ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরী করা প্রয়োজন

সাঈদ চৌধুরী, কলাম লেখক ও সাধারণ সম্পাদক, উপজেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি, শ্রীপুর, গাজীপুর
দুর্নীতি দমন কমিশনকে কার্যকরী করা প্রয়োজন

পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই একটি পরিবর্তিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বলা হচ্ছে এটি দ্বিতীয় স্বাধীনতা। তবে শিক্ষার্থীদের এত সক্ষমতার পরিচায়ক এ পরিবর্তিত অবস্থায় সবাই চায় নতুন বাংলাদেশ আগের সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে নতুনভাবে শুরু করুক।

এই নতুনভাবে শুরু করার পেছনে সবচেয়ে বড় ইন্ডিকেটর হলো মানুষ তার অধিকারগুলো ফিরে পেতে চায়। নতুনভাবে শুরু করার জন্য প্রথম অন্তরায় আগের মতোই দুর্নীতিকেই বিবেচনায় আনতে হবে সবার প্রথমে। এজন্য একেবারে জনসাধারণ সম্পৃক্ত দুর্নীতিগুলোকে সবার আগে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।

ঠিক এই বিষয়টিও আরেকটু সহজে বলতে গেলে বলা যায়, বড় বড় খাতের দুর্নীতি যেগুলো আছে যেমন অর্থ পাচার, মেগা প্রজেক্টের দুর্নীতি, বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি, কোনো বড় দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয়গুলো আলাদাভাবে বিবেচনা করা এবং যেগুলো সরাসরি জন সম্পৃক্ত বিষয় সেগুলোকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা।

খুব খেয়াল করলে দেখা যায়, একজন মানুষ কোনো সমস্যায় পড়লে সবার প্রথমে কার কাছে যায় এবং কেন সে সমাধান পায় না ও সমাধান পেলেও কত জায়গায় ভোগান্তি হয় এ বিষয়গুলো নিয়ামক হিসেবে রাখা যেতে পারে। তারমানে কোনো জনপ্রতিনিধি কীভাবে সহজে একজন মানুষকে বিচার বঞ্চিত করছে বা দুর্নীতি করে বিচারকে প্রভাবিত করছে সে বিষয়গুলো আমলে নেয়া। দিনশেষে এই দুর্নীতিগুলো একীভূত হয়েই বড় দুর্নীতি হয় এবং এই দুর্নীতির ভার বইতে হয় সারা জীবন ধরে।

সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত খাত বের করাও কঠিন কিছু নয়। দুর্নীতি কোথায় হয় কাউকে জিজ্ঞেস করলে প্রথমেই উঠে আসে ভূমি সংক্রান্ত কাজ, সেবা খাত ও খাদ্য খাতসহ শিক্ষা ক্ষেত্রও। তবে যেসব খাতে বেশি দুর্নীতি হয়, সেসব খাত নিয়ে তদন্ত বা কাজও কম পরিলক্ষিত হয়। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেয়ার হার ভূমি সংক্রান্ত কাজে বেশি হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে তেমন নয়। মানুষ দুর্নীতিতে আক্রান্ত হতে হতে এমন একটা অস্থায় পৌঁছেছে যে অভিযোগের কথা বললেও তারা আর অভিযোগ দিতে চায় না।

গত বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের গণশুনানিতে একজন বিদ্যুতের গ্রাহক অভিযোগ দিতে গিয়ে বলার চেষ্টা করছিলেন যে, অভিযোগ দিয়ে তেমন কিছু হয় না বলেই আমরা আরো বেশি হতাশ হই। পরক্ষণেই যখন তার বিল সংক্রান্ত অভিযোগ শুনানিতে উপস্থাপন করেছিলেন, তখন সমাধানের জন্য পল্লী বিদ্যুতের সংশ্লিষ্ট যাকে ডাকা হয়েছিল- তিনি এসেও খুব ভালো উত্তর দিতে পারেননি। তবে অভিযোগের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছিলেন।

এখন সবাই চায় ওয়ান স্টপ সার্ভিস। হাসপাতালের সিট বাণিজ্য, খাদ্যে ভেজাল, জমি সংক্রান্ত দুর্নীতি কোনটি দুদক দেখবে এবং কোনগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখবে, এ বিষয়গুলো নিয়েও যথেষ্ট অজানা রয়েছে মানুষের মধ্যে। কিছুদিন আগেও ১০৬-এ কল করে দুর্নীতির অভিযোগ দেয়াতে মানুষকে উৎসাহী দেখা গেলেও বর্তমানে এসে মানুষের জিজ্ঞাসা তদন্তের ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ কোনো পদক্ষেপ আসে না অনেক ক্ষেত্রেই এমনটা কেন।

মানুষের অসুবিধার বিষয়গুলো এবং মানুষের বিচার না পাওয়ার বিষয়গুলো এত বেশি বিস্তৃত যে কোনটা ছেড়ে কোনটা অভিযোগ আমলে নেবে, সেখানেও কমিশনের বেগ পেতে হয়। এই কিছুদিন আগেও গাজীপুর দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসে শ্রীপুর পৌরসভার একজন কর্মচারীর দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয়।

সেখানে দেখা যায়, একজন মানুষ নিজের নামে দুটো ভোটার আইডি কার্ড ব্যবহার করে চাকরির পাশাপাশি স্বজনদের অফিসে এনে দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য করে তুলেছেন। বর্তমানে এই অভিযোগের ব্যাপারে আবারো সোচ্চার হয়েছে গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষরা। দুদক থেকে তদন্ত হবে বলেও সবাই আশা করছেন। যদি তদন্ত দ্রুত হয় তবে কিন্তু এমন দুর্নীতি কমানো সম্ভব এবং এই ধরনের দুর্নীতিবাজদের শাস্তি দেয়াও সম্ভব।

সুতরাং সব বিবেচনায় দুর্নীতির বিষয়টি আড়ালে পড়ে যায় দীর্ঘমেয়াদি বিচারিক কার্যক্রমের জন্যই। এখন জমিসংক্রান্ত কাজে একজন ঘুষ চাইল তখন আপনি কি অভিযোগ করবেন নাকি ঘুষ দিয়ে দ্রুত কাজ করবেন এই দোলাচল মানুষকে আরো বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে।

কিন্তু যদি এমন সিস্টেম ডেভেলপ করা যায় যে, দুর্নীতি করতেই পারবে না সিস্টেমের কারণে তবে কিন্তু দুর্নীতির ব্যাপকতা কমতে পারে। দুদকের এ বিষয়গুলোতে কাজ করা প্রয়োজন।

অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একদিকে সিস্টেম ডেভেলপ করবে আর অন্যদিকে দুদক বেশিরভাগ অভিযোগগুলো তদন্ত করে দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে শুরু করবে তবেই কিন্তু দুর্নীতির এই হতাশার চিত্রে কিছুটা স্বস্তি তাৎক্ষণিক আসতে পারে। প্রোঅ্যাকটিভলি কাজ না করতে পারলে জন অধিকার মুখ থুবড়ে পড়তেই থাকবে। এখানে দায়বদ্ধতার জায়গা বাড়ানোও অনেক বড় সিদ্ধান্ত।

যেমন কোনো কর্মকর্তার সম্পদের হিসাব ও বছর শেষে নিট ইনকামের কার্ভ কেমন তা জানা। এটিও খুব যে বেশি কঠিন তা কিন্তু নয়। অপ্রদর্শিত অর্থও এই মানুষটি কোনো না কোনো জায়গায় রাখে। এক্ষেত্রে একটি মানুষ যখন কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করছে, তখন তার স্বজনদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যাতে একে অপরের সঙ্গে মার্জ করা যায়, এমন একটি পদ্ধতি চালু করা যেতে পারে। এতে করে কোনো একটি অ্যাকাউন্টে বেশি লেনদেন হলেই তা গ্রিপে আনা সহজ হতে পারে।

দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক কাজগুলোও আরো বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেভাবে সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে এখন সবার পক্ষেই সহজ দুর্নীতি বন্ধ করা। এখানে স্কুলভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতার কাজ এবং পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি বন্ধে প্রতিটি জায়গায় ব্যয়ের হিসাব ও জনসাধারণ কর্তৃক সেবার জন্য প্রয়োজনীয় টাকার হিসাব উল্লেখ করার ব্যবস্থাগুলো আরো স্বচ্ছ করতে হবে।

এভাবে প্রতিটি ধাপে দুর্নীতি বন্ধের কাজগুলো এগিয়ে নিতে পারলে কাজে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। দুর্নীতির বিচার দ্রুত না হওয়া, সরকারি কর্মচারী আইনে সরকারের অনুমতি নিয়ে কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের নিয়মসহ আরো অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো দুর্নীতি বন্ধের অন্তরায় সেগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনার পাশাপাশি কার্যকরী পথ বের করাই এখন বড় কাজ।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান কি ধরনের এবং কতটা সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারবেন তারও একটি আধুনিক ও নতুন রূপরেখা দরকার।

সঙ্গে সঙ্গে দুদকের বর্তমানের যে কাজগুলো রয়েছে তা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরো ত্বরান্বিত করবে এটি আমাদের প্রত্যাশা। দুদকে সৎ মানুষের পাশাপাশি সাহসী ও সত্যবাদী মানুষের প্রয়োজন। সৎ ও সাহস মিলেই প্রতিরোধ ক্ষমতার উদ্ভব। আশা দুর্নীতি দমন কমিশন একটি গতিশীল ও আরো বেশী অর্থবহ প্রতিষ্ঠানে রূপ নেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত