ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শেখ হাসিনার পতন কি ভূ-রাজনীতি, না স্বেচ্ছাচারিতা?

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, লেখক : কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
শেখ হাসিনার পতন কি ভূ-রাজনীতি, না স্বেচ্ছাচারিতা?

বাংলাদেশের পলাতক হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ তুলেছেন, দাবি করেছেন যে, তার পদ থেকে অপসারণ সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার অংশ। কিন্তু হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে, এমন অভিযোগ অস্বীকার করে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জ্যঁ-পিয়েরে গত সোমবার প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেন, এসবের পেছনে আমরা জড়িত নই। মার্কিন প্রশাসনে জড়িত থাকা নিয়ে যে কোনো প্রতিবেদন বা গুঞ্জন ডাহা মিথ্যা, একদমই সত্য নয়। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব অংশে অবস্থিত, বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল প্রাচীর দ্বীপ এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। এটি কক্সবাজার-টেকনাফ উপদ্বীপের প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিম উপকূল থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।

আওয়ামী লীগ সূত্রে আরো বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশে এই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মূল কলকাঠি নাড়ছেন ডোনাল্ড লু, যিনি যুক্তরাষ্ট্রর দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লু মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ সফর করেন এবং ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার সফরের পরপরই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা করেছিল, দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে। ঢাকা সফরের পর লু ভয়েস অব আমেরিকাকে খোলাখুলিভাবে বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা আমাদের জন্য অগ্রাধিকার। আমরা সুশীল সমাজ এবং সাংবাদিকদের গুরুত্বপূর্ণ কাজকে সমর্থন করে যাব এবং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমর্থন অব্যাহত রাখব, যেমনটি আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করি। তবে জানুয়ারিতে বাংলাদেশে নির্বাচনে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছিল যে, মার্কিন কূটনীতি কৌশল পরিবর্তন করছে এবং নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা করছে। মস্কো এবং বেইজিং তা সত্ত্বেও অ-হস্তক্ষেপের অবস্থান নিয়েছিলো। তবে এটি সঠিক যে, রাশিয়া ও চীন উভয়ই মার্কিন অভিপ্রায় নিয়ে চিন্তিত ছিলো।

রাশিয়ার বাংলাদেশে অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়া মনে করে, একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থার জন্য অংশীদার ঢাকার শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন হলে চীন ও ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থ সরাসরি প্রভাবিত হবে। এখন দেখার বিষয় হলো ওয়াশিংটনের পরিকল্পনায় ঢাকায় এই শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ‘ভারতকেন্দ্রিক’ কি না? বর্তমানে ভারত পশ্চিম ও পূর্বে মার্কিন প্রভাবের অধীনে থাকা দুটি বন্ধুত্বহীন শাসনের দ্বারা আবদ্ধ হয়ে আছে। এটি এমন সময়ে ঘটছে যখন ভারত সরকারের স্বাধীন বিদেশি নীতি ও কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের একগুঁয়েমি যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে প্রভাবিত করেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি ৮ আগস্ট ঢাকায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিয়োগের বিষয়ে ফোন কলের মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।

ভারতীয়রা যখন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে ‘চীনের প্রতি পাল্টা’, কিছু বৈষয়িক নীতি গ্রহণের চেষ্টা চালাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজেদের স্বার্থে ভারত-চীন উত্তেজনাকে কাজে লাগাতে চাইছে, যা তাদের আঞ্চলিক আধিপত্যের ভূ-রাজনৈতিক এজেন্ডা। হাসিনার পতন বাংলাদেশের বাইরেও ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। কারণ বাংলাদেশের ভারতের সাথে ৪০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত, উত্তর-পূর্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অন্য দেশটি হলো মিয়ানমার। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের মিয়ানমারের অংশটি হলো অশান্ত আরাকান, যেখান থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা পালিয়েছে। মিজোরাম থেকে ৪৮৪ মিলিয়ন ডলার কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট চীন এবং রাখাইন রাজ্যের মধ্য দিয়ে আরাকান উপকূলে সিত্তে বন্দরে যাওয়ার কারণে, এটি ভারতের জন্যও একটি আগ্রহের বিষয়। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। তবে পাকিস্তানেরও প্রভাব রয়েছে। আইএসআইও (পাকিস্তান) দীর্ঘকাল ধরে হাসিনার শাসনের বিরোধিতা করে আসছে। মনে হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং পাকিস্তান-আইএসআই’র সমন্বয়ে গঠিত ত্রয়ী হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে অস্থিরতা ঘটাতে সফল হয়েছে, যার ফলে তিনি পদত্যাগ করেছেন এবং ঢাকা ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাসিনার কারণে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করেছিলো। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের সাতজন প্রাক্তন ও বর্তমান উচ্চণ্ডস্তরের কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে, একটি রাশিয়ান জাহাজ, উরসা মেজর, রূপপুরে বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পণ্য সরবরাহ করতে বাধা দেয়, কারণ জাহাজটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে ছিল। এদিকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে চীন অসন্তুষ্ট ছিল। ভারতের দিকে বাংলাদেশের ঝোঁক আগুনে ইন্ধন দিয়েছে। চীন তার ‘স্ট্রিং অফ পার্ল ‘প্রকল্পের সাথে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধভাবে তার পাশে চেয়েছিল, কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি, তাতে চীনের ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। চীনের সরবরাহকৃত অস্ত্র ও খুচরা জিনিসপত্রের নিম্নমানের বিষয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রকাশ্য নিন্দাও চীনের পক্ষে ভালো হয়নি। হাসিনার সরকারকে শিক্ষা দেয়ার সুযোগ খুঁজছিল চীন। এই সুযোগটি কাজে লাগায় এবং হাসিনাকে চীনে তার সরকারি সফরের সময়, কম সুদের হারে, বাজেটে সহায়তা হিসাবে ৫ বিলিয়ন ডলার দিতে অস্বীকার করে। অপমানিত হাসিনা সেই সফর থেকে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসে।

হাসিনা সরকারের কাছে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার একাধিক সুযোগ ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে হাসিনা স্বৈরাচার খুনির মতন ক্র্যাকডাউন বেছে নিয়েছিলো, যার ফলে ৩০০-১০০০ জন মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে। জনগণের প্রতিবাদ অনুধাবন করে হাসিনা সরকার চাকরি সংরক্ষণের রায় পুনর্বিবেচনার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেছিল, কিন্তু ততক্ষণে সম্ভবত অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো। হাসিনা গত পনেরো বছর ধরে চলা তার সরকারের অত্যাচারের প্রতিবাদে আন্দোলনের অন্তর্নিহিত দীর্ঘদিনের গভীর ক্ষোভ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিল। তার বক্তৃতা, রাজাকারের উল্লেখ এবং পদক্ষেপ সরকারবিরোধী মনোভাবকে আরো শক্তিশালী করেছিল। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এবং অদম্য জনগণের সহিংস বিস্ফোরণ ঘটে। হাসিনাকে পালাতে হয়।

হাসিনা সরকারের পতনে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও পাকিস্তান (আইএসআই) ভূমিকা ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। বাংলাদেশের অস্থিরতার গভীরে নিহিত রয়েছে জটিল ভূরাজনীতি। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক, তার দীর্ঘস্থায়ী মিত্র, টানাপড়েন হতে পারে। পাকিস্তান এবং চীনের মতো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য ঢাকায় তাদের প্রভাব জোরদার করার সুযোগ তৈরি করতে পারে। যার ফলে নয়াদিল্লির কৌশলগত স্বার্থ হুমকির মুখে পড়তে পারে। ৮ জুলাই ২০২৪ হাসিনা চীনের সাথে বেশ কয়েকটি দ্বিপাক্ষিক উন্নয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী চীনকে খুশি করার সম্ভাবনা কম। বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপল-এ বাংলাদেশ ও চীন ২১টি নথিতে স্বাক্ষর করেছে এবং সাতটি নতুন প্রকল্প ঘোষণা করেছে। চীন সফরের আগে হাসিনা ১২ দিনের ব্যবধানে ভারতে দুটি সফর করেন। নবনির্বাচিত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোদির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি ৯ জুন প্রথম নয়াদিল্লি যান। ২১-২২ জুন পর্যন্ত তার দ্বিতীয় সফরে ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, ভাইস প্রেসিডেন্ট জগদীপ ধনখার, প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সাথে বৈঠক অন্তর্ভুক্ত ছিল।

হাসিনা তার মেয়াদ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন এনেছে, ক্ষমতায় থাকা ১৫ বছর একটি দীর্ঘ সময়। কিন্তু সমাজে দ্রুত পরিবর্তন মানসিক চাপ এবং অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অস্থিতিশীলতার দিকে পরিচালিত করেছে। হাসিনা সরকার জনগণের কাছে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। নির্বাচন এমন একটি সুযোগ হতে পারত। কিন্তু জানুয়ারির নির্বাচন বিরোধীদের উপর কঠোর দমন-পীড়নের কারণে তা করতে হাসিনা ব্যর্থ হয়েছে। তাতেও জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ভারতের সমর্থনে হাসিনা ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে কারচুপি করতে পেরেছিলো। যা বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক জনবিক্ষোভের সৃষ্টি এবং ভারতের প্রতি ব্যাপক নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করেছিল। হাসিনা সরকার পররাষ্ট্রনীতি সব সময় ভারতপন্থি ছিল। এদিকে হাসিনার পতনের ফলে, ভারত তার সবচেয়ে সহিংসতাণ্ডপ্রবণ উত্তর-পূর্ব ভারত অঞ্চলে (এনইআর) সন্ত্রাস, বিদ্রোহ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের মতো সমস্যাগুলো মোকাবিলার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা অংশীদারকে হারিয়েছে। হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়ার ভারতের কৌশল ব্যর্থ হয়েছে।

হাসিনার সরকারের পতন ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরো অস্থির করে তুলতে পারে, কারণ উত্তর-পূর্বের বিদ্রোহী এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে হাসিনা-পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামী দলগুলোর সম্ভাব্য উত্থান হতে পারে। পাকিস্তানপন্থি, চীনপন্থি, ভারতবিরোধী এই ইসলামপন্থি দলগুলোর নেতৃত্বে মৌলবাদী শক্তিগুলো নয়াদিল্লির জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশের তিস্তা নদী প্রকল্পে আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে হাসিনা জানিয়ে দিয়েছিলো, ভারতের প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। নতুন সরকার গঠিত হলে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সম্পর্ক ভিন্ন হতে পারে। সুতরাং শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে পতন ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’না হলেও এটি ভারতীয় স্বার্থের জন্য একটি বড় ধাক্কা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত