ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মাটিতেই শেষ পরিণতি!

রাজু আহমেদ
মাটিতেই শেষ পরিণতি!

তুমি যাই করো, যাই বলো আর যেভাবেই চলো- কবরের বুকে ফিরতেই হবে। মৃত্যু তোমায় না ডাকলেও তোমাকেই মুত্যৃকে ডেকে নিতে হবে। ফেরার জন্য তুমিও স্বেচ্ছায় বাধ্য হবে! পার্থক্য হবে শুধু সেটুকুতেই- মুত্যুকে তুমি বরণ করছো নাকি তোমাকে মৃত্যু বরণ করছে। লোকে তোমাকে কীভাবে বিদায় বলছে। ছলচাতুরী করে সত্য আড়াল করতে পারো, ক্ষমতা দিয়ে দুর্বলকে পিষে দিতে পারো কিংবা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে মুড়িয়ে নিতে পারো কিন্তু তোমাকেও একদিন থামতে হবে। বিশাল আয়োজন ছাড়তে হবে। যে মরেছে আর যে মেরেছে কেউ শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারেনি- অতীতে। দৌড়ের শেষ সীমা তুমি দেখতে না পারলেও সেখানে চৌহদ্দি আছে! একসময় বয়সের কাছে হার মানতেই হবে। আমাদের পূর্বপুরুষদের আর কেউ অবশিষ্ট নেই। মাত্র একশ’ বছর আগের কারো দেখা পাও? যাদের রেখে যাওয়া সম্পদ ভোগ করছো তাদের ক’জনকে চেন? নাম জানো কার কার? আমরা এবং ভবিষ্যতের কেউ-ই থাকবো না। রক্ত গরম, শরীরে শক্তি কিংবা অপার ক্ষমতাণ্ড কিছু থাকে না; কিছুই না। এসব দু’দিনের। অপব্যবহার করলেই দুর্দিন আসে। আজ ঠকিয়ে যাচ্ছ, কাঁদিয়ে দিচ্ছ সুযোগে অথচ এসব বিনা কৈফিয়তে যাবে? তাই ভেবেছো! কবরে পাশাপাশি শুয়ে শুয়ে প্রায়শ্চিত্ত করার বাসনা জাগবে অথচ সুযোগ থাকবে না। মাটির চোখ নেই- সে ক্ষমতা চিনবে না। পরকালের যিনি বিচারক- তিনিও কারো অন্যায্য পক্ষ-বিপক্ষ হবেন না। তিনি কাজ খুঁজবেন, আমল পড়বেন। যার কর্ম তাকেই কৈফিয়ত দিতে হবে। প্রত্যককে আলাদা বিবেক দেয়া হয়েছিল, যাতে বলতে না হয় আমি কারো হুকুম/ইচ্ছা না মেনে পারিনি! মাটি মুখিয়ে আছে। দুনিয়ার সব শক্তি গিলে খেয়েও তার পেট ভরবে না। সে তাকিয়ে আছে- তুমি কবে আসবে। দম্ভণ্ডঅহংকারে কিছুটা শোধ সেও নেবে। পানিতে ডুবে মরলেও গন্তব্য মাটি, আগুনে পুড়ে মরলেও গন্তব্য মাটি। কাজেই মাটির ওপর থেকে বিদায়ের আগে খাঁটি হয়ে যেও। মাটিতে হাঁটার সময় পায়ের দিকে চেও। ক্ষণিকের অহমিকা মানুষকে পশুদের থেকেও নিম্নতর করতে পারে। সৎকাজ ক্রিয়াশীলকে বিশাল আকাশের থেকেও আরো বড় করতে পারে। অতীতে এই সুযোগ অনেকেই পেয়েছে এবং ভবিষ্যতেও এমন সৌভাগ্য অনেকেরই হবে।

কাউকে কাঁদানোর আগে একবার একটু হলেও যেন ভাবি। কাউকে কিছু বলার আগে, কারো ক্ষতি করার আগে একটু যেন থামি। কারো আইল ঠেলার আগে, কাউকে বুকভরা ব্যথা দেয়ার হলে কিংবা কারো দুর্দিনের কারণ হলে নিজেকেও যেন সেই কাতারে সামিল করে খানিকক্ষণে নিজেকেও কল্পনাতে রাখি। ব্যথা দিয়ে কেউ ব্যথাহীন থাকেনি। কারো অভিশাপে, কারো দীর্ঘশ্বাসে কিংবা কারো প্রার্থনাতে, অশ্রুসজল কামনাতে কারো সুখ আসেনি। সব পাপ মাফ হয় না। খোদার দু’বেলা নামাজ, না দেওয়া যাকাত কিংবা না রাখা রোজা খোদা অনায়াসে মাফ করে দিতে পারে কিন্তু যে হক মানুষের, যে ব্যথা পরের সেখান থেকে কাউকে অধিকার বঞ্চিত করলে কিংবা কাউকে অহেতুক ব্যথা দিলে তা খোদা অনায়াসে মাফ করবেন এতোটা দিলদরিয়া হওয়ার দায়িত্ব তিনি নেন না! দুনিয়াতে কিছু কিছু মেটান, কারো কারো পতন দেখান তবে অধিকাংশ রেখে দেন হাতে! হাশরে উম্মুক্ত পরিবেশে, সবার সম্মুখে তিনি ঘোরতর লজ্জা দেবেন। পুরস্কার কিংবা দন্ড দেবেন- লিখিত এবং স্পষ্ট ঘোষণা আছে। দুনিয়ায় পার পায় তবে কেউ শেষমেষ ছাড় পায় না। দুনিয়ায় ফাঁকি দেওয়া যায় কিন্তু মাটিতে কেউ মুক্তি পায় না। সকাল-বিকাল মাটি ডাকতেই আছে- আসো, আসো। কেউ আজ সাড়া দিলো আর কেউ পালিয়ে থাকতে চাইল! তবে কারোরই মুক্তি হবে না। আসতেই হবে এবং মাটির বুকে শুইতেই হবে। দু’দন্ড ছাড় দেখে কেউ অগ্রিম দু’দিন পাবে এমন ভাবনা বোকামি। দিন ফুরিয়ে গেলে তোমাকে/আমাকে রেহাই দেবে না। কেউ হাসতে হাসতে মিলিত হবে কেউবা আকুল হয়ে কাঁদবে। কারো রক্ষা নাই। অতীত থেকে যা শিখিনি তাও ঘটবে। অথচ আমাদের জন্য অতীতে অজস্র লার্নিং ছিল। সজাগ ছিলাম কিন্তু সচেতন হইনি। আমিত্ব-বড়ত্বের অহমিকায় কত মানুষকে পুড়িয়েছি, কত মানুষের অধিকার অপদখলে রেখেছি কিংবা ঠকিয়েছি দুর্বৃত্তায়নের অপতৎপরতায়। আজ হেসেছি বলে কালও হাসি থাকবে এই ভাবনা বিফল হতে পারে। কৃতকর্মের রেশ জীবদ্দশাতেই ফেরত আসে। দুর্দিন ফিরিয়ে আনে। দুর্জন ঘিরে ধরে। আচরণের নির্ধারক হোক শাণিত বিবেক। যা করি, যা বলি এবং যা দেখাই তাতে যেন সবার কল্যাণ থাকে। ছাড় দিয়ে হলেও পড়শীর শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। নত হয়ে হলেও সমস্যা মিটিয়ে নিতে হবে। বিনয় যদি না থাকে, বিবেকের ছাপ যদি সিদ্ধান্তে না জুড়ে তবে ছোট ছোট ঝড়ে বিধ্বস্ত হতে হবে। মরে যাওয়ার পরেও যেন দীর্ঘদিন বাঁচি- কর্ম তেমন হোক এবং ধর্ম আপন হোক। লোক দেখানো দরবেশীর মধ্যে যদি ভন্ডামি রাজত্ব করে তবে সব আয়োজন একদিন ভণ্ডুল হবে। মানুষ বোধহয় মরার জন্য বাড়ে! সেই মৃত্যু সম্মানের হোক। মানুষ যেন আমায় ভালো বলে, আমার দুঃখে কেউ না যেন আরো দূরে সরে- আমার কর্ম তেমন হোক। লোকের কল্যাণে পরের আপন হোক। মানুষের প্রকাশ্য কিংবা গোপন পাপ সবাই ভুলে যেতে পারে কিন্তু মাটি ভোলে না। মাটি ও মানুষের যিনি স্রষ্টা তিনি নানাভাবে নানান ক্ষেত্রের সমন্বয় করে কাজের প্রতিদান দেন। ভালো কাজ উত্তম বিনিময় ছাড়া যায় না আবার মন্দ কাজও কর্তাকে ভর্তা না বানিয়ে ছাড়ে না। প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য যিনি সমানভাবে দেখেন তাকে যেন ভয় করি। যে মৃত্যু অনিবার্য তা যাতে কল্যাণের দুয়ার খুলে দেয় তাতে- যা কিছু করা দরকার তা প্রকাশ্যে ও গোপনে হোক। আমি থাকবো না কিন্তু কৃতকর্ম থেকে যাবে এবং তার রেশ আমার উত্তরসূরীদেরকেও ভোগ করতে হবে- এই বিবেক জাগ্রত হলে মানুষের অপরাধ প্রবণতা কমে আসার কথা। দু’দিনের দুনিয়ায় করে যাওয়া আচরণ এবং রেখে যাওয়া আমল চিরস্থায়ী জীবনের পাথেয় ও গন্তব্য হবে- এটা বিস্মরণের মত দুর্ঘটনা কারো জীবনেই না ঘটুক। লোভ যাতে মহৎপ্রাণে পরিণত হতে বাঁধা না দেয় সেই সতর্কতা সর্বত্রই থাকুক। জীবনযাপন সরল হলে সুখ নিকটবর্তী হয়। আমার কর্ম যদি আমাকে নির্ঘুম করে, কথা যদি কাউকে কাঁদায় কিংবা সিদ্ধান্ত যদি কারো কোল খালি করে তবে সে জীবন যেখানেই অবস্থান করুক তা ব্যর্থ। আলোর দিশারী হতে হবে। অন্ধকারের পারদ হওয়ার মাঝে কোনো কৃতিত্ব নাই। মানুষ মানুষের জন্য- এই মন্ত্র যেন কখনো ভুলে না যাই।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত