ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ডেঙ্গুর নামকরণ যেভাবে হয়েছিল

প্রদীপ সাহা, লেখক : কলামিস্ট
ডেঙ্গুর নামকরণ যেভাবে হয়েছিল

পৃথিবীতে অসংখ্য ভাইরাসের নাম রয়েছে। জানা যায়, সাধারণত যে প্রাণীর শরীরে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রথমবার জানা গিয়েছিল, তার নামানুসারেই ভাইরাসের নামকরণ করা হয়। অথবা যে বিজ্ঞানী এই ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন, তার নাম অনুযায়ীও এর নামকরণ করা হতে পারে। ডেঙ্গু ভাইরাসের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। ডেঙ্গু ভাইরাসের নামকরণের কাহিনি বেশ মজার। ষোড়শ শতকের শেষ দশকে, ডাক্তাররা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক নতুন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবের কথা জানাতে শুরু করেছিলেন। ফিলাডেলফিয়া, পুয়ের্তো রিকো, জাভা এবং কায়রোতে বহু মানুষ সে সময় একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। সবারই সর্বাঙ্গে তীব্র যন্ত্রণা এবং জ্বর, যাকে তারা ‘ব্রেক-বোন ফিভার’ বলে চিহ্নিত করেছিল। ১৮০১ সালে মাদ্রিদে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ায় আক্রান্ত হন তৎকালীন স্পেনের রানি মারিয়া লুইসা দে পারমা। সুস্থ হয়ে ওঠার পর একটা চিঠিতে রানি ডেঙ্গু রোগের কয়েকটি লক্ষণ ও নাম বর্ণনা করেছিলেন।

ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য মূলত দায়ী হচ্ছে চারটি ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ভাইরাসের গ্রুপ, যা ‘ফ্ল্যাভিভাইরাস’ নামে পরিচিত। এডিস ইজিপ্টি এবং এডিস অ্যালবোপিকটাস প্রজাতির মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু বিশ্বের গ্রীষ্মন্ডলীয় এবং উপক্রান্তীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। এ রোগের প্রকোপ সেসব অঞ্চলেই দেখা যায়, যেখানে এই বিশেষ প্রজাতির মশার প্রাকৃতিকভাবে আধিপত্য রয়েছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত পাঁচ বছরে এ রোগের প্রকোপ দ্রুত বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ‘এল নিনো’ আবহাওয়াকে উষ্ণ ও আর্দ্র করে তুলেছে, যা রোগের ভাইরাস বহনকারী মশাকে সুযোগ করে দেয় নতুন নতুন এলাকায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিতে। ২০২৪ সালে বিশ্বের ৯০টি দেশে এ ভাইরাস সক্রিয়ভাবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ ছড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।

উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে ভাইরাসের নামকরণ করা হতে পারে। কোনো কোনো ভাইরাসের নাম আবার যে জায়গায় আবিষ্কার হয়েছিল, সেই নাম অনুসারে কিংবা যে প্রাণীর দেহে প্রথম খোঁজ মিলেছিল সেই প্রাণীর নাম অনুযায়ী করা হয়। কারো ব্যুৎপত্তি আবার সময়ের জালে হারিয়ে গিয়েছে। অ্যানালিটিক্যাল টেকনিক বা বিশ্লেষণাত্মক কৌশল আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এখন ভাইরাস শনাক্ত করা সহজ হয়ে উঠেছে। তাই পরিচিত ভাইরাসের তালিকাও দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন, যাতে ভাইরাসকে শ্রেণিবদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে কিছুটা শৃঙ্খলা আনা যায়। তারা নিয়মতান্ত্রিক নামকরণ পদ্ধতির বিকাশ ঘটাতে চাইছেন, যার সাহায্যে নতুন ভাইরাসের উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গে তা শনাক্ত ও শ্রেণিবদ্ধ করে তোলা যায়। বর্তমানে ১৪ হাজার ৬৯০টি পরিচিত প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে, যেগুলোকে সরকারিভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু পুরো পৃথিবীতে কত ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে, তার কোনো স্পষ্ট চিত্র বিজ্ঞানীদের কাছে নেই। শুধুমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দেহে ৩ লক্ষ ২০ হাজার ধরণের ভাইরাস রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় জানা গিয়েছে, মানুষের অন্ত্রে ১ লক্ষ ৪০ হাজার ব্যাকটেরিওফাজের সন্ধান মিলেছে। পরিচিত প্রজাতির মধ্যে প্রায় ২৭০টি ভাইরাস মানুষকে সংক্রমিত করে বলে জানা গিয়েছে। নতুন রোগের প্রকোপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই তালিকাও দীর্ঘ হচ্ছে।

ডেঙ্গু নামের সঠিক উৎপত্তি ঠিক কোথা থেকে, তা কিছুটা অনিশ্চিত। তবে এই নামের সঙ্গে রোগের লক্ষণের যোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়। ডেঙ্গুতে আক্রান্তরা হাড় এবং পেশিতে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করেন, যার ফলে নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে যায়। জানা যায়, ‘সোয়াহিলি’ শব্দের স্প্যানিশ সংস্করণ থেকে ‘ডেঙ্গু’ নামের উৎপত্তি। জানা গেছে, ‘কি ডেঙ্গা পেপো’ যার অর্থ হলো ‘অশুভ আত্মা দ্বারা হঠাৎই আক্রান্ত হওয়া’, সেখান থেকেই এ নাম এসেছে। অন্য একটা তত্ত্ব বলছে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে লোকেরা যেভাবে ‘ড্যান্ডি’ শব্দটা উচ্চারণ করে থাকে, সেখান থেকেও ডেঙ্গুর উৎপত্তি হতে পারে। ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে এই ভাইরাসের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যেত। স্প্যানিশ সংস্করণ ‘ডেঙ্গেরুও’, যা আক্রান্তদের অসমন্বিত চলাচলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তা থেকেও এ নামের উৎপত্তি হতে পারে। এখানে শেষ তত্ত্বটা অপেক্ষাকৃত মজার। এ নামকে রসিকতার ছলে কোনো ‘কদর্য’ রোগ বর্ণনা করার একটা ধরন বলে মনে করা যেতে পারে।

ডেঙ্গু কিন্তু ভাইরাসের একটা বিশেষ গ্রুপের অন্তর্গত, যা ‘হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস’ নামে পরিচিত। হেমোরেজিক ফিভার ভাইরাস কিছু ক্ষেত্রে মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদি সংক্রমিত ব্যক্তির রক্ত এবং দেহরসের সঙ্গে সরাসরি সংস্পর্শে কেউ আসেন, তবে একজন মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে তা সংক্রমিত হতে পারে। সবক্ষেত্রেই ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রায় একরকম। তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, গাঁটে এবং মাংসপেশিতে ব্যথা, ডায়রিয়া এবং বমি। আর পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে হঠাৎ ক্ষত ও রক্তপাত। তবে সবক্ষেত্রেই যে ভাইরাল হেমোরজিক ফিভারে আক্রান্ত ব্যক্তির রোগের লক্ষণ চোখে পড়বে, এমনটা নয়। এ রোগ খুবই ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করতে পারে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত