ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নতুন দিনের সড়ক ব্যবস্থাপনার আশা

কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ, লেখক : সহকারী অধ্যাপক, এ আর আই, বুয়েট
নতুন দিনের সড়ক ব্যবস্থাপনার আশা

গত তিনদিনে আমাদের দেশে, দেশের সিস্টেমে অনেক বড় পরিবর্তন এসেছে এবং সবচাইতে বড় বিষয় হচ্ছে, সবাই দেশটাকে নতুন করে সাজাতে চাচ্ছে। এ কয়দিন ছাত্র-জনতা যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, যে কষ্ট স্বীকার করেছে, যেভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছে সেটার তুলনায় আজকে যে কোনো মতামত প্রদানই নগণ্য মনে হচ্ছে। তারপরও অনেক কিছু না পারলেও সড়ক নিরাপত্তা আর শৃঙ্খলা নিয়ে কাজ করার সুবাদে কিছু জিনিস শিখতে পেরেছি।

গত তিনদিন বিভিন্ন কাজে রাস্তায় বের হয়ে দেখলাম ছাত্র-ছাত্রীরা ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে নিজেরাই যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে এবং সবাই আগ্রহ নিয়ে তা মেনে চলছে, পথচারীরা জেব্রা ক্রসিং খুঁজে সেখান দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে, এমনকি একজন ভুল করলে অন্যজন শুধরেও দিচ্ছে।

এই চিত্র দেখে মনে হচ্ছে এই নতুন দিনের সূচনায় একটি দেশের সড়ক ব্যবস্থা কেমন হতে হবে তা বাস্তবতার নিরিখে লিখে রাখি। কারণ অনেক দেশের সড়ক ব্যবস্থা দেখে আফসোস হত; কিন্তু যে স্বপ্ন ছাত্ররা আমাদের দেখিয়েছে আর ভবিষ্যতের যে স্বপ্ন সবাই দেখছে তাতে আমিও চাই সড়ক ব্যবস্থা নিয়ে আফসোস না করতে। এখানে চেষ্টা থাকবে বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু বিষয় তুলে আনা যা চাইলেই করা সম্ভব।

সড়ক ব্যবস্থাপনায় একটা কথা আছে যার অনুবাদ করলে অনেকটা দাঁড়ায়, ‘যদি তুমি গাড়ির জন্য সড়ক পরিকল্পনা করো তবে তুমি দিন শেষে গাড়ির একটা জটলা পাবে আর যদি তুমি পথচারীর জন্য সড়ক পরিকল্পনা কর তবে তুমি একটি প্রাণবন্ত শহর পাবে।’ আজ পর্যন্ত আমরা যত সড়ক সংক্রান্ত পরিকল্পনা করেছি, সেখানে খুব কমই পথচারীকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, অথচ আমাদের দেশের সকল সড়কে পথচারীর সংখ্যাই বেশি।

একটু আগে যিনি যাত্রী ছিলেন বা একটু পর যিনি যাত্রী হবেন, যিনি চালক, যিনি মালিক সবাই কিন্তু আমরা পথচারী। কিন্তু যে কোনো উন্নয়ন কাজে প্রথম আঘাত আসে ফুটপাতের ওপর। ফুটপাত কোথাও আছে, কোথাও নেই, আবার আমি-আপনি আমরা সবাই দোকান দিতে চাই ফুটপাতে, নির্মাণসামগ্রী রাখতে চাই ফুটপাতে, ময়লা ফেলতে চাই ফুটপাতে, পুলিশ বক্স, টেলিফোন বস্ক, ম্যানহোল সব সবকিছুই রাখতে চাই ফুটপাতে।

আমরা বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)-এর এক গবেষণায় দেখেছি যে ফুটপাতে ২৬ ধরনের সমস্যা আছে যা পথচারীকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। আর এসব সমস্যার কারণে মানুষ চলে আসে রাস্তায়, রাস্তা হয় সংকীর্ণ, সৃষ্টি হয় যানজটের। এ অবস্থার নিরসন হওয়া দরকার, রাস্তায় সুন্দর, প্রশস্ত ফুটপাত দিতে হবে, ফুটপাতে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা রাখা যাবে না।

আমার বিশ্বাস সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো যদি ফুটপাত দিতে পারে এই তরুণরা তা আর্ট গ্যালারিতে পরিণত করবে যা এতদিন হয়তো ছিল ময়লা ফেলার স্থান। আমাকে স্বীকার করে নিতে হবে, আমাদের পর্যাপ্ত সড়ক নেই। জাতিসংঘ এর একটি সংস্থা দ্য ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান সেটেলম্যান্টস প্রোগ্রামের নির্বাহী পরিচালক ড. জন ক্লস ২০১৩ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ স্ট্রিট এস পাবলিক স্পেস অ্যান্ড ড্রাইভারস অব অরবান প্রসপারিটিতে বলেন, একটি বাসযোগ্য শহরের মোট আয়তনের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হবে এবং যদি এর চাইতে কম থাকে তাহলে এটি হবে একটা মারাত্মক ভুল।

এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকাতে ছোটবড় মিলিয়ে মোট রাস্তার পরিমাণ আছে মোট আয়তনের প্রায় ৯ শতাংশ যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এখন রাতারাতি চাইলেই আমরা সড়ক বাড়াতে পারব না; কিন্তু চাইলেই কিন্তু কিছু অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী সড়কের পরিমাণ বাড়ানো যায়, যেমন রাস্তার উপর যত্রতত্র পার্কিং না করা, দোকানের মালামাল রাস্তায় রেখে না রাখা, শপিং মলের পার্কিং-এর জায়গা নিশ্চিত করা, নির্মাণকাজ সংশ্লিষ্ট উপাদান সড়কে ফেলে না রাখা ইত্যাদি- যার ফলে রাস্তার ব্লকেজ অনেক কমে যাবে।

দ্বিতীয়ত যে বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া দরকার তা হল ইন্টারসেকশন ম্যানেজম্যান্ট। বিষয়টি নিয়ে লিখতে গেলে অনেক বড় হয়ে যাবে, তবে আপাতত কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা হলো প্রত্যেকটা ইন্টারসেকশন থেকে অন্তত ৫০ মিটার দূরত্বকে নো স্টপিং জোন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং এর পর বাস স্টপেজ দিতে হবে। আশা করছি নতুন দিনে যাত্রীরাও বাস স্টপেজ এ অপেক্ষা করবে আর চালকরাও স্টপেজ এই গাড়ি থামাবে।

লেখাটি যখন লিখছি, তখন বেশকিছু মটরসাইকেল চলে গেল যাদের মাথায় হেলমেট ছিল হাতে গোনা। বিআরটিএ এর সর্বশেষ হিসাব অনুসারে বাংলাদেশের মোট নিবন্ধিত মোটরযানের মধ্যে ৩৫ শতাংশ নিবন্ধিত হয়েছে ঢাকাতে এবং এই ৩৫ শতাংশ নিবন্ধিত গাড়ির মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ গাড়ি হচ্ছে মোটরসাইকেল এবং ব্যক্তিগত গাড়ি। এর বিপরীতে মিনিবাস ও বাস আছে মাত্র শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং দুই শতাংশ।

এর মানে হচ্ছে, ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি, যেগুলো বেশি মানুষ বহন করতে পারে না, তারাই রাস্তার সিংহভাগ দখল করে আছে আর অন্যদিকে রাস্তার অল্প জায়গা ব্যবহার করেই যে গণপরিবহন অনেক মানুষকে সেবা দিতে পারে, তাকে ক্রমান্বয়ে আমরা কোণঠাসা করে ফেলছি।

গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজি ব্যবস্থা করতে হবে, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গণপরিবহন ও জরুরিসেবার পরিবহনের জন্য আলাদা লেন রাখতে হবে, চালক-শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করতে হবে এবং রিকশাকে মূল সড়ক থেকে সরিয়ে এলাকাভিত্তিক চিহ্নিত করে চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। সড়কে বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন গতির যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিক যান একই সাথে চলাচল করলে রিকশার উপস্থিতি পুরো যানবাহন বহরের গতি কমিয়ে দেবে।

একটি সমন্বিত মাল্টিমোডাল পরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। সড়কের উপর থেকে চাপ কমানোর জন্য নৌরুট ও রেল পথের পরিকল্পিত উন্নয়ন ও সমন্বয় করা দরকার। ঢাকার চারপাশের ও মাঝে অবস্থিত সকল খাল-লেক দখল মুক্ত করে, নাব্য ফিরিয়ে এনে, পারস্পরিক সংযোগ স্থাপন করে ওয়াটার বাস চালু করা প্রয়োজন। পাশাপাশি অফিসের সময়ে ডেমো ট্রেনগুলো সচল করে, ঢাকার মধ্যবর্তী স্টেশনগুলোতে পরিচালনা করে অনেক যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব। আরো অনেক কিছু করা সম্ভব স্বল্পমেয়াদে কিন্তু লেখাটা আর বড় করতে চাচ্ছি না। পৃথিবীতে কোনো গ্রাফই সবসময় ঊর্ধ্বমুখী যেমন হয় না, তেমনি সব সময় নিম্নমুখীও হয় না।

মানুষ পারে তার জ্ঞান, বুদ্ধি ও সচেতনতার মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে। ঠিক তেমনি, রাজধানীর এই যানজট, এই স্থবিরতা চাইলে এখনও কাটিয়ে উঠা সম্ভব যার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন হবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী (রাজীব ও দিয়া) সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়, এরপর অনেক কিছু হয় আর সেই বছর নিজের ফেসবুকে লিখেছিলাম, আশা করি তোমরা তোমাদের মূল কাজ লেখাপড়া তে ফিরবে এবং নিজেকে আরো বেশি ক্যাপাবল করে ফিরে আসবে... তা না হলে তোমাদের সকল অর্জন সাময়িক হয়ে যাবে... মানুষের ভালোবাসা নিয়েই ক্লাসে ফিরে যাও... শ্রদ্ধা নেবার জন্য ফিরে এসো...।

সেই ছেলেগুলাই কিন্তু ৬ বছর পরে ফিরে এসেছে। আজকে ছেলেগুলো ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে ওরা কাউকে কিন্তু ফাইন করতে পারবে না, শাস্তি দিতে পারবে না, কিন্তু তবু কেউ সড়কে আইন ভাঙছে না কারণ সবাই জানে, যে ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে সে সৎ, সে কোনো দলের না বরং সে জনতার জন্য দাঁড়িয়েছে, নতুন দিনের বাংলাদেশের জন্য দাঁড়িয়েছে। ওরা আর কোনো পুরোনো চিত্র দেখতে চায় না। মানুষ ত এতদিন এই স্বপ্নটাই দেখছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত