ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ ঘরে ফেরার পরিবেশ করুন

অ্যাডভোকেট মো. রায়হান আলী
ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ ঘরে ফেরার পরিবেশ করুন

সারা দেশে বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলমান। দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ আন্দোলন করে যাচ্ছে লাগাতার। আন্দোলনটি ছোট থেকে এখন বিরাট পরিসরে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ আন্দোলনের ফলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে অনেকটা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে। এখন প্রতিদিনের ‘টক অব দ্য ডে’- এই আন্দোলনকে ঘিরেই। গণমাধ্যম, পত্রপত্রিকার মূল খবরই এই আন্দোলনকে নিয়ে। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এরইমধ্যে অনেকগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। ঝরে যাওয়া তাজা প্রাণগুলোর মধ্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী, শিশু, সাধারণ পথচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অন্যান্যরা।

তাজা প্রাণের সাথে রাষ্ট্রীয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে অন্যতম হলো- মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিটিভি ভবনসহ সারা দেশে অনেক সরকারি-বেসরকারি স্থাপনার ক্ষতি।

তথ্যমতে-কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ঘিরে ১৬ থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সংঘর্ষ-সংঘাতের ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২১৩ জন।

ইমনের মৃত্যুর পর ১৬-২১ জুলাই পর্যন্ত সংঘাতে ২১৪ জনের মৃত্যু হলো। আর গতকাল শুক্রবার আন্দোলন ঘিরে আরো দুজন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হলো ২১৬ জনের।

২০১৮ সালে বিপত্তি ঘটে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ করা নিয়ে। এই সংস্কার অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, অনগ্রসর জেলার কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশসহ মোট ৫৬ শতাংশ কোটার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। এতে ফুসে ওঠে মেধাবী ও তরুণ ছাত্রসমাজ। কোটার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে ২০১৮ সালেই সমাধান করা যেত কিন্তু সরকার সেটা তেমন আমলেই নেয়নি। পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ১ জুলাই ৫৬ শতাংশ কোটা বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেন এবং হাইকোর্ট এটাও বলেন যে, সরকার চাইলে কোটা সংস্কার করতে পারবে। হাইকোর্টের রায়ের পর পরই ২ জুলাই ২০২৪ থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা

কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের সঙ্গে এক পর্যায়ে কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও যোগ দেয়। ভোগান্তিতে পড়েন দেশের সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কোটাবিরোধীদের চলে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া। কোটা আন্দোলনের সমন্বয়করা এই আন্দোলনকে আরো জোরালোভাবে চালিয়ে যেতে থাকে। এমন বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে সরকার সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নামান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের উপর চড়াও হয়। এতে করে গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, এই আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের ছোড়া গুলিতে মারা যান। সে সময় আন্দোলনে যুক্ত হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কিছু রাজনৈতিক দলও। এতে করে দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। চলে জ্বালাও পোড়াও।

সরকারি গণমাধ্যম বাংলাদেশ টেলিভিশনে আগুন দেয়া হয়। এছাড়াও সেতু ভবনসহ অনেক সরকারি আধাসরকারি প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেই ১৬ জুলাই রাত থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত সারা দেশে পুলিশসহ অন্তত ১৬০ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরইমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয়। দায়িত্ব দেয়া হয় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেলকে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয় সরকার আলোচনায় বসতে চাইলে ৯ দফা শর্ত পূরণ করে বসতে হবে। কয়েকজন সমন্বয়কের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে প্রকাশিত দাবির মধ্যে বলা হয়, ‘ছাত্র হত্যার দায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সেতুমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। যেসব স্থানে ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেসব স্থানের পুলিশ কমিশনার এবং পুলিশ সুপারকে বরখাস্ত করতে হবে। ঢাবি, জাবি ও রাবি উপাচার্যকে পদত্যাগ করাতে হবে। নিহত এবং আহত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

ছাত্র হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ এবং ক্ষমতাশীল নেতাদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় হলগুলো খুলে দিতে হবে। আন্দোলনকারী কোনো শিক্ষার্থী যেন হয়রানির শিকার না হয়, সে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এসব দাবি পূরণ হলে তারা সিদ্ধান্ত নেবে আলোচনায় বসার বিষয়ে। যদিও এর পরদিন ২০ জুলাই সমন্বয়ক সারজিস আলমসহ তিনজনকে মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বেরিয়ে এসে ৮ দফা দাবি বিষয়ে টেলিভিশনে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। এর পরদিন ২১ জুলাই ‘দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘তিন মন্ত্রীর কাছে ৮ দফা দাবি পেশ তিন সমন্বয়কের’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদের শেষাংশে সমন্বয়ক আব্দুল কাদেরের একটি খুদে বার্তা তুলে ধরা হয়। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমাদের কয়েকজন সমন্বয়ককে সরকারি বাহিনী হেফাজতে নিয়ে তাদের দিয়ে মনগড়া বক্তব্য তৈরি করে তা প্রচার করছে। আমাদের পূর্বঘোষিত ৯ দফা দাবি বাস্তবায়ন হওয়ার আগ পর্যন্ত কমপ্লিট শাটডাউন আব্যাহত থাকবে।’ এর আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ১৯ জুলাই মধ্য রাত থেকে কারফিউ জারি করে সরকার, যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বিকাল ৫টা থেকে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত চালু থাকবে। এদিকে ২১ জুলাই রবিবার কোটা বিষয়ে আপিল বিভাগের শুনানি শেষে দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে রায় দেয়া হয়। এতে মেধা থেকে ৯৩ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা ৫ ভাগ এবং নৃ-গোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধী ২ ভাগ কোটা ঘোষণা দেয়া হয়।

এই রায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।

কারণ তাদের দাবি ছিল ৯ দফা। কোটার বিষয় পজেটিভ রায় হলেও ক্ষমতাশীন দলের কাছ থেকে অন্যান্য দাবিগুলোর ব্যাপারে ইতিবাচক সমাধান পায়নি বা ঘোষণাও আসেনি। ফলে ছয় সমন্বয়কের নেতৃত্বে আন্দোলন আবার চলছিল। এরইমধ্যে ছয় সমন্বয়কে ডিবি হেফাজতে নেয়া হয় এতে করে ছাত্ররা আন্দোলন আরো বেগবান করে। সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে নেয়ার ঘটনায় দেশ জুড়ে আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিবিপ্রধান গণমাধ্যমকে বলেছে- নিরাপত্তার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম দের ডিবি হেফাজতে রাখা হয়েছে। সমন্বয়করা ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়ার পর বলেছেন, ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) হেফাজতে থাকাকালে গত ২৮ জুলাই রাতে এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ঘোষণা তারা দিয়েছিলেন, তা স্বেচ্ছায় দেননি। ফলে, আন্দোলন আর থামেনি। এই আন্দোলকে ঘিরে এত ক্ষয়ক্ষতি সে বিষয় সুধিজনরা ক্ষমতাসীনদেরই দায়ী করছেন। অনেকেই বলছেন ক্ষমতাসীনদের এ আন্দোলনকে ছোট করে দেখা বা অবহেলার ফলেই আন্দোলনটা রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে। এরইমধ্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদ যা ক্ষতি হয়েছে তা হয়তো আমরা এক সময় কাটিয়ে উঠবো কিন্তু তাজা প্রাণগুলো ঝরে গেছে এ শোক কাটিয়ে ওঠা দূরূহ! শোকাহত পরিবারগুলোর আহাজারি আমাদের সবার হৃদয়কে নাড়া দিয়েছে।

স্বাধীন দেশের পতাকা ও মানচিত্র আমরা খুব সহজেই অর্জন করিনি। ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হানির মধ্য দিয়েই দীর্ঘ ৯ মাস এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন দেশটি অর্জিত। এ স্বাধীনতার মান-মর্যাদা টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। জনগণের টাকায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ আর সেই সম্পদ এমন অবলীলায় ধ্বংস হওয়াটা আমাদের নিজেদেরই ক্ষতি।

আমরা কোনো সংঘাত চাই না, সুষ্ঠু সমাধান চাই। ছাত্রদের দাবিগুলো নিয়ে ছাত্র-ক্ষমতাসীনদের আলোচনায় বসার পরিবেশ তৈরি করুন। এ দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার এই তরুণাই। তাদের যৌক্তিক চাওয়ার মূল্য দিতে হবে। সব সময় ভালো কাজে কিছু কুচক্রী থাকে তাই কারো উস্কানিতে কান না দিয়ে উদ্ভুত সমস্যা সমাধের পথ খুঁজে বের করতে হবে। তরুণ এই ছাত্ররা আমাদেরই সন্তান, আমাদেরই ভাই। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ ঘরে ফেরার পরিবেশ দ্রুত তৈরি করতে হবে। সোনার বাংলায় এমন বিরূপ পরিস্থিতি আর আমরা দেখতে চাই না।

লেখক : আইনজীবী ও কলামিস্ট,

জজ কোর্ট, খুলনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত