ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাগৃতির সোপান নজরুল

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট
জাগৃতির সোপান নজরুল

২৭ আগস্ট ১৯৭৬। আজকের যুব প্রজন্ম হয়তোবা জানে না যে, বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন হয়েছিল এই দিনটিতে, আমরা হারিয়েছি আমাদের অতি প্রিয় একজনকে। কে সেই প্রিয়জন? তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি নামেই অধিক পরিচিত যদিও তিনি ছিলেন অনন্য সাধারণ এবং বহুমুখী প্রতিভার ভাণ্ডার। কেবল মাত্র ‘বিদ্রোহী কবি’ আখ্যা দিলে তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার করা হবে না। তিনি ছিলেন মানুষের কবি। মানবমনের চিরন্তর প্রেম-বিরহ, ব্যথা-প্রাপ্তি, আধ্যাত্মিকতা, দেশপ্রেম, আকুলতাণ্ডব্যাকুলতা সবকিছুই তার সৃষ্টির উপজীব্য। তারই ভাণ্ডারীকৃত সম্পদ দিয়ে তাকে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করার জন্যই এই লেখার অবতারণা।

পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার অন্তর্গত চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৫ মে। পূর্বনিবাস ছিল পাটনার হাজীপুর অঞ্চলে। মোঘল সম্রাট শাহ্ আলমের সময়কালে নজরুলের পূর্বপুরুষরা চলে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। বরণ্যে এই কবির পিতা কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। সহোদর তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে নজরুল ছিলেন পিতা-মাতার মধ্যম পুত্র। কবির জ্যেষ্ঠ সহোদর সাহেবজানের জন্মের পর আরো চার ভাই জন্মেছিলেন যদিও এদের অকাল মৃত্যু হয়। পরিবারে এই দুঃখের সময়ই মাতা জাহেদা খাতুনের কোল আলো করে এসেছিলেন ভাবীকালের লোকপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাই ঘরে নজরুলের আদরের নাম ছিল দুখু মিঞা। যেমন নাম দুখু মিঞা তেমনি নজরুলের জীবনেও অনেক দুঃখের আঁধার ছিল। জীবনের প্রারম্ভেই আল্লাহ তাকে যে দুঃখের মধ্যে নিক্ষেপ করেছিলেন সেই দুঃখের অভিজ্ঞতাই নজরুলের লেখনীকে আরো ক্ষুরধার করে লেখার পথের পাথেয় হয়েছিল।

ওই সমসাময়িক যুগে বাংলায় লেটো গানের খুব প্রচলন ছিল। লেটো গান হলো রাঢ় বাংলার কবিতা গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য। প্রত্যেকটি লেটো দলই এক একজন ওস্তাদের পৌরোহিত্যে চলতো। এই সময় চুরুলিয়া অঞ্চলে লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন কাজী বজলে করিম। বজলে করিম আরবি এবং উর্দু ভাষায় বিশেষ জ্ঞান রাখতেন এবং এসব ভাষার সমন্বয় ঘটিয়ে কবিতা ও গান রচনা করতেন। বজলে করিমের এই মিশ্র ভাষার গান নজরুলকে বালক অবস্থায় বিশেষ প্রভাবিত করেছিল। উত্তরকালে নজরুলের লেখনী থেকে জন্ম নেয় আরবি ও উর্দুমিশ্রিত বাংলা সৃষ্টি। নজরুলের ভাবের সঙ্গে আরবি ও উর্দুভাষার শব্দ চয়ন বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জুন দৌলতপুর থাকাকালীন নার্গিস নাম্নী মহিলার সঙ্গে নিকাহ সম্পন্ন হয়, যদিও এই বিবাহ স্থায়িত্ব লাভ করেনি। কারণ শোনা যায় বিবাহের রাত্রেই কবি দৌলতপুর ত্যাগ করেন। নার্গিস নজরুল বিবাহ বিচ্ছেদ কাহিনীটি আজও সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত।

দৌলতপুর ত্যাগ করে কবি কুমিল্লার কান্দিরপাড়ে সেনগুপ্ত পরিবারে অবস্থান করেন ১৯ দিন। ১৯ দিনে কবি রচনা করেন ‘পরশপূজা’, ‘বিজয় গান’, ‘পাগল পথিক’, ‘মনের মানুষ’, ‘বন্দি বন্দনা’, মরণপণ ইত্যাদি কবিতা ও গান। এই বছরই জুলাই মাসে কবি কলকাতা ফিরে আসেন এবং রচনা করেন বিখ্যাত সেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। মাত্র বাইশ বছরের তরুণের এই বলিষ্ঠ রচনা বাংলার সুধীমণ্ডলীর দৃষ্টি আকর্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিভা নিয়ে মনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দেয়।

১৯২২ সালে নজরুল পুনরায় কুমিল্লায় যান এবং ব্রাহ্ম সমাজে বিশ্বাসী প্রমিলা সেনগুপ্তের সঙ্গে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। এই বছরেই ১২ আগস্ট নজরুলের জ্বালামুখী পত্রিকা ‘ধূমকেতু’ আত্মপ্রকাশ করে। ২২ সেপ্টেম্বর ধূমকেতু পূজা সংখ্যায় প্রকাশিত হয় প্রচ্ছন্ন রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের রোষাগ্নিতে পড়েন কবি। ধূমকেতুর উক্ত সংখ্যাটি বাজেয়াপ্ত করে নজরুলের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ১৯২২ সালের ২৩ নভেম্বর নজরুলকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করে কলকাতা আনা হয়। ১৯২৩ সালে ৭ জানুয়ারি নজরুল আত্মপক্ষ সমর্থন করে আদালতে যে জবানবন্দি দেন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তা ‘রাজবন্দির জবানবদি’ নামে সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। জবানবন্দিটি ছিল এইরূপ ‘আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজ বিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত। ...আমি কবি, আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য। অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে সৃষ্টিকর্তা সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা সৃষ্টিকর্তার বাণী। সে বাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার সৃষ্টিকর্তার হাতের অগ্নি মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে... ১৬ জানুয়ারি প্রকাশিত বিচারের রায়ে নজরুল এক বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। সশ্রম শব্দটি এখানে বিশেষভাবে বিবেচ্য কারণ ব্রিটিশ জমানায় কোনো ভারতীয় যদি সশ্রম কারাবাস করেন (বিশেষভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের) তবে তা কত কঠোর ছিল তা সহজেই অনুমেয়।

১৯৩০ সালে ‘প্রলয় শিক্ষা’ কাব্যগ্রন্থটিকে রাজদ্রোহী বিবেচনা করে ব্রিটিশ সরকার এক বছরের সঙ্গে আরো ছয় মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন কবিকে। যাদের মরণপণ লেখনির বিনিময়ে ভারত আজ স্বাধীন হয়েছে কবি তাদের অন্যতম। এই সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তার ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলের নামে উৎসর্গ করেন। কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র একটি পত্র লেখেন ‘একজন সত্যকার কবি। রবিবাবু ছাড়া বোধ হয় এমন কেউ আর এতবড় কবি নাই।’

১৯২৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর নজরুল যখন তার কারাদণ্ডের মেয়াদ সম্পূর্ণ করে মুক্ত হলেন তখন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ বিশাল জনসভায় শহরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে যেভাবে অভূতপূর্ব সম্মান প্রদর্শন করেন তা বোধহয় কবিগুরু ছাড়া জীবিতাবস্থায় আর কোনো কবির ভাগ্যে জোটেনি।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ এপ্রিল এক শুভক্ষণে কুমিল্লার প্রমীলা সেনগুপ্তের সঙ্গে তার প্রণয় পরিণয়ের রূপ নেয়, বিবাহের পর ১৯২৫ সাল থেকে নজরুল প্রত্যক্ষভাবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগদান ছাড়াও আমজনতার মধ্যে স্বাধীন ভারতের বীজ বপনের উদ্দেশ্য সহজ এবং সরল ভাষায় দেশপ্রেমের গান রচনা করেন। বলা বাহুল্য নজরুলের এসব স্বদেশী গান জনগণকে স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন এবং স্বদেশী দলে যোগদানের অনুপ্রেরণা প্রচণ্ডভাবে জাগিয়েছিল। কথায় আছে ‘অসির চেয়ে মসি বড়’। তাই বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে হাজার অসির কাজ নিজের লেখনির মসি দিয়ে করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একান্ত ছিলেন নজরুল। ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত ১৯২৫ সালের মে মাসে কংগ্রেস অধিবেশনে তিনি স্বদেশী গান গেয়ে অনেক সুপ্ত ভারতবাসীকে জাগিয়েছিলেন। এই সময় তিনি মেদিনীপুর, হুগলি, বাঁকুড়া এবং বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন সভা সমিতিতে যোগদান করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সদস্য হওয়া ব্যতীত ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এই দল মূলত কৃষক ও শ্রমিকের স্বার্থে গঠিত হয়েছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন বাংলার রাজনীতিতে হিন্দু মুসলমান ঐক্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব যা নজরুলের চিরকালের স্বপ্ন ও সাধনা ছিল। নজরুল হুগলিতে থাকাকালিন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জুন দেশবন্ধুর মৃত্যু হয়। এই মৃত্যু কবির মনে দারুণ আঘাত দেয়। ১৭ জুন দেশবন্ধুর শ্রদ্ধার্ঘ্য স্বরূপ রচনা করেন ‘অর্ঘ্য’ শীর্ষক গান। এই গান শবাধারে মালার সঙ্গে অর্ঘ্য হিসাবে দেয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে রচনা করেন ‘চিত্ত নামা’ কাব্যগ্রন্থ।

উপর্যুক্ত ঘটনা থেকে নজরুলকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানী ও দরদী রাজনীতিবিদ হিসাবে আখ্যায়িত করা যায়। নজরুলের চরিত্রের আরো কয়েকটি বৈশিষ্ট্য যেমন গভীর আধ্যাত্মিকতাবাদ এবং ধর্ম সমন্বয়কারী রূপও আমাদের কাছে ধরা দেয়। এসবের কিঞ্চিৎ বিশ্লেষেণ করতে হলে আমাদের কবির জীবনের শৈশব-পরবর্তী অধ্যায়ে যেতে হবে।

নজরুলের বয়স যখন দশ, তখনই কাজী ফকির আহমদের মৃত্যু হয়। বাবার অকাল প্রয়াণ নজরুলকে জীবনের কঠোর সংগ্রামকে আহ্বান করতে হয়েছিল। নজরুল তখন সবেমাত্র গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরিবারের ভরণপোষণের ভার লাঘবের জন্য এই মক্তবেই শিক্ষকতা করতে নিয়োজিত হন। মক্তবে শিক্ষকতা করার সঙ্গে সঙ্গে হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক ও মসজিদের মুয়াজ্জিনের কাজ করতে থাকেন। এরই ফলস্বরূপ তিনি ইসলাম ধর্মের মৌলিক আচার যেমন রোজা পালন, নামাজ পড়া এবং পবিত্র কোরআন শরিফ পাঠ ইত্যাদির সঙ্গে ঘনিষ্ট হতে থাকেন। ধর্মের মাধ্যমে পবিত্রতায় বীজের অঙ্কুরোদগম হয় নজরুলের জীবনে। নিজের ধর্মের পবিত্রতাকে রক্ষা করেও হিন্দু ধর্মের গাঢ় ভাবের রাজ্যে তার বিচরণ ছিল। সেই সঙ্গে তার কীর্তনাঙ্গের বিভিন্ন ভাবের হরিগুণগানের গানগুলোও আধ্যাত্মিক জগতের এক সম্পদ স্বরূপ। এদিক দিয়ে বিচার করলে নজরুলকে এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব বলা চলে। তাই ১৯৪০ সনের ২৪ ডিসেম্বর কলকাতা মুসলিম ছাত্র সমাজের অধিবেশনে কবি বলেছিলেন, ‘আপনারা জেনে রাখুন, আল্লাহ ছাড়া আর কিছুর কামনা আমার নেই।’

সৃষ্টিরাজির ধারাবাহিকতার মধ্যেই নজরুলের জীবনে গণসংবর্ধনার আবহ চলতে থাকে। ১৯২৬ সাল থেকেই কবি পরিবারসহ কৃষ্ণনগরে থাকতে শুরু করেন এবং এই বছরই কবির দ্বিতীয় পুত্র বুলবুরের জন্ম হয়। নজরুলের কৃষ্ণনগরের দিনকয়টি ছিল দুঃখ, কষ্ট, দারিদ্র্য এবং অভাব অনটনে পূর্ণ। এর মধ্যেই ‘খালেদ’- এর মাতা কবিতার জন্ম হয়, বিভিন্ন ধরনের গানও সুর স্বরলিপি করে প্রকাশ করেন। ১৯২৮ সালে নজরুলের শ্রেষ্ট কবিতা গানের সংকলন ‘সঞ্চিতা’ প্রকাশ পায়। নজরুল সাহিত্যের আবহাওয়া তখন উত্তপ্ত। এদিকে অকুণ্ঠ প্রশংসা অন্যদিকে মুখরিত নিন্দা। কিন্তু পৃথিবীর কালো ধোঁয়া তো চাঁদকে ধরতে পারে না। বাধা যেন নজরুলের জনপ্রিয়তাকে আরো তীব্র করে তুলল। ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর অ্যালবার্ট হলে নজরুলকে গণসংবর্ধনা জানানো হয়। যে অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করেন আচার্য্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেন ব্যারিস্টার এস ওয়াজেদ আলি। কবিকে উপহারস্বরূপ দেয়া হয় সোনার দোয়াত কলম।

১৯২৫ সালে নজরুলের গানের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করা হয় এইচএমভি-তে, ১৯২৯ থেকে নজরুল গ্রামোফোন কোম্পানিতে কম্পোজার নিযুক্ত হন। ১৯৪০ সালে কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হন এবং লুপ্তপ্রায় রাগের উপর ভিত্তি করে নতুন নতুন রাগ সৃষ্টি করে সংগীত রচনা শুরু করেন, সেগুলো আকাশবাণীর ‘নবরাগ মালিক’ অনুষ্ঠানে প্রচার হতো। এই অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে আকাশবাণীর সংগীত বিভাগকে সমৃদ্ধ করেছিল। আকাশবাণী ছাড়াও সেই সময় কবিমঞ্চ, চলচ্চিত্রে সংগীত রচনা ও সুর সংযোজন করতে থাকেন।

১৯৩০ সালে কবির দ্বিতীয় তথা প্রিয়পুত্র বুলবুল বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। শোকে মুহ্যমান কবি তখন আধ্যাত্মিক রাজ্যে স্বেচ্ছা নির্বাসন নেন। এই মানসিকতা সজ্ঞান অবস্থার পূর্ব পর্যন্ত কবির মনে ধ্রুবতারার মতো স্থির এবং উজ্জ্বল ছিল। ১৯৪০ সালে নজরুল যখন বেতার, মঞ্চ, গ্রামোফোন কোম্পানি এবং চলচ্চিত্রের উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব তখনই স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং তার নিম্নাঙ্গ অবশ হয়ে উত্থানশক্তি রহিত হয়। ১৯৪২ সনে কবি পিকস ডিজিস নামক এক দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে যান। ১৯৬২ সালে সুদীর্ঘ রোগ ভোগের পর ৩০ জুন কবিপত্নী প্রমীলা নজরুলসহ দুই পুত্র কাজী সব্যসাচী ইসলাম এবং কাজী অনিরুদ্ধ ইসলামকে বর্তমান রেখে ইহলীলা সম্বরণ করেন। তবে তিনি অসুস্থ অবস্থায়ও আমৃত্যু স্বামীর সেবা করে গেছেন। ১৯৪২ সাল থেকেই কবি হঠাৎ নীরব হয়ে যাওয়ায় বাংলা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো তা বাংলা ভাষা প্রেমিক মাত্রেই উপলব্ধি করতে পারবেন। ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণের প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারত সরকার বাংলার প্রিয় কবিকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার অনুমতি দেয়। ১৯৭২ সনের ২৪ মে অর্থাৎ কবির জন্মদিনে কবিকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। পর দিন দেশব্যাপী বিপুল আনন্দ এবং উল্লাসের মধ্যে কবির ৭৩তম জন্মদিন পালিত হয়। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিকে রাজকীয় সম্মান প্রদান করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুলাই থেকে কবির স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকে তারপর এক বছর অসুস্থতার টানাপড়েন কাটানোর পর সবার চেষ্টা ব্যর্থ করে ১৯৭৬ সনের ২৯ আগস্ট বহু দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ-উল্লাস, সমাদর-অনাদরের সাক্ষী চিরদিনের জন্য পরম পিতা আল্লাহর কোলে ঠাঁই নিলেন। এই দিনই পড়ন্ত বেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কবির ইচ্ছানুসারে মসজিদের পাশে কবিকে সমাহিত করা হয়। ১৯৪২-১৯৭৬ এই সুর্দীঘকাল আমরা কবিকে পেয়েও তার অমর সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত রইলাম। এই ক্ষতির পরিমাপ করা যাবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত