ছাত্রলীগ কর্মী হত্যা, মেট্রোরেল স্টেশন ধ্বংস, ইন্টারনেটের ডেটা সেন্টারে আগুন, সাবমেরিন কেবল কেটে দেওয়া, সেতু ভবন ভাঙচুর, সিটি কর্পোরেশনের ৭০টি ময়লার ট্রাক পোড়ানো, রেললাইন উপড়ানো, পুলিশ হত্যা, সারা দেশে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করা- কোনো কিছু বাদ যায়নি। এ ধরনের অচিন্তনীয় অপরাধ যারাই করুক, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। অতএব আমরা মনে করি, যত শিগগির সম্ভব দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসব ধ্বংসযজ্ঞের পাশাপাশি প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। সরকারের উচিত হবে, আন্দোলনের জের ধরে সহিংসতার ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করা। সেখানে যেমন সম্পদ ও স্থাপনা ধ্বংসের চিত্র থাকবে, তেমনই থাকতে হবে হতাহতের পরিসংখ্যান।

যাহোক, গত এক-দুই সপ্তাহে সংঘটিত সব অঘটনই দেশের অর্থনীতিতে কীভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, এই নিবন্ধের সূচনায় উদ্ধৃত গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে তার ইঙ্গিত রয়েছে। এরইমধ্যে অর্থনীতি প্রায় পুরোপুরি থমকে পড়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ডিজিটাল কার্যক্রমের সব কিছু অচল হয়ে গিয়েছিল। সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু হয়েছে। আশা করি পুরোপুরি চালু হবে। গত রোববার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ব্যাংকিং সিস্টেমসহ সব ধরনের অনলাইন লেনদেন বন্ধ ছিল। এতে জনদুর্ভোগও অনেক বেড়ে গেছে। দৈনন্দিন রিচার্জসহ বিদ্যুৎ বিলের মতো অতি প্রয়োজনীয় লেনদেন করতে গিয়ে জনসাধারণ ভোগান্তির মধ্যে পড়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত