অর্থনীতির সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে

শিক্ষার্থীরা ফিরেছেন ক্লাসে

প্রকাশ : ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রায় এক মাসের অচলাবস্থা কাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আজ রোববার থেকে খুলেছে। এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো নতুন সময়সূচি অনুযায়ী আগামী ১১ সেপ্টেম্বর শুরু হবে। পতিত স্বৈরাচারী ছাত্র-জনতার আন্দোলন বানচাল করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছিল। আন্দোলন শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কারের মধ্য দিয়ে শুরু হলেও তা বিস্তৃত হয়ে সবশ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় এবং শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে পালিয়ে যেতে হয়। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশ ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জন করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ সরকার ছাত্র-জনতার সরকার। এ সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের সরকার। ছাত্র-জনতার দাবি মোতাবেক পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের সাজিয়ে রাখা শিক্ষা, আর্থিক খাতসহ প্রশাসনের সর্বত্র সংস্কারের কাজ এরইমধ্যে শুরু হয়েছে। এর ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা স্বৈরাচার সরকারের সমর্থক ও দোসররা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছে কিংবা তাদের অপসারণ করা হয়েছে। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত উপাচার্য নিয়োগ করা হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দক্ষ, যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়েছে এবং তা চলমান রয়েছে।

স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ বলতে কিছু ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগের এক ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল। এই ভয়ের পরিবেশের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করতে হয়েছে। পাঠ্যসূচি দেশের বিরান্নবই ভাগ মুসলমানের চেতনা এবং মুসলমানদের ইতিহাসকে অস্বীকার করে রচনা করা হয়েছে। আগামী প্রজন্মের ওপর ভিন্ন সংস্কৃতি ও মিথ্যা ইতিহাস চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। দেশের মানুষ তা মেনে না নিলেও স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে দেশের শিক্ষাঙ্গন এখন ভয়মুক্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত পরিবেশ ফিরে আসবে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীণ সরকার দেশের মানুষের সেন্টিমেন্টকে ধারন করে প্রকৃত ইতিহাস, জ্ঞানভিত্তিক ও মেধাবিকাশের পাঠ্যসূচি প্রণয়নের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দেবে বলে আমরা আশা করি। শিক্ষা ক্ষেত্রে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তা দ্রুত পূরণ করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, সহ-উপাচার্য ও গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য হয়েছে, তাতে যোগ্য, দক্ষ আদর্শবান ও শিক্ষার্থীবান্ধবদের নিয়োগ দিয়ে পূর্ণোদ্যমে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু করতে হবে। পতিত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার লুটপাট, অর্থপাচার এবং মিথ্যা পরিসংখ্যান ও তথ্য দিয়ে অর্থনীতিকে খাদের কিনারে রেখে গেছে, তার সঠিক তথ্য দিয়ে তা পুনরুদ্ধারে পরিকল্পনা এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশের সাধারণ মানুষ যে শোচনীয় অর্থনৈতিক কষ্টে রয়েছে, এ পরিস্থিতিকে সহনীয় পর্যায়ে তুলে আনতে হবে। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশ প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছে বিশ্বখ্যাত ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তার প্রতি পূর্ণ আস্থা রয়েছে দেশবাসীর। সারা বিশ্বে তিনি গ্রহণযোগ্য এবং একজন অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক অঙ্গণে তার প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতা অপরিসীম। এর নজির আমরা দেখছি, তিনি দেশের দায়িত্ব নেয়ার এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপের দেশগুলো তাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রত্যেক দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সর্বাত্মক সহযোগিতার কথা ব্যক্ত করেছে। এর ফলে, দেশের ভাবমর্যাদা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি অর্থনৈতিক সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। আশা করা যায়, খুব স্বল্প সময়েই দেশগুলো নতুন বিনিয়োগ ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোও সহযোগিতা নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার প্রাজ্ঞতা ও বিজ্ঞতা দিয়ে দেশের সবচেয়ে অভিজ্ঞ, দক্ষ, সৎ ও মেধাবীদের সরকারে উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন। তাদের নিয়েই নতুন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে এবং তারাই পারবে দেশকে বিশ্বে একটি সমৃদ্ধ ও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যেতে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর যে বিচ্ছিন্ন হামলা ও ভাঙচুর হয়েছে, তা হওয়া অস্বাভাবিক নয়। দেড় দশক ধরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের খুন, গুম, নিপীড়ন, নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা হরণ, সংখ্যালঘু হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলার মতো ঘটনায় দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই ফেরাউনি শাসনের অবসানের পর নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটা স্বাভাবিক, যাকে ‘কোলেটারেল ড্যামেজ’ বলা হয়। তবে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সেকেন্ড ম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিভিন্ন সময়ে তার বক্তব্যে যেভাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে দশ লাখ লোক মারা যাবে, গণঅভ্যুত্থানের পর তার কিছুই হয়নি। গত ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবের মৃত্যুবার্ষিকীকে কেন্দ্র করে যে পাল্টা বিপ্লবের উসকানি দেশের বাইরে থেকে শেখ হাসিনা ও তার ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় দিয়েছিলেন, তা রুখতে ছাত্র-জনতা সারা দেশে অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে শেখ মুজিবের ম্যুরালে ফুল দেয়ার ঘোষণা দেয়। এতে ছাত্র-জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং সেখানে গিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে, এজন্য তারা রাতভর পাহারা দেয়। ১৫ আগস্ট সেখানে অবস্থানরত ছাত্র-জনতা আওয়ামী লীগের বলে যাদের সন্দেহ হয়েছে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মোবাইল চেক করেছে। এ নিয়ে কেউ কেউ সমালোচনা করেছে এবং তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এটা যে আওয়ামী লীগের বয়ান এবং স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শন, তা বুঝতে বাকি থাকে না। তাদের এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে হবে, এটা স্বৈরাচার শেখ হাসিনার প্রতি ছাত্র-জনতার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। ছাত্র-জনতার সমন্বয়করা দ্ব্যর্থহীনভাবেই ঘোষণা দিয়েছে, স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।