ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

এমন জনতার কল্লোল আগে দেখেনি কেউ

সোহরাব হাসান, লেখক : সাংবাদিক ও কবি
এমন জনতার কল্লোল আগে দেখেনি কেউ

উনসত্তরে ঢাকায় ছিলাম না। ফলে সেই অভ্যুত্থানের সময় ঢাকার চিত্র কেমন ছিল, দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। সেনাশাসক এইচ এম এরশাদ যেদিন বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ করে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে সেনানিবাসে ফিরে গেলেন, সেদিন ঢাকা শহর ছিল মিছিলে মিছিলে একাকার।

কিন্তু এবারের মিছিলের সঙ্গে সেই মিছিল, এবারের গণজাগরণের সঙ্গে সেই গণজাগরণের কোনো তুলনা হয় না।

সেবার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বামপন্থি জোটসহ বিভিন্ন দল। এরশাদের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন পেশাজীবীরাও। কিন্তু এবারের আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে হয়নি। প্রচলিত ছাত্রসংগঠনও সেভাবে রাস্তায় নামেনি। নেতৃত্ব দিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারা সেই অর্থে ছাত্রনেতা ছিলেন না। কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যাদের কেউ কেউ ছাত্রসংগঠন করলেও বেশিরভাগ ছিলেন সাধারণ ছাত্রছাত্রী। আন্দোলনের নেতৃত্বেও তারা বিরল যূথবদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। শতাধিক সমন্বয়ক ও সহসমন্বয়ক নিয়ে অতীতে কোনো আন্দোলন এ দেশে গড়ে ওঠেনি।

ডিবি অফিসে আটক থাকা ছয় সমন্বয়ককে দিয়ে সরকার কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়ানোর পরও তাদের মধ্যে কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়নি। বাইরে থাকা সমন্বয়করা বলেছেন, এই বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি। শুরুতে তাদের আন্দোলনটি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের নিরীহ দাবিতে। ২০১৮ সালেও কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করে জয়ী হয়েছিলেন। আদালতের এক রায়ে তাদের সেই জয় যখন ছিনিয়ে নেয়া হলো, তখনই শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলেন। তাদের যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো, তখন ক্ষুব্ধ হলেন।

যেই তরুণরা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তাদের বয়স ২০ থেকে ২২ বছর। স্বাধীনতার অনেক পরে তাদের জন্ম। আন্দোলনকারী অনেকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। সেই তরুণদের রাজাকারের নাতি কিংবা বাচ্চা বলে উপহাস করা কোনোভাবে মানতে পারেননি।ম ধ্যরাতের নীরবতা ভেঙে হল ছেড়ে দলে দলে সড়কে বেরিয়ে এলেন। তখন পর্যন্ত আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। অশান্ত হয়ে উঠল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের উসকানিমূলক কথায়, যখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এমনকি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা চালালেন।

সেই থেকে ক্যাম্পাসের আন্দোলন বৃহত্তর রাজপথে ছড়িয়ে যায়। ৯ দফার আন্দোলন এক দফা অর্থাৎ শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগে গড়ায়। এরপর গত কয়েক দিন ঢাকার রাজপথ নয়, সমগ্র দেশ হয়ে ওঠে আন্দোলনের মুক্তাঙ্গন। ৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষার্থীদের ছাত্র-জনতার সমাবেশ পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শিশুকে কোলে নিয়ে মা-বাবা থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, তরুণ, নারীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এসেছিলেন মুক্তির স্বাদ পেতে।

তখন শহীদ মিনারকেই মনে হয়েছে গণতন্ত্রের মুক্তমঞ্চ। বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে এসেছিলেন অফিসফেরত সরকারি কর্মকর্তারাও। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিলেন। গান গেয়ে, সড়কে ছবি এঁকে, স্লোগান দিয়ে তারা ছাত্রদের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছিলেন। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন সরকারের জবরদস্তির বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়ে ওঠে রাষ্ট্র সংস্কারের আন্দোলনে। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন মোকাবিলায় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা পিস্তল, বন্দুক নিয়ে যে তাণ্ডব চালান, তাতে রোববার শতাধিক মানুষ মারা যান। এর আগেও আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের গুলিতে দুই শতাধিক মানুষকে জীবন দিতে হয়।

গত সোমবার শিক্ষার্থীদের মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি কেন্দ্র করে সারা দেশে সর্বাত্মক গণজাগরণ ঘটে। সরকারের কারফিউ উপেক্ষা করে সকাল থেকে ঢাকায় জনস্রোত আসতে থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যারিকেড ভেঙে দলে দলে হাজার হাজার লোক ঢাকায় প্রবেশ করেন। বিভিন্ন স্থান থেকে খবর আসতে থাকে, মহাখালীতে এত মানুষ জড়ো হয়েছেন। গাবতলী থেকে মিছিল করে মানুষ আসছেন। এ পর্যায়ে ঢাকার সব কটি প্রবেশপথ হয়ে ওঠে মানুষের কাফেলা। কারওয়ান বাজারে অফিস থেকে নিচে নামতে দেখি দলে দলে লোক শাহবাগের দিকে যাচ্ছেন। সেখানেও শিক্ষার্থী-তরুণদের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ। রিকশাচালক, সবজি বিক্রেতা, মুদিদোকানি, হকার, কে নেই সেই মিছিলে? উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছিল জনস্রোত। এরই মধ্যে খবর এলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন ত্যাগ করেছেন। মুহূর্তে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে ছুটলেন সবাই। গণভবন অভিমুখে। কেবল এই সড়ক থেকে নয়, ঢাকা শহরের সব দিক থেকে গণভবনের দিকে মানুষ যাচ্ছে। যাচ্ছেই।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল বেলা দুইটায়। কিন্তু সে সময় তিনি ভাষণ দিলেন না। পরে শোনা গেল সেনাপ্রধান কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতা ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসেছেন।

তাদের সঙ্গে আলোচনা শেষ হলে কথা বলবেন। অবশেষ ৪টায় তিনি জাতির উদ্দেশে বক্তব্য দিলেন। বললেন, ‘দেশে একটি ক্রান্তিকাল চলছে। সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের আমন্ত্রণ করেছিলাম। আমরা সুন্দর আলোচনা করেছি। সেখানে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীন দেশের সব কার্যক্রম চলবে।’ সব হত্যা ও অন্যায়ের বিচার হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি আস্থা রাখেন। আমরা সমস্ত দায়দায়িত্ব নিচ্ছি।’ কিন্তু লেখাটি যখন লিখছি, গত সোমবার সন্ধ্যার পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হামলা, ভাঙচুর ও আগুন দেয়ার খবর আসছিল। আন্দোলনের বিজয়কে ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে এগুলো বন্ধ করতে হবে। কারো হঠকারিতায় আন্দোলনের বিজয় বেহাত হোক, সেটি কারো কাম্য নয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত