ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ও রাষ্ট্র সংস্কারের দায়

বদিউল আলম মজুমদার, লেখক: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন
অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার ও রাষ্ট্র সংস্কারের দায়

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গত বৃহস্পতিবার যাত্রা শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের আমার আন্তরিক অভিনন্দন। এই ঐতিহাসিক যাত্রার শুরুতেই তাদের প্রতি আমার শুভকামনা রইল। আমি এই সরকারের সফলতা কামনা করছি। গত সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শপথের আগে দেশ কার্যত সরকারহীন হয়ে পড়েছিল।

অবশেষে নতুন সরকারের উপদেষ্টাদের শপথের মাধ্যমে প্রায় ৮০ ঘণ্টা পর সরকারহীনতার অবসান ঘটে। স্বাভাবিকভাবেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। কিছু কাজ আছে জরুরিভিত্তিতে করতে হবে। পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জের বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে। জরুরি চ্যালেঞ্জের প্রথম কাজ অবশ্যই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা। আগের সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে প্রশাসনিক যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তার কারণে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছিল। আমাদের পুলিশ বাহিনী দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়। এতদিন এক ব্যক্তির শাসন কায়েম ছিল। তার পতনের মধ্য দিয়ে পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। তার সঙ্গে অনেকেই পালিয়ে গেছেন। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পুনর্গঠন করা, জোড়া লাগানোর কাজ জরুরিভিত্তিতে করতে হবে যাতে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় এবং মানুষের মধ্যে আস্থা ফিরে আসে। প্রশাসনিক সংস্কারের কাজেও হাত দিতে হবে। প্রশাসন চরম দলীয়করণের শিকার ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে; যার কিছু নজির আমরা দেখেছি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন; বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে বিপুল অর্থ- কোনো কিছুই বাদ নেই।

অনুসন্ধান করলে প্রশাসনের সর্বত্র এমন মতিউরদের পাওয়া যাবে। তা ছাড়া প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে জনবিরোধীও হয়ে উঠেছিল।

সে জন্য ঢেলে সাজিয়ে একটা কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। গত সরকারের আমলে আমাদের কতগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ে। সেগুলো মেরামতেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে নজর দিতে হবে। যেমন নির্বাচন কমিশন, আদালত। আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি, নির্বাচন কমিশন দলীয়করণের ফলে মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। যে কারণে মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছিল।

চাইলেই তারা ভোট দিতে পারবে কি না কিংবা ভোট দিতে পারলেও সঠিকভাবে হবে কি না- এ নিয়ে সংশয় ছিল ব্যাপক। এটা নির্বাচনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার নজির। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কবলে পড়ে অযোগ্য, অদক্ষ ও দুর্নীতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়। মধ্য মেয়াদে কিংবা দীর্ঘমেয়াদে হলেও এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে জনবান্ধব, দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঢেলে সাজাতে হলে কিছু ক্ষেত্রে পুরোনোদের সরিয়ে নতুন লোক নিয়োগ দিতে হবে এবং অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। নির্বাচন কমিশনের যে অবস্থা, এটি পুনর্গঠনের বিকল্প নেই। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কার্যকর কমিশন জরুরি। অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর বিষয়ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকতে হবে। অনেক দিন ধরেই আমাদের ডলার সংকট। রিজার্ভের পরিমাণও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে গত মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দেন। এখন প্রবাসীদের আস্থায় এনে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করলে ডলার ও রিজার্ভ সংকট কাটাতে ভূমিকা রাখবে। সাধারণ মানুষের জন্য দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি বড় সমস্যা।

নিত্যপণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতার মাধ্যমে জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে হবে। অর্থনৈতিক সংকট থেকে দেশকে তুলে আনতে পারলে এ সরকারের পথচলা সহজ হবে। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটেছে; অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারে তাদেরও থাকা চাই। অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যারা নিহত ও আহত হয়েছে, তাদের তালিকা করা জরুরি। নিহতদের পরিবারকে যথাসম্ভব ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে যারা অপকর্ম করেছে; আন্দোলনকারীদের হতাহতের সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। এরইমধ্যে আমরা দেখেছি, অনেক অপরাধী পালিয়ে গেছে। অনেকে সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছে; তারা যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। এ জন্য সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া দরকার; সে জন্য জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্তিও গুরুত্বপূর্ণ। অন্যান্য অপরাধী- যারা ব্যাংক লুট করেছে; দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছে; দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন ও চাঁদাবাজি করেছে, তাদেরও বিচার হওয়া দরকার। দীর্ঘমেয়াদে চ্যালেঞ্জ হিসেবে আমি বলব, রাষ্ট্র মেরামত করতে হবে। ২০১৮ সালে আমরা দেখেছি, শিক্ষার্থীরা যখন নিরাপদ সড়কের আন্দোলন করেছে, তখনও রাষ্ট্র মেরামতের দাবি তুলেছে। সেই মেরামত হয়নি বলেই তা সরকারের পতন ডেকে এনেছে। এর পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে, যদি কতগুলো সুদূরপ্রসারী সংস্কারে হাত দেওয়া হয়। যেমন সংবিধান সংস্কার; আইনকানুন, বিধিবিধানে পরিবর্তন। যেমন বিচারক নিয়োগের বিষয় ঠিক করা। এগুলো হয়তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাস্তবায়ন করতে পারবে না। কিন্তু এই পরিবর্তন আনতে হলে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হওয়া দরকার। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক সমঝোতা করতে হবে। তাদের মধ্যে লিখিত চুক্তি করা যেতে পারে যে, তারা ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে। তবে সেই ঐকমত্য এখনই হওয়া চাই। যেমন আমরা বলেছি, একটা জাতীয় সনদ প্রণীত হতে পারে। সেখানে যে বিষয়গুলোতে ঐকমত্য হওয়া দরকার, সেগুলো লিখিত থাকবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়ার পর সেগুলো বাস্তবায়নে তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এ সরকার নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারে দু’জন তরুণ প্রতিনিধিও আছেন। তারা পরিস্থিতির আলোকে অগ্রাধিকারগুলোতে যেমন ত্বরিত পদক্ষেপ নেবেন, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে রাষ্ট্রের সংস্কার বিষয়েও নজর দেবেন বলে আমার বিশ্বাস। আমরা এই সরকারের সফলতা চাই। কিন্তু বিগত সরকারের নিয়োগকৃত এমন ব্যক্তিবর্গ শীর্ষস্থানীয় পদে এখনও বহাল আছেন, যারা আগের সরকারের অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এই সরকার তাদের দ্বারা ব্যর্থ হতে পারে; আমি সে ব্যাপারেও চিন্তিত।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত