সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এবং সভ্যতার ক্যান্সার

অলোক আচার্য, লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সাম্প্রতিক সময়ে সংখ্যালঘু এবং তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব আলোচিত হচ্ছে। এই শব্দটি একটি বিস্তৃত শব্দ। সংখ্যায় কম থাকলেই তাকে সংখ্যালঘু বলে। ধর্মের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বলা যায়, বর্ণের ভিত্তিতে সংখ্যালঘু বলা যায় আবার ভাষার ক্ষেত্রেও সংখ্যালঘু রয়েছে। অর্থাৎ সংখ্যায় কম থাকলেই সংখ্যালঘু। এই ধারণাটি একটি সংক্ষিপ্ত এবং অপমানজনক ধারণা। উইকিপিডিয়াতে বলা হচ্ছে, সংখ্যালঘু শব্দটি ব্যবহার নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে, কারণ এটির একটি সাধারণ এবং একটি একাডেমিক ব্যবহার রয়েছে।

শব্দটির সাধারণ ব্যবহার একটি পরিসংখ্যানগত সংখ্যালঘু নির্দেশ করে; যাইহোক, শিক্ষাবিদরা গোষ্ঠীর মধ্যে জনসংখ্যার আকারের পার্থক্যের পরিবর্তে গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতার পার্থক্যকে উল্লেখ করে। কিছু সমাজবিজ্ঞানী ‘সংখ্যালঘু/সংখ্যাগরিষ্ঠ’ ধারণার সমালোচনা করেছেন, যুক্তি দিয়েছেন যে এই ভাষা পরিবর্তন বা অস্থিতিশীল সাংস্কৃতিক পরিচয়, সেই সঙ্গে জাতীয় সীমানা জুড়ে সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলিকে বাদ দেয় বা অবহেলা করে। যেমন, ঐতিহাসিকভাবে বহিষ্কৃত গোষ্ঠী শব্দটি প্রায়ই একই ভাবে ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং আধিপত্যের ভূমিকা তুলে ধরার জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি কীভাবে সামাজিক জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিম্ন-প্রতিনিধিত্বের ফলে হয়। যদিও পাকিস্তানিদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া এই অর্ধ শতাব্দি পরেও এই শব্দটি একটি স্বাধীন এবং মুক্ত দেশে এই শব্দটি আসা উচিত ছিল না। কারণ দেশটা সকলের। যারা এই দেশে জন্মগ্রহণ করছে, বড় হয়ে উঠছে এবং জীবন যাপন করছে সবার দেশ বাংলাদেশ। এখানে সেই অতীতকাল থেকেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ আর খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের সহাবস্থান।

তারপরেও কিছু ঘটনা ঘটে অনাকাঙ্খিত, অপ্রত্যাশিত এবং সত্যিই অত্যন্ত পীড়াদায়ক।

সত্যি বলতে যারা এসব করছে বা করে তারা কিন্তু সুস্থ আমি বিশ্বাস করি না। তারা কখনো দেশে শান্তি চায় না, একতা চায় না এবং দেশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে ইচ্ছুক নয়। ইচ্ছুক হলে, সমতা, সচ্ছ্বতা এবং সাহচার্যতা চাইতো। এই যে ইদানিং এবং আগেও দেখেছি হিন্দুদের মন্দির বা সম্পদ পাহাড়া দিয়ে রক্ষা করছে অসংখ্য মুসলিম, এটাই সম্প্রীতি। বেশিরভাগ মানুষই কিন্তু সম্প্রীতি চায়। অশান্তি চায় না। গুটিকতম মানুষ বা অমানুষ যাই বলি- তারা এটা চায় না। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সংখ্যালঘুদের উপর সহিংসতার মাধ্যমে কোনো অসৎ উদ্দেশ্য অর্জন করতে চায়। সুতরাং এরা কোনোদিন দেশের শান্তি বয়ে আনতে পারে না।

এই সম্প্রীতি বিনষ্ট করতেই একদল অমানুষের প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। বারবার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলাও হচ্ছে। তারপরেও কিছু ঘটনা ঘটেছে এটাও সত্যি। যারা এসব করেছে তাদের আমি কোনো শ্রেণিতে রাখতে চাই না।

আর সংখ্যা দিয়ে লঘু বা গুরু এখানেও আমার জোর আপত্তি রয়েছে। আমরা যারা আছি সবাই বাংলাদেশি। এই যে ছাত্র আন্দোলনে একটি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশা করা হচ্ছে সেখানে সংখ্যালঘু শব্দটি আর প্রয়োগ করা হবে না বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। প্রতিটি নাগরিক এই দেশের, এই মাটির এবং মায়ের।

দেশটা গড়ার দায়িত্ব আমাদের সবার এবং হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান এবং আরো যারা আছেন সবাই মিলেই এই দেশটাকে প্রত্যাশিত বাংলাদেশে নিয়ে যেতে পরিশ্রম করবো। সেখানে বারবার সংখ্যালঘু শব্দটি কেমন যেন পর করে দেয়, ভীতির জন্ম দেয় এবং দায়িত্ববোধ থেকে দুর্বল করে দেয়।

সংখ্যালঘু শব্দটি নিয়ে ব্রিটানিকাতে বলা হচ্ছে, সংখ্যালঘু, একটি সাংস্কৃতিক, জাতিগতভাবে, বা বর্ণগতভাবে স্বতন্ত্র গোষ্ঠী যা সহাবস্থান করে কিন্তু একটি অধিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর অধীনস্থ। যেহেতু শব্দটি সামাজিক বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়, এই অধীনতা একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর প্রধান সংজ্ঞায়িত বৈশিষ্ট্য।

যেমন, সংখ্যালঘু অবস্থা অগত্যা জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। কিছু ক্ষেত্রে এক বা একাধিক তথাকথিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জনসংখ্যা আধিপত্যশীল গোষ্ঠীর আকারের বহুগুণ বেশি হতে পারে, যেমনটি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অধীনে ছিল। বৈষম্যমুক্ত আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো দেশের সব রকম বৈষম্য দূর করা। সেখানে দেশের সংখ্যালঘুদের কেন অধিকার আদায়ে অথবা নির্যাতন বন্ধে কোনো সমাবেশ করা দরকার হবে? এমন বাংলাদেশ তো আমরা কেউ, কোনো দল, গোষ্ঠী বা যে কেউ সুস্থ মানুষ প্রত্যাশা করে না। পৃথিবীতে কোনো ধর্মই তো হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ায় না। এবার সময় এসেছে, সংখ্যালঘু শব্দটাকেই চিরনিদ্রায় পাঠানোর। টঘ ঝঢ়বপরধষ জধঢ়ঢ়ড়ৎঃবঁৎ ঋৎধহপবংপড় ঈধঢ়ড়ঃড়ৎঃর এর মতে- ‘সংখ্যালঘু হচ্ছে কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় জাতিগত, ধর্মীয় অথবা ভাষাগত বৈশিষ্ট্যে সংখ্যালঘু দল বা গোত্র, যারা সুনির্দিষ্টভাবে তাদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ধর্ম বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে তৎপর।’

ইউরোপীয় পরিষদ ১৯৯৩ অনুসারে-

‘সংখ্যালঘু হচ্ছে-

রাষ্ট্রের একটি জনগোষ্ঠী যারা;

(ক) রাষ্ট্রের নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় সীমানায় বসবাস করে;

(খ) রাষ্ট্রের সঙ্গে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ;

(গ) সুনির্দিষ্ট জাতিগত বৈশিষ্ট্য, সংস্কৃতি, ধর্ম বা ভাষাগত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান;

(ঘ) পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বশীল, যদিও সংখ্যায় রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার অথবা রাষ্ট্রের কোনো অঞ্চলের জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যালঘু;

(ঙ) তাদের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ধর্ম বা ভাষা রাষ্ট্রের সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, ভাষা বা ধর্মের সঙ্গে সংরক্ষণে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

অর্থাৎ সংখ্যালঘু ধারণাটি নতুন এবং কোনো নির্দিষ্ট দেশের সীমানায় সিমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন দেশেই সংখ্যালঘু শব্দটির সঙ্গে জড়িত মানুষগুলোর অস্তিত্ত্ব রয়েছে। ঠিক এই সুযোগে কেউ কেউ তাদের সঙ্গে বিরুপ আচরণ করে থাকে। মূলত সংখ্যায় কম থাকার কারণেই এই আক্রমণের শিকার হতে হয়। কিন্তু কোনো অধিকারেই তারা কম থাকে না। তবুও বারবার সংখ্যালঘু শব্দটি তাদের শুনতে হয়।

যেখানে স্বাধীনতার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে সেখানে একটি সাম্য ও ন্যায় ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে আমরা কেন ব্যর্থ হলাম সেই প্রশ্ন নিজেদের করতে হবে। কারণ দল- মত নির্বিশেষে আমরা সবাই তো বারবার একটি সুন্দর সমাজ ও সুন্দর দেশ গঠনের কথা বলছি। তাহলে কেন এই হামলা বা নির্যাতন। সংখ্যালঘু শব্দটি একটি স্বাধীন দেশে রীতিমতো অসম্মানজনক। একটি জাতি বা গোষ্ঠীকে অসম্মান করা হয় এবং তাদের মানসিকভাবে আঘাত করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, রাষ্ট্রের সব মানুষের অধিকার সমান। সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সুতরাং সংখ্যা দিয়ে নয়, রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে এবং নিজেদের মানসিকতাও পরিবর্তন করতে হবে। স্বাধীনতার এত বছর পরেও সংখ্যালঘু শব্দটি আর যেন নতুন বাংলাদেশে না শুনতে হয় সেই প্রত্যাশাই করি।