ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গ্রামবাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য

তালপাতার পেখে

মো. মনিরুল ইসলাম
তালপাতার পেখে

তালপাতার তৈরি বর্ষাতি; গ্রামবাংলায় পেকী, পেখে বা পাখিয়া নামে একসময় খুব পরিচিত ছিল। তিন-চার দশক আগেও গ্রামীণ কৃষক সমাজে বর্ষাকালের নিত্য অনুষঙ্গ ছিল এই পেখে। ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে আর ডোঙার মতো পেখে মাথায় দিয়ে চাষিরা চাষ করছেন, এ ছিল ধানের জমিতে খুব পরিচিত দৃশ্য। এখন এ চিত্র একবারেই বিলুপ্ত। পলিথিনের ব্যবহার, রংবাহারি ছাতা অথবা আধুনিক রেইনকোর্টের আড়ম্বরে মানুষের মাথা থেকে সরে গেছে একসময়ের মাথায় তোলা তালপাতার পেখে। কেবল তালপাতার পেখে নয়, একসময় গ্রামীণ জন-জীবনে তালবিলাসী অনেক তালবাহানাই ছিল। গরমে তালপাতার পাখা, বিষন্ন বিকালে তালপাতার বাঁশি, পণ্ডিতের বারান্দায় কঞ্চির কলমে তালপাতায় হাতেখড়ি, মাটির ঘরে তালপাতার ছাউনি, খাবার থালায় তালের শাঁস, তালমিছরি, তালের বড়া, টইটম্বুর পানিতে তালগাছের ডিঙি- সবই ছিল তালকেন্দ্রীক। পেখে বা পেকী শব্দটি এসেছে ‘পাখা’ বা ‘পাখনা’ থেকে। যার অর্থ হলো- পাখির ডানা। পেখে কারিগরদের মতে, পেখে নিচের দিকটা অনেকটাই পাখির ডানার মতো বা পেখমের মতো ছড়ানো। তাই এই নামকরণ। অঞ্চলভেদে কেউ কেউ পেখিয়াও বলে থাকেন।

তালপাতা ও বেত বা বাকলের দড়ি দিয়ে বানানো হয় পেখে। এটি তৈরি বেশ সময় এবং শ্রমসাধ্য কাজ। প্রথমে তালগাছ থেকে তালপাতা কাটতে হয়। একাজ প্রায় এক মাস ধরে চলতে থাকে। এরপর পাতা বাছাই করে পুকুর বা জলাশয়ে পচাতে হয়। সেই সঙ্গে তালপাতার বল্গা থেকে হালকা ফিতের মতো চোঁচ বা ছিলা তৈরি করতে হয়। পাতা ঠিকভাবে পচার পরে সেগুলো বিন্যাস করে ওই ছিলা দিয়ে গাঁথা হয়। পেখে দেখতে হয় অর্ধেক নৌকা বা ডোঙার মতো। পাতা যত লম্বা হবে এবং মাথার কাছে পেখের বুনন যতো সুন্দর হবে ততই আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে পেখেটি। পাতার ওপর পাতা সাজিয়ে এর নির্মাণশৈলী এত সূক্ষ্ম যে এক ফোঁটা পানিও তালপাতা চুঁইয়ে ভেতরে ঢুকতে পারে না। কৃষক বা পথচারীর মাথা ও পুরো পিঠকে বর্ষা থেকে রক্ষা করতে পারে পেখে। বাতাসে উড়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে পিঠ বা ঘাড় বরাবর বেঁধে রাখার একটি উপকরণ এর সাথে সংযুক্ত থাকে।

একসময় পেখে আমাদের কুঠির শিল্পের অন্তর্ভুক্ত ছিল। গ্রামের একশ্রেণির কারিগর গরমে হাতপাখা আর বর্ষায় পেখে তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্ষার প্রারম্ভেই কারিগররা তালগাছের মালিকদের কাছ থেকে তালপাতা কিনে প্রক্রিয়া শুরু করতেন। তাদের সুনিপুন হাতে গণ্ডায় গণ্ডায় তৈরি হতো ধূসর রঙের পেখে। এরপর হাটে হাটে উঠে যেত পেখের পসরা। বর্ষা এলেই একসময় এই পেখে কেনার জন্য গ্রামে গ্রামে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। বিশেষ করে চাষি পরিবারগুলোতে এর কদর ছিল খুব। বর্ষার আগে আগে পেখে কিনে ফেলত চাষিরা। বর্ষকাল শেষে পেখেটি রোদে শুকিয়ে মাটির বাড়ির দেয়ালে বা দুয়ারে খুঁটিতে পেরেকে ঝুলিয়ে রাখা হতো। একটি পেখে পাঁচ থেকে দশ বছরও ব্যবহার করা যেত।

পেখে আজ উৎপাদন হিসাবে ব্রাত্য। জীবিকার দায়ে পেখের কারিগররা হয়তো হয়ে উঠেছে ছাতার মিস্ত্রি। গৃহস্থালির কাজে নিত্যপ্রয়োজনীয় শিল-পাটার জায়গা যেমন দখল করেছে বেলেন্ডার, তেমনি পেখের জায়গা দখল করেছে ছাতা বা রেইনকোর্ট। ফলে এ প্রজন্মের কাছে প্রায় অপরিচিত হয়ে উঠেছে গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্যবাহী পেখে। এমনকি লোকশিল্পের উপাদান হিসেবে সংগ্রহশালায়ও পেখে দেখা যায় না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত