গতি প্রকৃতির নিরিখে চলমান দূরভাষ মোবাইল

আফতাব চৌধুরী, সাংবাদিক-কলামিস্ট

প্রকাশ : ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

কয়েক দশক আগে একটি সংবাদপত্রের পাতায় চোখ আটকে গিয়েছিল। সংবাদটা এ রকম, ‘জাপান এমন একটা যন্ত্র করতে চলেছে, যেটা ছোট একটা পকেট বুকের মতো এবং যার পাতায় পাতায় থাকবে হাইটেক প্রযুক্তির বহুমুখী দান’। সেদিন চমকে উঠলেও আজ সে যন্ত্রটা আমাদের হাতে হাতে। এক সময় বলতাম সেলফোন, এখন বলি মোবাইল। হ্যাঁ, শুধু মোবাইল। ‘চলমান দূরভাষ’ বললে অনেকে শব্দ বন্ধের গাম্ভীর্যে বিরক্ত হবেন। তাই ভাষা সংক্ষিপ্ত আকারের শব্দটা ভাষাতত্ত্বের নিয়মে থেকে গেল- ‘মোবাইল’। এখন মোবাইল নিজে চলে না, অন্যকে চালায়। হ্যাঁ, এথিক্স নিয়েই সে অন্যকে চালায়। অসীম তার ক্ষমতা, অনিবার্য তার প্রয়োজনীয়তা। লৌকিক বস্তু হয়েও এটি যেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী। হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে পৌঁছে যায় বক্তার কণ্ঠস্বর। শ্রোতা কানে শোনেন গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সুতরাং বিজ্ঞানের এ আবিষ্কার আমাদের কাছে আশীর্বাদ। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর আগেই আমাদের একটা প্রবন্ধ রচনা আয়ত্ত করতে হতো- ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?’। সেদিন এ দু’য়ের স্বপক্ষে যুক্তিগুলো শুধু মুখস্থই করেছিলাম। আজ মনে হয় বিজ্ঞান তো অভিশাপ নয়, বিজ্ঞানকে অভিশপ্ত করে তুলি আমরা। যে ফাঁপা সূঁচে জীবনদায়ী ওষুধ শরীরে পুশ করা হয়, সে সূঁচেই আলতা ভরে আমরা কাঁচা তরমুজের মধ্যে পুশ করি। কারণ আমরা লোভী, অর্থপিশাচ। যে ডিনামাইট দিয়ে অসমতল পার্বত্যভূমিকে সমান করে মসৃণ রাস্তা বানাই, কয়েক ঘণ্টার পথ কয়েক মিনিটে অতিক্রম করি, সেই ডিনামাইট নদীতে ফাটিয়ে মাছ ধরি, মাটির নিচে থেকে পাথর ভেঙে উপরে উঠাই। আমরা আমাদের রসনা চরিতার্থ করি, সেই অবৈধ মৎস্য শিকারির ধরা মাছের স্বাদে। আমাদের আকাশ পথে যে বিমান শুভযাত্রার সূচনা করেছিল, সে বিমানেই মারণাস্ত্রের কৌশল যুক্ত করে হিরোশিমা-নাগাসাকির মানুষকে ছিন্নভিন্ন করি। দোষ বিজ্ঞানের নয়, দোষ আমাদের। আমরাই বিজ্ঞানকে অভিশপ্ত করেছি। নতুবা বিজ্ঞান তো আমাদের কাছে আশীর্বাদ ছাড়া আর কিছুই নয়। ‘ইএনটিআরএ’ অর্থাৎ ইজিপ্টস ন্যাশনাল টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটির কথা বলি। সেলফোন বাজারজাত হওয়ার তো কয়েক দশক হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে ইএনটিআরএ অতি সম্প্রতি মোবাইল ফোনের ব্যবহারে নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাতে একটি গাইড লাইন প্রকাশ করেছে। তাহলে মেনে নিতে অসুবিধা নেই যে অনেকের অপব্যবহারে এই যন্ত্রটিও অভিশপ্ত হয়ে উঠছে। আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অনায়াসে সামাজিক মূল্যবোধকে বিসর্জন দেয়া যায়।

এখন শুধু শহরে নয়, গ্রামে-গ্রামান্তরেও রয়েছে মোবাইল। যখন-তখন, যাকে-তাকে ফোন করা যায়। ‘ফোনাড্ডা’ তো কারো একার নয়। সৈয়দ মুজতবা আলী বেঁচে থাকলে এই আড্ডায় তিনিও যোগ দিতে দ্বিধা করতেন না। কারণ তার ‘পঞ্চতন্ত্র’ থেকে জানতে পারি যে, তিনি ছিলেন ভীষণ আড্ডাবাজ সাহিত্যিক। ‘কায়রোর আড্ডা’র সঙ্গে তিনি ফোনাড্ডা প্রসঙ্গও যোগ করতেন অবশ্যই।

মোবাইল টেলিফোনে কথা বলতে গেলে অনেকটা সাবধানতার প্রয়োজন আছে বলে অনেকেই মনে করেন। কিন্তু কী সেই সাবধানতা? ইএনটিআরএ প্রদত্ত বিধিমালার কথা মনে রেখে বলি: মোবাইল ফোন বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। অপব্যবহারের দ্বারা এই ক্ষুদ্রাকৃতি অথচ অসীম শক্তিধর যন্ত্রটিকে আমরা যেন অভিশপ্ত করে না তুলি। কথা যেমন মানুষকে আনন্দ দেয়, তেমনি কথায় কথায় মানুষ বিরক্তও হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় মানবজাতির সেবায় যেহেতু মোবাইল ফোন এক মহান প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন তা-ই এর ব্যবহার যেন মানুষকে বিরক্ত, বিব্রত করে না তোলে। মোবাইল ফোনের ব্যবহার কাউকে যেন টেনশনে না ফেলে। কারণ, আজকের যুগে এমনিতেই মানুষ টেনশনে-আক্রান্ত। ‘আপনি রওয়ানা দিয়েছেন বটে; কিন্তু শুনলাম অমুক জায়গায় পথ-অবরোধ আন্দোলন চলছে’ বক্তার কাছ থেকে শ্রোতার যখন এই কথা শুনলেন, তখন অকুস্থলে না পৌঁছানো পর্যন্ত তার মধ্যে টেনশন থেকেই যাবে। অথচ দেখবেন, পথ-অবরোধের কথাটা একেবারে শোনা কথা-যার কোনো ভিত্তি বা উৎস নেই।

পরিশ্রম এবং বিশ্রামণ্ডদুটোই মানব জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন। শ্রমের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে যদিও বা জরুরি প্রয়োজনে ফোন করা হয়। বিশ্রামের সময় নয় কখনোই। এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের একবার ঘুম ভেঙে গেলে ঘুম আর আসতেই চায় না। সুতরাং ঘুমের বিঘ্ন ঘটিয়ে পারতপক্ষে কাউকে ফোন করা ঠিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, বক্তা কী করে জানবেন যে শ্রোতা জেগে আছেন না ঘুমিয়ে আছেন? আমি রাত ১০টা-১১টার কথা বলছি। সাধারণত নাইট ডিউটিতে নিযুক্ত থাকা মানুষ ছাড়া আর সবারই বিশ্রাম নেবার প্রকৃষ্ট সময় প্রাক-মধ্যরাত্রি। সুতরাং সামাজিক মূল্যবোধের কথা ভেবে নয়, মানবতার কথা ভেবেই বেশি রাতে ফোন করা উচিত নয়। একদিনের কথা। আমার পাশেই বসেছিলেন আমার এক ভায়রাভাই। হঠাৎ তার মোবাইল ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। এরপর, ‘হ্যালো লতিফ সাহেব কেমন আছেন? শ্রোতার পাল্টা প্রশ্ন, ‘কোন লতিফ সাহেব?’ এরপর দু’মোবাইল ফোনধারীর মধ্যে কথার চাপান-উতোর চলতে থাকল। শেষে হঠাৎ আমার ভায়রা চিৎকার করে এমন গালাগালি শুরু করলেন, যা ছাপার অযোগ্য। ব্যাপারটি আর কিছু নয়, রং নাম্বার থেকে ফোন আসায় তিনি এত উত্তেজিত হন যে, কথার মধ্যে তার সংযম বোধটুকু ছিল না। এটা কাম্য নয়। ভায়রার উচিত ছিল উত্তেজিত ভঙ্গিতে কথা না বলে সংযত ভাষা ব্যবহার করা। এক্ষেত্রে প্রতিটি ডায়ালের আগে আমাদের প্রতেকেরই নম্বরটি সঠিকভাবে যাচাই করে নেয়া উচিত- যাতে শ্রোতা বিরক্ত না হন।

মোবাইল ফোনের স্পিকারে লাউড সাউন্ড আসতে পারে। উচ্চস্বরে কথা বলা বা শোনার জন্য মোবাইল ফোনের স্পিকার তৈরি হয়নি। তাই লক্ষ্য রাখতে হবে, লাউড স্পিকার যেন ‘অন করে কেউ কথা না বলেন বা শোনেন। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ‘চলমান দূরভাষে’ কথা বলার জন্য তো চিৎকার করার দরকার নেই। একবার, বহুদিন আগে, এক বিহারি ভদ্রলোককে গ্রামের এক পোস্ট অফিসের টেলিফোন থেকে রিসিভারে কথা বলতে শুনেছিলাম। পোস্ট অফিসটা ছিল বড় রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে। আমি সেই রাস্তায় যেতে যেতে শুনি বক্তার গগন বিদায়ী চিংকার, হ্যালো আমি তো বলছি, আপনি কি শুনছেন? ইত্যাদি মোবাইল ফোনে আজ কি এসবের দরকার আছে?

ইদানিং মোবাইল ফোনে আলোকচিত্র গ্রহণের প্রযুক্তি হয়েছে। স্মরণীয় মুহূর্তকে অমর করে রাখার জন্য এ কৌশলকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু এ মোবাইল ক্যামেরা দিয়েই তো ব্লু ফিল্মের গোপন ব্যবসা আজকের সমাজকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে। কারো সম্মতি ছাড়া ছবি তোলা যদি নিষিদ্ধ হয়, তাহলে গোপনীয়তা বজায় থাকে। এর উল্টো হলে, অর্থাৎ গোপনে বা অনুমতি না নিয়ে ছবি তুললে ব্যক্তির ‘প্রাইভেসি’ নষ্ট হয়- যা আইনানুমোদিত নয় কখনোই। সুতরাং মোবাইল ক্যামেরা ব্যবহার হোক উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে, এটাই কাম্য।

মোবাইল ফোনের বদৌলতে দেশ থেকে দেশান্তরে শর্ট মেসেজ সার্ভিস (এসএমএস)-এর মাধ্যামে বার্তা বা ছবি খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়া যায়; কিন্তু বার্তাবাহক শব্দগুলো যদি অশোভন হয় এবং প্রেরিত ছবিগুলো অশ্লীল ও কুরুচিকর হয় তাহলে? তাহলে অবশ্যই আইনগতভাবে অভিযুক্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে ষোলো আনা। সুতরাং সাধু সাবধান! পুলিশ তৎপর। যেখানে পরিষ্কার লেখা আছে, ‘মোবাইল ফোন নিয়ে প্রবেশ নিষেধ’ সেখানে মোবাইলের ব্যবহার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে হবে। সব সময় সেসব ক্ষেত্রে মোবাইলের সুইচ যেন অফ থাকে। কয়েকদিন আগের কথা। কোনো এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেখানে মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, এক ভদ্রমহিলা সঙ্গে মোবাইল ফোন নিয়েছিলেন এবং গোপনে কিছু ছবি তুলছিলেন। আর যায় কোথায়! পাহারাদারের নজরে আসামাত্র মোবাইলটি বাজেয়াপ্ত হবার উপক্রম। শেষে মোবাইলের মায়ায় ভদ্রমহিলা স্বেচ্ছায় কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেন, এমন কাজ আর তিনি জীবনে করবেন না। এরপর প্রহরী তাকে ছেড়ে দেন; কিন্তু স্বামী তাকে ছাড়লেন না। বললেন, ‘অমুক বাড়ির বৌ হয়ে তুমি কান ধরলে? বংশের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিলে? এবার বৌ স্বামীর কাছে কান ধরে প্রতিজ্ঞা করলেন, ‘এমনটি আর কোনো দিন হবে না, এবারের মতো ক্ষমা কর।’ এ সবের কিছু দরকার ছিল না যদি কুলবধূটি আইন অমান্য না করতেন। শুধু ওই গুরুত্বপূর্ণ স্থান বলে নয়, ধর্মীয় উপাসনালয়, শ্রেণিকক্ষ, পরীক্ষাগৃহ, সিনেমা কিংবা থিয়েটারে প্রবেশের আগে মোবাইল ফোনটি বন্ধ রাখা প্রত্যেকের নৈতিক কর্তব্য। মোবাইল ব্যবহারের সময় তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হয়। এতে হাসপাতালের আইসিইউতে বিপদের আশঙ্কা থাকে। সুতরাং ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মোবাইল ফোন বন্ধ রাখাই শ্রেয়। হাজারো কিসিমের রিংটোন ধরে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে মোবাইল ফোনে। রিংটোন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফোন ব্যবহারকারীর চরিত্র ও মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এমন ধরনের রিংটোন ব্যবহার না করাই শ্রেয় যা অন্যের বিরক্তি উৎপাদনের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রিংটোনের তো বহুমুখী উদ্দেশ্য নেই; একটি মাত্র উদ্দেশ্য-কলটি সম্পর্কে জানানো। এক্ষেত্রে চমক সৃষ্টির কোনো প্রয়োজন নেই, বিরক্তি উৎপাদন তো নয়ই। সবচেয়ে মারাত্মক হল দ্বিচক্র, ত্রিচক্র অথবা চৌচক্রের ‘পাইলট’ এর আসনে বসে মোবাইল ব্যবহার করা। আমার চোখে দেখা একটি দুর্ঘটনার কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে। একটি বাঁকে প্যাসেঞ্জার ভর্তি মাইক্রোবাস-চালক যখন বছর আটেকের একটি শিশুকে পিষে দিল গাড়ির চলন্ত চাকায়, তখন তার হাতে ছিল মোবাইল ফোন। মন নিবিষ্ট ছিল বাক্যালাপে। কাজেই সমূহ বিপদ থেকে সে নিজেকে ও যাত্রীদের বাঁচালো বটে, বাঁচাতে পারল না, এক নির্দোষ শিশুকে। আমি নিজেই এখন চলন্ত গাড়ির চালককে মোবাইলে ফোন করতে দেখলেই তীব্র প্রতিবাদ করি। এই প্রতিবাদ এককভাবে নয়, সমবেতভাবে করতে হবে। কারণ, এখানে নৈতিক মূল্যবোধের প্রশ্নটি শুধু জড়িত নয়, আছে অমূল্য প্রাণের অকারণ বিনিষ্টর সম্ভাবনা। ‘ইএনটিআরএ’ আরো দুটি মূল্যবান গাইডলাইন দিয়ে মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছে ধন্যবাদের ‘পাত্র’ হয়েছেন। ১) কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানাতে কিংবা কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেতেই কেবল মোবাইল ফোন ব্যবহার করা উচিত। বিশুখুড়োর ঢঙে বলি, ‘ভাত রান্ধলাম, বেগুন ভাজলাম’ শোনাতে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। একদিনের কথা। একটি উঠতি যুবক ভর সন্ধ্যায় অপেক্ষাকৃত নির্জন রাস্তায় কিছু দূর হেঁটে যাচ্ছে, আবার ঘুরে পেছন পানে হাঁটছে। হাতে তার মোবাইল, মুখে জোড়ালো হাসি। বুঝলাম এই নতুন রোমিও জুলিয়েটের প্রেমে পড়ে কখনও হাঁটে, কখনও থামে, কখনও হাসে আবার কখনও বকে। ২) রিংটোন প্রদানের চমক দেখিয়ে কিছু প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করছে। এদের সম্বন্ধে সচেতন থাকা জরুরি। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি সাপ্তহিক ম্যাগাজিনে একটি উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে তুলে ধরি, ‘মিশরের টেলিফোন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা কর্তৃক জারিকৃত বিধিমালা সামাজিক মূল্যবোধকে আরো সুসংহত করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। আমাদের দেশেও যে হারে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা এবং মোবাইল ফোনকে ঘিরে সামাজিক অবক্ষয় বেড়ে চলেছে, সেই হিসাবে অদূর ভবিষ্যতে এ ধরনের নীতিমালা প্রণয়ন এরই মধ্যে অতি জরুরি হয়ে উঠেছে, একথা নির্দ্ধিধায় বলা যায়’।

উপরের উদ্ধৃতিটিতে দুটি বিষয় আমাদের নজর কাড়ে। ১) মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা বৃদ্ধি, ২) মোবাইল ফোনকে ঘিরে সামাজিক অবক্ষয়ের দ্রুত। মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা বাড়াতেই পারে। টিভি, বাইক, মোটরগাড়ি, ফ্রিজ, প্রসাধনসামগ্রী- সবকিছুর বিক্রিই এখন ঊর্ধ্বমুখী। মোবাইল ফোনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কারণেই এটি আজ বিলাসদ্রব্য মাত্র নয়, দৈনন্দিন অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। এটি যাদের কাছে বিলাসদ্রব্য তারা তো বেশি কথা অকারণে বলতেই পারেন। একটি পরিসংখ্যান সূত্রের ওপর ভিত্তি করে বলি, ‘আমাদের দেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা প্রতি মাসে গড়ে কথা বলেন ২৭৫ মিনিট অর্থাৎ প্রায় ৫ ঘণ্টা এবং টেক্সট্ মেসেজ পাঠায় ৩০টি। মিসড্ কলের হিসাব কিন্তু এখানে নেই।

আমাদের সমাজে সবচেয়ে বেশি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন কারা? স্বাভাবিক উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যেই মোবাইল ফোনের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। তারা কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া শিশুটির ব্যাগেও ঢুকিয়ে দিচ্ছেন মোবাইল। ‘লন্ডন বিজনেস স্কুল’-এর লিওনার্দ ওয়েভারম্যান বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহার সম্পর্কে জানাচ্ছেন যে, জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের প্রভাব দারুণ ইতিবাচক। সত্যিই, ক্ষদ্র কৃষকরাও এখন আর আগের মতো ঠকতে চাইছেন না। কারণ মোবাইল ফোন ব্যবহার করে তারা উৎপাদিত দ্রব্যের আসল দামটা জেনে নিতে পারছেন। ফলে মধ্যসস্বত্বভোগী বা মিডলম্যানদের ধাপ্পাবাজি অনেকটা বন্ধ হয়েছে। সাগর তীরের জেলেরা এখন নৌকোয় বসেই মাছের সেরা দামটা জেনে নিতে পারছে বলেই তাদের দৈনিক আয় বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও বলি, ‘ডালমে কুছ কালা হ্যায়’। মোবাইল ফোনে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার ও অশ্লীল ছবি প্রচারের সাম্প্রতিক ঘটনা আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনের অধঃপতন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অন্তঃসারশূন্য দিকটিকেই উন্মোচিত করেছে। ভারতের নয়াদিল্লি থেকে সংবাদসংস্থা জানাচ্ছে উচ্চমধ্যবিত্ত এবং অভিজাত সমাজের মুখোশের আড়ালের মুখটিকে দেখিয়ে দিয়েছে দিল্লি পাবলিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনা। ডিপিএস, এমএমএস কাণ্ড তথাকথিত আধুনিক ও অগ্রসর শিক্ষাব্যবস্থার গায়ে-মুখে চাবুক মেরে দেখিয়ে দিয়েছে, সভ্যতার নামে চরম অসভ্যতার দিকে হাঁটছে আমাদের বুকের ধন ‘সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা। দক্ষিণ দিল্লিস্থিত ডিপিএস-এর প্রতিবেশী স্কুলের ১১ বছরের ছাত্রী রাগিনী জেনেছে, ‘ওরা সেক্স করে মোবাইল ফটো বানিয়েছে এবং ওই ফটো সিডিতে বিক্রি করা হয়েছে।’ ডিপিএস চত্বরে যা ঘটেছে তার জন্যে শুধু মোবাইল ফোনের অপব্যবহারই দায়ী নয়। দায়ী- ১) বর্তমান সমাজের অত্যাধুনিক জীবনযাপন, ২) তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার ও ৩) পশ্চিমী অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব।মোবাইল ফোন ব্যবহরের এথিক্স অবশ্যই আছে। প্রথমে কুশল-মঙ্গল জিজ্ঞাসা, পরে আসল কথা বা কাজের কথায় চলে আসা, ছোটো বা সংক্ষিপ্ত বাক্য-ব্যবহার, বক্তব্য শেষে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, ফোন করে নিজের পরিচয় দেয়া, প্রয়োজনবোধে কল ব্যাক করা, খুব ভোরে অথবা গভীর রাতে ফোন না করা, বিশেষ সময়ে ফোন ধরার অসুবিধার কথা জানানো, ফোন ধরে চেঁচামেচি না করা, পরিষ্কার উচ্চারণে কথা বলা- এসবই মোবাইল ফোনের ব্যবহারিক গাইডলাইন হিসাবে গ্রহণ করতে কারো অসুবিধা বা আপত্তি আছে বলে আমার মনে হয় না। আপনি ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতে পারেন। কিন্তু ওপার থেকে প্রথমেই কেউ যদি অন্য কিছু বলেন, তাহলে তিনি যেন আপনার কাছে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের পাত্র-পাত্রী না হোন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে বৈকি।