ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা

মো. রায়হান আলী, অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট
বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা

আদালত ব্যবস্থাপনায় ও আদালতের দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় বিচারক আইনজীবীদের পাশাপাশি সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা, বেতন-ভাতাদি এবং সামাজিক মর্যাদা নিয়ে কোনো সরকার বা কেউ ততটা গুরুত্ব দেয়নি। অনেকেই মনে করেন, আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে বেতন-ভাতা পান তা ছাড়াও পাশাপাশি আরো অনেক উপরি ইনকাম রয়েছে। বস্তুত কথাটি সত্য নয়। এখনো অনেক সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে যারা বেতন-ভাতার বাইরে একটি পয়সাও ভিন্নভাবে ইনকাম করেন না। তারা মানবেতর জীবনযাপন করেন। আবার অনেকেই নিরুপায় হয়ে সংসারের চাপে উপরি ইনকামের পথ বেছে নেন। আজকের লেখা মূলত আদালতের সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কি কি বৈষম্যের জাঁতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা।

আগেই বলেছি বিচারক ও সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাধ্যমে অধস্তন আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয় হাইকোর্ট বিভাগের অনুমতিক্রমে; সহায়ক কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে থাকেন আইন মন্ত্রণালয়, বদলি করে থাকেন হাইকোর্ট বিভাগ এবং অধস্তন আদালতের সহায়ক কর্মচারীদের নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করে থাকেন জেলা জজ। সহায়ক কর্মচারীদের আন্তজেলা বদলি করেন হাইকোর্ট বিভাগ।

আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বেতন ভাতাদি পরিশোধ করা হলেও নিয়ম কানুন অনুসরণ করা হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। বিচার বিভাগের জন্য পৃথক পে-স্কেল করা হলেও সহায়ক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উক্ত পে-স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এক কথায় বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের পর বিচারকদের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে, বিপরীতে বঞ্চিত করা হয়েছে সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। বিচারকদের জন্য বিচারিক ভাতা থাকলেও বিচার সহায়ক কর্মচারীদের জন্য উক্ত ভাতা নেই। এমনিভাবে নানা প্রকারের বৈষম্যের জাঁতাকলে নিম্ন আদালতের কর্মচারীরা।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার পর থেকেই বিচার বিভাগের একটা অংশ বৈষম্য ও বঞ্চনায় গুমরে কাঁদছে। বর্তমানে ও বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে স্বীকৃতির দাবিসহ তিন দফা দাবিতে এই কর্মচারীরা সংগঠিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে।

বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও কুষ্টিয়ার জেলা জজ আদালতের স্টেনোগ্রাফার তারিক আহাম্মেদ রিংকু বলেন, দেশে ২০ হাজারের মতো আদালত-সহায়ক কর্মচারী ত্রিমুখী কর্তৃত্বের এ জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন।

আদালতের কর্মচারীরা বিচারিক কাজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অতি আবশ্যক হলেও পরিতাপের বিষয়, এসব কর্মচারীদের বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তিনি আরো বলেন, অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বাংলাদেশ বিচার বিভাগের সহায়ক কর্মচারী হিসেবে গণ্য করে বেতন ভাতা নির্ধারণ করতে হবে; শিক্ষাগত যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদোন্নতি ও উচ্চতর গ্রেড দিতে হবে; একই সঙ্গে অধস্তন আদালতের সব কর্মচারীর জন্য এক ও অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে। দীর্ঘদিন কর্মচারীরা সরকারের কাছে এসব দাবি জানিয়ে আসছে।

তিনি আরো জানান, আদালতের এসব কর্মচারীর বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে অন্যান্য সুবিধাও খুব একটা নেই। একই যোগ্যতার অন্য দপ্তরের একজন কর্মচারী তাদের দ্বিগুণ বেতন পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সবাই আপ্যায়ন ভাতাসহ পদোন্নতি ও যাবতীয় সুবিধা সমহারে পেয়ে থাকেন। পুলিশ বিভাগেও কর্মরত কনস্টেবল থেকে শুরু করে অফিসাররা উভয়েই ৩০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা, রেশন, পদোন্নতিসহ যাবতীয় সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীদের মধ্যে বিপরীত বৈষম্য রয়েছে। আবার বিচারকরা স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর পাশাপাশি দেওয়ানি আদালতের অবকাশকালীন (ডিসেম্বর মাস) ফৌজদারি আদালতে দায়িত্ব পালনের জন্য এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ ভাতাপ্রাপ্ত হন এবং প্রতি মাসেই বিচারিক ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ৩০ শতাংশ প্রাপ্ত হন। কিন্তু অবকাশকালীন ছুটিতে এসব কর্মচারী দায়িত্ব পালন করলেও তারা বিচার সহায়ক ভাতা পান না। এমনকি চৌকি আদালতের বিচারক চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন। কিন্তু উক্ত চৌকি আদালতে কর্মরত সহায়ক কর্মচারীরা চৌকি ভাতাপ্রাপ্ত হন না। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে সমন জারির সাথে সম্পৃক্ত জারিকারকদের সমন জারির জন্য দূর-দূরান্তে যেতে হয়। তাদের টিএ দেয়ার নিয়ম থাকলেও বর্তমানে এই খাতে বরাদ্দ না পাওয়ায় কোনো ধরনের টিএ/ডিএ প্রদান করা হয় না। বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীদের পদণ্ডপদবির নাম পরিবর্তন পূর্বক উচ্চতর স্কেলে পদায়ন করা হলেও বিচার বিভাগে কর্মরত সহায়ক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। দিন দিন মামলার পরিমাণ অধিক হওয়ায় দিনের কাজ দিনে শেষ করার জন্য সহায়ক কর্মচারীদের প্রতিদিন অতিরিক্ত ৩-৪ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে হয়। এ বিষয়েও কোনো ওভারটাইম বা ভাতা প্রদান করা হয় না।

আদালতের কর্মচারীরা বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে বিবেচিত হন। কিন্তু বেশিরভাগ কর্মচারী আর্থিকভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এক সময় আদালতের উচ্চমান সহকারী (সেরেস্তাদার) এমন মর্যাদা পেতেন যে তিনি অফিসার্স ক্লাবের সদস্য হতে পারতেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ের জাতীয় বেতন-স্কেল হতে দেখা যায়, বর্তমানে কিছু সংখ্যক দ্বিতীয় শ্রেণির পদ যেমন- উপ-সহকারী প্রকৌশলী, অডিটর, সরকারি মাধ্যমিক স্কুলের সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল সেরেস্তাদারের নিচে ছিল। যা বর্তমানে সেরেস্তাদারের বেতন স্কেলের দ্বিগুণ। অপরদিকে বিচার বিভাগের কর্মচারীদের পদোন্নতির যেটুকু ব্যবস্থা রয়েছে, তার চেয়ে ব্লক পদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে বিচার বিভাগের ডিজিটালাইজেশনের কার্যক্রম চলমান থাকলেও প্রযুক্তিগত সহায়তার জন্য জনবল অপ্রতুল। বিচার বিভাগীয় বাতায়ন ও মামলার কার্যতালিকার কার্যক্রম দৈনন্দিন হালনাগাদ করতে প্রযুক্তিনির্ভর জনবল আবশ্যক। তা না হলে ডিজিটাইলেজশনের এই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে। পদোন্নতির ধারা উন্মোচনসহ নতুন পদ সৃজন না করায় অধিকাংশ কর্মচারীদের পদোন্নতির পদ রুদ্ধ। অন্যান্য দপ্তরে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে পদোন্নতির জন্য যেখানে ফিডারপদে ৫ থেকে ৭ বছরের চাকরি অভিজ্ঞতায় পদোন্নতির সুযোগ আছে সেখানে অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের উক্ত পদের জন্য ২০ থেকে ২২ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অনেকেরই পদোন্নতির আগে চাকরির বয়সসীমা শেষ হয়ে যাচ্ছে। আক্ষেপ ও হতাশা নিয়ে বৈষম্যের শিকার অধস্তন আদালতের কর্মচারীরা অবসরে যাচ্ছেন। দ্রুততম সময়ে নিয়োগবিধি সংশোধনের অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা থাকলেও নিয়োগ বাণিজ্যসহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় ব্যস্ত আইন মন্ত্রণালয় দীর্ঘ ৯ বছরেও অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের নিয়োগবিধি সংশোধনের কাজ চূড়ান্ত করতে পারেনি। শুধু আশ্বাসের বাণী শুনিয়েছেন, দীর্ঘদিনেও তা আলোর মুখ দেখেনি। কর্মচারীদের দাবি বাস্তবায়নে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য (১) গত ২৯.০৭.২০১৯ খ্রি. যথাযথ কর্তৃপক্ষের (নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে মাননীয় সচিব, আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রাণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়; (২) বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ গত ১৮.০৯.২০১৯ খ্রি. আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবকে তিন দফা দাবি বিষয়ে অবগত করানো হয়; (৩) গত ১১.১১.২০১৯ খ্রি. ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর তিন দফা দাবি সম্বলিত স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। উক্ত তিন দফা দাবি দ্রুত বাস্তবায়ন করা না হলে কর্মবিরতিসহ অচিরেই কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বর্তমানে পরবর্তীত পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরির অনেকেই নানারকম দাবি-দাওয়া তুলছেন। এর অধিকাংশই প্রমোশন না হওয়া, বেতন বৃদ্ধি করা সংক্রান্ত। যেহেতু আমি আদালতের একজন কর্মচারী তার জন্য বিচার বিভাগের কথাই বললাম।

কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উক্ত দাবিসমূহ থেকেও সবচেয়ে যৌক্তিক দাবি হওয়া উচিত- প্রথমত, নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত সময় কাজ করলে ওভারটাইম চালু করা। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর বিধান অনুযায়ী কোনো শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দিন বা সপ্তাহে আইনের অধীন নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত সময় কাজ করলে, অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য নির্ধারিত বেতনের দ্বিগুণ হারে ভাতা (ওভারটাইম) পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু, একজন চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে অন্যান্য সব বিষয় শ্রম আইন অনুযায়ী পরিচালিত হয়ে থাকলেও ওভার টাইমের প্রচলন নেই। ওভার টাইম চালু হলে, বাধ্যতামূলক লেট সিটিংও ঘুষ প্রথা কমে আসবে বলে আশা করা যায়। দ্বিতীয়ত, বিচার বিভাগ শুধু হাইকোর্ট আর নিম্ন আদালতের অফিসার নিয়ে গঠন করা হয়েছে এমনটি নয়, স্টাফ ব্যতীত পরিপূর্ণভাবে বিচারকাজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই বিচারকদের পাশাপাশি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করত সকল বৈষম্য দূর করে নতুন এক বিচার বিভাগ তৈরি করতে হবে। তৃতীয়ত, বিচার বিভাগের নিয়োগ পদ্ধতির পরিবর্তন করে আধুনিক এবং দক্ষ জনশক্তি দিয়ে বিচার বিভাগের পরিবর্তন ঘটানো।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত