ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে

জালাল উদ্দিন ওমর
জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে

ঢাকা দেশের রাজধানী আর চট্টগ্রাম দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। এই দুটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং আধুনিক শহর। আয়তন, জনসংখ্যা, অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিমানবন্দর, ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা, সড়ক-মহাসড়ক, ফ্লাইওভার এবং বড় বড় বিপণিবিতানসহ সব ধরনের অবকাঠামো বিবেচনায় ঢাকা দেশের সবচেয়ে বড় শহর এবং এর পরেই চট্টগ্রামের অবস্থান। জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং উন্নত জীবনযাপনের আধুনিক যত সুযোগ-সুবিধা তা এই দুটি শহরেই সবচেয়ে বেশি বিদ্যমান। দুটি শহরেই গড়ে উঠেছে অসংখ্যা দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা এবং আবাসিক এলাকা। নাগরিক সুবিধা প্রদান এবং তা বৃদ্ধির জন্য শহর দুটিতেই সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা এবং নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছে। ঢাকার অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে রাজউক আর চট্টগ্রামের অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছে সিডিএ। অথচ, জলাবদ্ধতা এখনো শহর দুটির অন্যতম প্রধান সমস্যা।

জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার এ দুটি শহরে একাধিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও এখনো সমস্যা থেকে মুক্ত হয়নি। একটু বেশি বৃষ্টিপাত হলেই শহর দুটির অনেক রাস্তাঘাট পানির নিচে তলিয়ে যায়। রাস্তায় জমে থাকে হাঁটু সমান পানি। রাস্তার পাশে বিদ্যমান দোকানপাটে এবং অনেক বসত বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যায়। এসব পানি আবার ময়লাযুক্ত এবং নোংরা। পানির পা¤প এবং মটর পানিতে ডুবে নষ্ট হয়ে যায়। বাড়ির নিচতলায় বিশুদ্ধ পানির টাংকিতে ময়লা পানি ঢুকে তা খাওয়ার অযোগ্য হয়ে যায়। রাস্তায় পানি জমার কারণে যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচল ব্যাহত হয় এবং যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে নাগরিক জীবনে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা নেমে আসে। জলাবদ্ধতা নিরসনের তাই শহর দুটিতে আধুনিক ড্রেনেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। পানি ছাড়া জীবন চলে না। তাই পানির অপর নাম জীবন। যেখানেই পানি, সেখানে জীবনের সৃষ্টি। যেখানে জীবন সেখানেই পানির ব্যবহার। আর জলাবদ্ধতা মানে হচ্ছে রাস্তাঘাটে, মাঠে ময়দানে পানি জমে থাকা। রাস্তাঘাটে পানি জমে এই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। শহরের ঘরবাড়ি, অফিস-আদালত, বিপণিবিতান, রেস্তোরাঁ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ প্রতিটি স্থাপনায় প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে পানি ব্যবহার হয়। মোটকথা, সেখানে মানুষের বসবাস এবং অবস্থান, সেখানেই পানির ব্যবহার। বাথরুমে, গোসলে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায়, রান্নাঘরে প্রতিদিন প্রচুর পানি ব্যবহার হয়। এই ব্যবহৃত পানি বিল্ডিং থেকে পাইপ দিয়ে প্রথমে বিল্ডিংয়ের পাশে অবস্থিত ড্রেনে যায়, তারপর ড্রেন থেকে খালে যায়, খাল থেকে নদীতে যায় এবং নদী হতে সাগরে যায়। একইভাবে শহরের প্রতিটির এলাকার বৃষ্টির পানিও ড্রেন হয়ে খালে, খাল হয়ে নদী এবং নদী হয়ে সাগরে যায়। রাস্তার ওপর যে বৃষ্টি হয়, সেই বৃষ্টির পানিও প্রথমে রাস্তার দুপাশে অবস্থিত ড্রেনে যায়, তারপর ড্রেন থেকে খালে, খাল থেকে নদীতে এবং নদী থেকে সাগরে যায়। এই পানিই আবার পানি চক্রের অন্তর্ভুক্ত হয়ে খাল-নদী-সাগর-মহাসাগর হতে বাষ্পীভূত হয়ে আকাশে যায়, তা আবার মেঘ হয়ে বৃষ্টি হয়ে ভূপৃষ্টে পড়ে। স্বাভাবিক সময়ে মানুষের নিত্য ব্যবহৃত পানি ড্রেন হয়ে খালে-নদীতে চলে যায় এবং সেক্ষেত্রে রাস্তাঘাটে কোনো জলাবদ্ধতা থাকে না। কারণ, মানুষের ব্যবহৃত এই পানির পরিমাণ প্রায় নির্দিষ্ট থাকে এবং এই পানি বহন করে নিতে ড্রেনসমূহ সক্ষম। কিন্তু বর্ষাকাল অথবা অন্য যে কোনো সময়ে বেশি বৃষ্টি হলে, তখন সেই বৃষ্টির পানি বহন করে নেওয়ার মতো ক্ষমতা ড্রেনসমূহের থাকে না। কারণ, এই সময় হঠাৎ করে অনেক পানি ভূপৃষ্টে পতিত হয়, ফলে ড্রেনের ওপর হঠাৎ করে বিরাট একটি চাপের সৃষ্টি হয়। এই পানি দ্রুত সময়ে ড্রেন হয়ে খালে-নদীতে চলে যেতে পারে না এবং তখনই পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এই পৃথিবীতে বিদ্যমান খাল-নদী-সাগর-মহাসগর সবই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এবং এসবই পানির ধারক-বাহক। এর প্রত্যেকটিই একে অপরের সাথে যুক্ত। এক দেশের পানি এসবের মধ্য দিয়েই চলে যায় অন্য দেশে আবার অন্য দেশের পানি চলে আসে অন্যকোনো দেশে। তাই পানির কোনো দেশ পরিচিতি নেই। শহুরে জীবনে প্রতিদিনের ব্যবহৃত পানি এবং বৃষ্টির সময়ে বৃষ্টির পানি এসব খাল-নদী-সাগর-মহাসাগরে চলে যাবার জন্য আমরা প্রতিটি এলাকায় এবং রাস্তার পাশে ড্রেন নির্মাণ করেছি। এসব ড্রেনের প্রত্যেকটি আবার একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। এসব ড্রেনের পাশাপাশি আমরা আবার অনেক নালা ও নির্মাণ করেছি। ড্রেনগুলো আবার এসব নালায় সংযুক্ত। নালাগুলো আকারে ড্রেন থেকে অনেকটা বড়। এসব নালা আবার খাল-নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে ব্যবহৃত এবং বৃষ্টির পানি প্রতিটি এলাকা থেকে ড্রেন হয়ে নালায় আসে এবং নালা হয়ে খাল ও নদীতে চলে যায়। এভাবেই শহরের পানি নিষ্কাশনের জন্য আমরা ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তুলেছি। স্বাভাবিক সময়ে মানুষের দৈনন্দিন ব্যবহৃত পানি পরিবহনের জন্য এসব ড্রেন এবং নালা যথেষ্ট এবং ব্যবহৃত এসব পানি বিদ্যমান এসব ড্রেন-নালা হয়ে খালে ও নদীতে চলে যায়। ফলে কোনো পানি জমে থাকে না এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় না। কিন্তু যখন একটু বেশি পরিমাণে বৃষ্টি হয়, তখন বৃষ্টির পানি দ্রুত সময়ে এসব ড্রেন হয়ে নালায় এবং নালা হয়ে খাল ও নদীতে চলে যেতে পারে না। আর কয়েক দিনের বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই। এ অবস্থায় চারিদিকে পানি জমে যায় এবং রাস্তাঘাট, বাড়ির উঠান, খেলার মাঠ সবই পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর এভাবেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘদিন থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের প্রায় প্রতিটি বড় শহরেই জলাবদ্ধতা একটি স্থায়ী সমস্যায় রূপ লাভ করেছে। একটুখানি বৃষ্টি হলেই এসব শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তখন প্রতিটি শহরেই যানজট আরো বেড়ে যায় এবং নাগরিক জীবন আরো দুর্বিষহ হয়ে উঠে। সুতরাং এসব শহরকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে হবে। তার জন্য প্রতিটি শহরেই পরিকল্পিত ড্রেনেজ ও পয়ঃনিষ্কাশন সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে এবং নিয়মিতভাবে এসব ড্রেন পরিষ্কার করতে হবে। এজন্য সরকারের পাশাপাশি সব স্তরের জনগণকে সচেতন এবং দায়িত্ববান হতে হবে। আমরা প্রায় সবাই পলিথিন, বিভিন্ন ধরনের বোতল, ছেড়া কাপড় এবং আরো বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট ডাস্টবিনে ফেলি না। এসব জিনিসিপত্র আমরা যত্রতত্র ফেলি, যা শেষ পর্যন্ত ড্রেনগুলোতে গিয়ে পড়ে। ফলে ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যায়। বৃষ্টি হলে বৃষ্টির পানি আর এসব ড্রেন দিয়ে স্বাভাবিকভাবে প্রবাহিত হতে পারে না এবং এ কারণে পানি জমে যায়। এ অবস্থায় জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনগুলো সব সময় পরিষ্কার রাখতে হবে এবং কোনো অবস্থাতেই ড্রেনে কোনো ধরনের ময়লা-আবর্জনা ফেলা যাবে না। বহুকাল হতেই শহরসমূহের মাঝখানে অনেক খাল রয়েছে, যেগুলো প্রায়ই ভরাট হয়ে গেছে। এসব খাল চিহ্নিত করে এগুলোকে পুনঃখনন করতে হবে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় যেসব পুকুর, লেক এবং জলাশয় রয়েছে, সেগুলোকে কোনো অবস্থাতেই ভরাট করা যাবে না। এসব পানির আধারকে ভরাট করার যে প্রতিযোগিতা চলছে তা এখনই বন্ধ করতে হবে। পরিকল্পিত ড্রেনেজ এবং পয়ঃনিষ্কাশন নিশ্চিত করেই ঘরবাড়ি এবং হাইরাইজ বিল্ডিং নির্মাণ করতে হবে।

লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত