ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোটা সংস্কার থেকে কারফিউ, মৃত্যু ও গ্রেপ্তার

কোটা সংস্কার থেকে কারফিউ, মৃত্যু ও গ্রেপ্তার

ছাত্র-ছাত্রীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে ১৯ জুলাই ‘২৪ দিবাগত রাত থেকে কারফিউ জারি করা হয়। যা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোতে শীর্ষ খবর হিসেবে স্থান পায়। ঘটনার সূত্রপাত- ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার নিয়ে বড় ধরনের ছাত্র আন্দোলনের ফলে ওই বছরেই ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্তৃক সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি সংশোধন করে পরিপত্র জারি করে। জারি করা ওই পরিপত্রের ভাষ্য ছিল ( ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চের স্মারক সংশোধন করে) ৯ম গ্রেড (পূর্বতন ১ম শ্রেণি) ও ১০ম-১৩ম গ্রেড (পূর্বতন ২য় শ্রেণি) পদে মেধার ভিত্তিতে সরাসরি নিয়োগ দেয়া হবে এবং বিদ্যমান কোটাপদ্ধতি বাতিল করা হলো। ওই পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে চাকরিপ্রত্যাশী ও বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন ২০২১ সালে রিট করেন। ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুল দেন। ওই পরিপত্র কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল যথাযথ (মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল সংক্রান্ত পরিপত্র অবৈধ) ঘোষণা করে গত ৫ জুন, ২০২৪ বুধবার কোর্ট রায় দেন। ফলে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল থাকে এবং ওই দিন থেকেই এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিপুল সংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামেন এবং তা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পরে। ১০ জুন ‘২৪ ছাত্রছাত্রীরা তাদের দাবি মানতে ৩০ জুন ‘২৪ পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন এবং এ সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে ১ জুলাই ‘২৪ থেকে তারা আবার আন্দোলনে নামবেন। এমন অবস্থায় ওই রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ৪ জুলাই ‘২৪ শুনানির দিন ধার্য করে। বেঁধে দেয়া সময়ে শিক্ষার্থীদের দবি না মানায় ১ জুলাই ‘২৪ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিদ্যাপিঠে আন্দোলন করে, সড়ক অবরোধ করে, সমাবেশ করে এবং ৪ জুলাই ‘২৪ পর্যন্ত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেয়। আদালত ৪ জুলাই শুনানি মুলতবি করে। ৫ জুলাই শুক্রবার ছুটির দিন হলেও এদিন থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ৭ জুলাই ‘২৪ শিক্ষার্থীরা দেশের সব ক্যাম্পাসে ‘ধর্মঘট’ ও সড়কে ‘বাংলা ব্লকেড’ পালন করে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ধর্মঘট পালনের ঘোষণা করে। ‘বাংলা ব্লকেড’ এর ফলে স্থবির হয় রাজধানী। দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগান দেন এবং আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এর মধ্যেই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ছাত্রলীগ তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে আন্দোলন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করছেন এবং বিভিন্ন ক্যাম্পাসে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। ১০ জুলাই ‘২৪ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সারা দেশে ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি পালন করে। অচল হয়ে পরে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ। এর মধ্যেই দুই ছাত্রের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগে ( ৯ম থেকে ১৩ ম গ্রেড) কোটার বিষয়ে পক্ষগুলোকে চার সপ্তাহের স্থিতিবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেন এবং পরবর্তী শুনানির জন্য ৭ আগস্ট দিন ধার্য করে। দেশব্যাপী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ, অবরোধ চলতে থাকে। ১৪ জুলাই ‘২৪ বুধবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা করে পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির কাছে ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল দাবি আদায়ে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে স্মারকলিপি দেন। ঐ দিনই প্রধানমন্ত্রী চীন সফরের উপর সংবাদ সম্মেলন করেন। তখন এক সাংবাদিকের মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংক্রান্ত প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর উত্তরে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের অবমাননা করা হয়েছে দাবি করে ওই দিনই রাত ১০টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাস্পাসে বিক্ষোভ করেন। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা স্লোগান (গণমাধ্যমগুলোতে উঠে এসেছে) দেন, ‘তুমি কে, আমি কে? রাজাকার রাজাকার। কে বলেছে, কে বলেছে, সরকার সরকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ইত্যাদি। ওই রাতে ঢা. বি. ক্যাম্পাসে নেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ওই রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করে এবং তাদের উপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ আনা হয়। ১৫ জুলাই ‘২৪ দেশের সব ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষর্থীরা ৩ টায় হামলার প্রতিবাদে সমাবেশের ঘোষণা দেন, ছাত্রলীগও হামলার প্রতিবাদে দুপুরে সমাবেশ ডাকে। ফলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। ক্যম্পাসগুলো পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। টিয়ারশেল, শব্দ বোমা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খায়। সারা দেশে ৬ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। ফলে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্ষোভে ফেটে পরে। হলগুলোতে ছাত্রলীগের রুম ভাঙচুর করে। সারা দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। হলগুলো থেকে ছাত্র-ছাত্রীদের বের হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। রংপুর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদকে ১৮ জুলাই ‘২৪ তারিখ থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না (সমন্বয়কদের ২৪ জুলাই ‘২৪ ডিআরইউতে সংবাদ সম্মেলনের পর তাদের খোঁজ পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে দুই জনকে নিজ এলাকায় ফেলে যাওয়া হয় আর একজন ফেসবুকে পোস্ট দেন ‘গুম হতে হতে অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলাম’। এদিকে দেশে ১৭ জুলাই ‘২৪ থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৮ জুলাই ‘২৪ থেকে ব্রডব্যন্ড ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী ১৮ জুলাই ‘২৪ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জাতীয় ও নাগরিক নিরাপত্তার বিষয় মাথায় রেখে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ১৯ জুলাই ‘২৪ আওয়ামী লীগ তাদের কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ ডাকে এবং বিএনপি’র জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ঐক্য সমাবেশ ডাকে। ওই দিনই বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাড. রুহুল কবির রিজভীকে প্রেসক্লাব এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শুরু হয় রাজনৈতিক ধর-পাকড়। এর মধ্যে টিভি স্ক্রলে লেখা ওঠে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের নিজ নিজ কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করতে পারবে, এছাড়া আর কোথাও কোনো সমাবেশ কেউ করতে পারবে না। বিক্ষোভ তখন তুঙ্গে। সারা দেশে বিক্ষোভ হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ১৯ জুলাই ‘২৪ তারিখ দিবাগত রাত থেকে সারাদেশে কারফিউ জারি করা হয়। বাংলাদেশে সংঘর্ষ, গুলি, মৃত্যু, ধর-পাকড়, কারফিউ ইত্যাদি খবর বিশ্বের নামি-দামি পত্রিকায় শীর্ষে থাকে। এর আগে ১৮ জুলাই ‘২৪ আইনমন্ত্রী বলেন, ২১ জুলাই ‘২৪ রবিবার লিভ টু আপিল শুনানি এগিয়ে আনার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করা হবে। এরই মধ্যে কারফিউ চলাকালে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পাঁচ শতাংশ কোটা রাখা, ক্যাম্পাস খুলে দেয়া, শিক্ষর্থী মৃত্যুর বিচারসহ আট দফা দাবি দেন। কারফিউ চলাকালে প্রথমে ২ ঘণ্টা, পরে ৩ ঘণ্টা, ৪ ঘণ্টা এবং ২৪ তারিখ থেকে ৭ ঘণ্টা করে ঢাকায় ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় শিথিল করা হয়, সেই অন্যান্য জেলায় জেলা প্রশাসক নিজ নিজ এলাকার অবস্থা বুঝে নির্দিষ্ট সময়ে কারফিউ শিথিল করে। ২৪-২৫ জুলাই ‘২৪ থেকে ১১টা থেকে ৩টা অফিস খোলা রাখা হয়। গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২১ জুলাই ‘২৪ রোববার রাত ১২টা থেকে সোমবার সকাল ৬টা পর্যন্ত সারা দেশে ১২০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২২ জুলাই ‘২৪ সোমবার রাত থেকে ২৩ জুলাই ‘২৪ মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সারা দেশে আরো ১১০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৩ জুলাই ‘২৪ মঙ্গলবার রাত থেকে পরদিন বুধবার দুপুর পর্যন্ত সারাদেশে আরো ১৪০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কয়েকদিনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা প্রায় নয় হাজার। ২৪ তারিখ দুপুর পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই গ্রেপ্তার হয় ১৭৫৮ জনকে। গ্রেপ্তারদের বেশিরভাগই বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী। ২৮ জুলাই ‘২৪ তারিখ পর্যন্ত গণমাধ্যমগুলোর মাধ্যমে উঠে আসে কিছু হাসপাতাল, লাশ নিয়ে আসা ব্যক্তি বা স্বজনদের সূত্রে পাওয়া মৃত্যু ২১০ জন। সংঘর্ষ চলাকালে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিটিভি, ডেটা সেন্টার, সেতু ভবন, মেট্টোরেল স্টেশন ইত্যাদি যা জনসম্পদ।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত