বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জ : গরিবের চেয়ে ধনীর বেশি

হাসান আলী, লেখক : কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গরিব মানুষ অবাক হয়ে ধনী মানুষের গাড়ি-বাড়ি, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার, চলন-বলনের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের দুঃখ-দুর্দশাকে নিয়তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। কেউ কেউ পরজনমে জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখেন। গরিব মানুষ সবার আগেই স্বর্গলাভ করবে। তাদের হিসাব-কিতাব কম এবং পৃথিবীতে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে এসেছেন। পৃথিবীতে যা ভোগ করতে পারেননি স্বর্গে এসে তা ভোগ করবেন। এ আশায় বুক বেঁধেছেন। গরিব মানুষের শ্রম বিক্রি করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। ঘুষ, দুর্নীতি, দখল, ব্যাংক লুট করে গরিবের ধনী হওয়ার সুযোগ নেই। গরিব কৃষকের ১০ হাজার টাকার কৃষি লোন মেরে দেওয়ার উপায় থাকে না। গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, ব্র্যাকসহ অন্যান্য এনজিও গরিব শ্রমজীবী মানুষকে কম-বেশি ঋণের জালে আটকে ফেলেছে। কিস্তি আতঙ্কে দিন কাটে। গরিব মানুষ ঋণ করে, জায়গা জমি বিক্রি করে বিদেশে যায় দুঃখের অবসান ঘটাতে। কেউ কেউ দালালের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হয় কিংবা অথৈ সমুদ্রে নিজেকে ভাসিয়ে স্বজনকে কাঁদিয়ে চলে যায়। মৃত্যু ব্যক্তির মুক্তি দিয়েছে; কিন্তু ঋণ থেকে পরিবারের লোকেরা মুক্তি পায়নি। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্স আসে, আমাদের রিজার্ভ বাড়ে। গার্মেন্ট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন আমাদের গৌরব বাড়িয়ে দেয়। প্রায় সাড়ে তিন কোটি কৃষক ফসল উৎপাদনে রেকর্ড তৈরি করেছে। বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ রিকশাচালক, গাড়িচালক, ভ্যানচালক, দোকান কর্মচারী, হোটেল শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, সেবাকর্মী হিসেবে কাজ করছেন। পরিবার-পরিজনের জন্য একটুখানি সুখ নিশ্চিত করতে দিন-রাত শারীরিক পরিশ্রম করেন। গরিব মানুষ যৌবনে নিজের দিকে ফিরে তাকানোর সময় পায় না। রোগ-শোকে কাবু না হওয়া পর্যন্ত কাজ করে যায়। অনেকে ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চান না পাছে বড় কোনো রোগের সংবাদ জানতে হয়। শরীর ক্ষয় করে টাকা রোজগার করে সংসার চালায়। গরিব মানুষ যৌবনেই প্রায় সব শক্তি শেষ করে ফেলেন।

বেশিরভাগ গরিব মানুষ বার্ধক্যকে ভয় পান। স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করেন রথে-হাতে যেন মৃত্যু হয়। অর্থাৎ সচল থাকতেই মৃত্যুকে বরণ করতে চান। কারণ বড় কোনো অসুখে চিকিৎসা ব্যয় মেটানোর সামর্থ্য তার নেই। ঘরে পড়ে থাকলে দেখাশোনা করার কেউ নেই। তিনবেলা ঠিকমতো খাবারের অনিশ্চয়তা দীর্ঘায়ু হওয়ার স্বপ্নকে আহত করে। গরিব মানুষের বার্ধক্য শান্তিপূর্ণ এবং স্বস্তিদায়ক হবে না- এটা শুরুতেই বুঝতে পারে। বাস্তবের কঠিন পরিস্থিতি থেকে বুঝতে শিখে গেছে বার্ধক্য পীড়াদায়ক। গরিব মানুষের দীর্ঘজীবন লাভ করার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে; কিন্তু সুযোগ খুবই কম। হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা, বাত-ব্যথা, হাঁপানি, রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, ক্যান্সার, নিদ্রাহীনতাসহ নানা ধরনের রোগের উন্নত চিকিৎসা গ্রহণের সামর্থ্য নেই। যৌবনে ক্ষয় করা শরীর বার্ধক্যের দুয়ারে এসে আতঙ্কিত হয়ে যায়। নিজের চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে পরিবারের সদস্যদের চাপ দিতে আগ্রহী হন না। প্রতিনিয়ত প্রার্থনায় কিংবা পরিবারের সদস্যদের জানিয়ে দেয় পৃথিবী থেকে দ্রুত চলে যাওয়া সুখকর। দীর্ঘায়ু হওয়ার জন্য প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করতে হয়। আমাদের বেশিরভাগ প্রবীণই গরিব, তাদের পক্ষে ব্যয়বহুল চিকিৎসা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব। কেউ কেউ আবেগের বশবর্তী হয়ে নামিদামি হাসপাতালে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। গ্রামে একটা কথার অনেক প্রচলন তা হলো, ‘ভাই, গরিবের মরণ কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে রাখা।’ গরিবের মৃত্যু মানুষকে অতটা শোকাভিভূত করে না। বরং দায়মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে। গরিব মানুষ সারাজীবন ভাত-কাপড়ের লড়াই নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মান-অপমানের লড়াই তার কাছে গৌণ হয়ে গেছে। সে জন্যই মালিক শ্রেণির শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন-নিপীড়নকে প্রায় বিনা চ্যালেঞ্জে গ্রহণ করেছেন। জীবনভর দুঃখ-কষ্ট পাওয়া মানুষ বার্ধক্যে সুখে থাকবেন- এমনটা আশা খুব কম মানুষই করে। বার্ধক্যে গরিব মানুষ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যৎসামান্য আর্থিক সহযোগিতায় বার্ধক্যের মাত্র কয়েকটা বছর বেঁচে থাকার সুযোগ পান। আমাদের দেশে বেশিরভাগ টাকা-পয়সা সৎভাবে উপার্জন করা হয় না। ঘুষ, দুর্নীতি, কর ফাঁকি, জনগণের সম্পত্তি দখল, ব্যাংক লুট ইত্যাদির মাধ্যমে এক শ্রেণির লোক প্রচুর টাকা-পয়সার মালিক হয়েছে। অতঃপর জনগণের কাছে তারা মহাপুরুষ এবং দানশীল একটি ভাবমূর্তি গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে দান-দক্ষিণা করতে শুরু করেন অথবা অন্যরা করতে অনুপ্রাণিত করেন। অবৈধভাবে অর্জিত ধন-সম্পদের মালিকরা কম-বেশি সবসময়ই অপরাধবোধে ভোগেন। তারা লুণ্ঠিত অর্থ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক প্রতিষ্ঠানে দান করে বাহবা অর্জন করেন। আবার কেউ কেউ অবৈধ অর্থ ব্যবহার করে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন কিংবা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করেন। ধনীরা প্রায় সব গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তারা আমাদের যা দেখতে দেবেন আমরা তা-ই দেখব এবং যা পড়তে দেবেন তা-ই পড়ব। এমনকি আন্দোলন-সংগ্রাম করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। সারাদেশ গুটিকয়েক মানুষের কাছে বন্দি হয়ে আছে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়ই সবকিছু চলছে। আর একদল সুবিধাবাদী উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত ধনীদের আশপাশে ঘুরঘুর করছে, ঘ্রাণ নিচ্ছে, উল্লসিত হচ্ছে, বন্দনা করছে, বাদ্য বাজাচ্ছে, কীর্তন গাইছে, মহিমান্বিত করছে। এই দলের মানুষই দীর্ঘজীবী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তারা স্বাস্থ্য সচেতন। প্রতিনিয়ত শরীর চেকআপ করান। ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বা পরামর্শে চলাফেরা করেন। পুষ্টিবিদের পরামর্শে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের সুযোগ পান। পরিমিত আহার, বিশ্রাম, গোছানো জীবনযাপন আর সুখকর ভ্রমণ মধ্যবিত্ত এবং ধনীদের অনেকখানি প্রফুল্ল রাখে। উন্নত চিকিৎসা লাভের সুযোগ থাকে হাতের নাগালে। একসময় বয়স বাড়তে থাকে, কর্মক্ষমতা হারাতে থাকে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে থাকে। শারীরিক অক্ষমতা দিন দিন বাড়তে থাকে। ওষুধ-চিকিৎসা একটা সময় ব্যর্থ হতে থাকে। রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাড়িতে আটকে যান। ধনী প্রবীণদের অবস্থান যত দুর্বল হতে থাকে, ততই বার্ধক্যের চ্যালেঞ্জগুলো সামনে এসে দাঁড়ায়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো নিঃসঙ্গতা। আশপাশে লোকজন হয়তো থাকে; কিন্তু তার সঙ্গে দীর্ঘসময় আলোচনার কোনো বিষয় থাকে না। কাজের বুয়া, ড্রাইভার, দারোয়ান এরাই আশপাশে বেশি থাকে। ছেলেমেয়েরা একই শহরে থাকলেও আলাদা বাসায় থাকার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। শহরের ধনী প্রবীণরা নিজের বাসায় থাকতে পারেন; কিন্তু ছেলেমেয়ের বাসায় উঠতে সংকোচ করেন কিংবা ওঠেন না। প্রবীণ স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে জীবনযাপনের সময় তবু কিছুটা সঙ্গ একে অপরকে দিতে পারেন। কেউ একজন যখন মারা যান, তখন সংকটের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়, একাকী প্রবীণ জীবন কাটানো অনেক কষ্টের। এই সময়ে ধনী প্রবীণরা অনেক বেশি আবেগিক সংকটের মধ্যে পড়েন। অনেক দুঃখ-কষ্ট-অপমান-অসম্মানের কথা নিজের কাছে লুকিয়ে রাখেন। কাউকে বলতে চান না এবং কেউ শুনতে তেমন আগ্রহী হন না। ধনী প্রবীণরা তখন ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হন। সে অবস্থা মোকাবিলা করার পর্যাপ্ত জ্ঞান পরিবারের সদস্যদের না থাকায় অনেক দুঃখজনক ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। ধনী প্রবীণরা সারা জীবন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছেন, দাপটে চলেছেন, কর্তৃত্ব করেছেন, সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। যখন এগুলো করতে পারেন না, তখন অনেক বেশি ভেঙে পড়েন। অনুভূতিপ্রবণ মানুষের কষ্ট বেশি হয়। যেহেতু ধনীরা বেশি অনুভূতিপ্রবণ তাই তাদের কষ্ট খানিকটা বেশি। তারা জীবন এমন হতে পারে তা কল্পনায়ও আনতে চাননি। প্রবীণ জীবনকে স্বস্তিদায়ক-শান্তিপূর্ণ-সম্মানজনক করার জন্য কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে, তেমন একটা দেখা যায় না।