ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রহস্যঘেরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও অনেক বিতর্ক

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট
রহস্যঘেরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও অনেক বিতর্ক

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চলা যুদ্ধ এখনো চলছে। চলতি বছরের মে মাসের মাঝামাঝি রাশিয়া উত্তর-পূর্ব দিক থেকে ইউক্রেনে আক্রমণ করে। খারকিভ অঞ্চলে আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে তারা কিছু অঞ্চল নিজেদের দখলে নেয়। এই অঞ্চলগুলো তারা শুরুর দিকে আক্রমণ চালানোর সময়ও একবার দখল করেছিল; কিন্তু পরে তারা ওই অঞ্চল ছেড়ে যায়। কিছু বিশ্লেষক এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘যখন বিশ্ব ঘুমাচ্ছিল’ তখন এ ধরনের হামলা চালানো ন্যক্কারজনক ঘটনা। ওই আক্রমণের সময় রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্ত থেকে পাঁচ কিমি. দূরে ভোভচানস্ক শহরের চারপাশে প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। এরপরে যা ঘটতে পারে তার পূর্বাভাস ইউক্রেনের জন্য ভয়ঙ্কর। রাশিয়া হয়তো আরো সামনের দিকে এগোতে পারে এবং সম্ভবত ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভও দখল করতে পারে, যেখানে যুদ্ধের আগে ১৪ লাখ মানুষের বসবাস ছিল। ইউক্রেনের কাছে পর্যাপ্ত গোলাবারুদ নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় এক মাস দেরি হওয়ায় পশ্চিমা সামরিক সহায়তা আসতে বেশ সময় নেয়। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে রাশিয়া তার অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে এবং তারা যুদ্ধের পরবর্তী পর্যায়ে একটি সফল গ্রীষ্মকালীন আক্রমণ চালাতে পারে। গত ৬ আগস্ট ইউক্রেনের কয়েকটি সেনা ইউনিট বিস্ময়করভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে রাশিয়ার কুরস্ক ওব্লাস্টে ঢুকে পড়ে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার মাটিতে সামরিক অভিযানের আড়াই বছরের নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটে। কুরস্ক আক্রমণের এই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য এখনও রহস্যঘেরা এবং এ নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে এটি এরই মধ্যে স্পষ্ট, ইউক্রেনের রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত ভ্লাদিমির পুতিনের সীমা ও পশ্চিমাদের ক্রমবর্ধমান ভয়কে উপহাসে পরিণত করতে সফল হয়েছে। ইউক্রেনের সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য সম্ভবত দেশের দক্ষিণ ও পূর্বে সামরিক চাপ কমিয়ে আনা, যেখানে গত কয়েক মাসে রাশিয়া ধীরে ধীরে কিন্তু স্থিরভাবে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুটা সুরক্ষিত সীমান্তে আক্রমণ ও রাশিয়ার ভূখণ্ড দখল করে ইউক্রেনের সেনারা মনে করছেন, তারা যুদ্ধের সম্মুখ সারির সেনাদের তুলে নিতে ক্রেমলিনকে চাপ দিতে পারে, যেগুলো স্বয়ং রাশিয়ার সুরক্ষা দিতে পুনরায় মোতায়েন করা হয়েছিল। এ হামলা ইউক্রেনের জন্য এক বছরের ব্যয়বহুল ও হতাশাজনক প্রতিরক্ষামূলক অভিযানের পর সামরিক পদক্ষেপ পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি করে। এটা দীর্ঘদিন ধরেই স্পষ্ট, ইউক্রেন বাস্তবে অনেক বড় ও ধনী রাশিয়ান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জয়ের আশা করতে পারে না। কিয়েভের সামরিক সাফল্যের সবচেয়ে বড় সুযোগটি নির্ভর করছে যুদ্ধের গতিশীলতা ও কৌশলের ওপর, যা একদিকে ইউক্রেনের কমান্ডারদের আপেক্ষিক তৎপরতা কাজে লাগাতে দেয়; অন্যদিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর অনেক জটিল সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ায় সুযোগ নিতে সাহায্য করে। কুরস্ক ওব্লাস্টের আক্রমণে ইউক্রেন ঠিক এটাই অর্জন করেছে। মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে রাশিয়ার দুয়ারে যুদ্ধ নিয়ে এসে ইউক্রেন তাদের শত্রুদের মনোবলের ওপর একটি শক্তিশালী আঘাত হানার সুযোগ পেয়েছে।

ভিনদেশে ইউক্রেনীয় সেনাদের কোনো আগাম বার্তা না দিয়ে হামলা করে নিজেদের মধ্যে খুবই দরকারি মনোবল শক্ত করে তুলেছে। এতে তাদের মধ্যে এই আশা জাগিয়েছে যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি এখনও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সাফল্য অর্জন করতে পারে। রাশিয়ায় ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর অগ্রগতি যুদ্ধের ধারণা পেতে গোড়ার বার্তা দেয়। রাশিয়ার আক্রমণ একটি অচলাবস্থা তৈরি করেছে এবং যুদ্ধক্ষেত্রে আর ভিন্ন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। ইউক্রেন সেনাদের হামলা এই বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এতে ভ্লাদিমির পুতিনের সীমা লঙ্ঘন ও উত্তেজনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে পশ্চিমের অতি গুরুত্ব দেয়ার মূর্খতাও উদোম হয়ে পড়েছে।

সর্বোপরি রাশিয়ার ওপর ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর বর্তমান আক্রমণটি অবশ্য সব ধরনের সীমা লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। যদি রাশিয়া সম্ভাব্য পারমাণবিক হামলার আশঙ্কা বেড়ে যাওয়া নিয়ে জোরেশোরে প্রস্তুতি নিত, তাহলে এটি তার জন্য বিবিধ হুমকির বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ এক পদক্ষেপ হয়ে দাঁড়াত। বাস্তবে পুতিন আক্রমণকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করে নিজের প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন; অথচ তিনি এমন ভাব ধরেছিলেন, সবকিছু এখনও তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। ইউক্রেনের আক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথম গণবিবৃতিতে পুতিন একটু নরমভাবে এটি বড় আকারের উস্কানি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তখন মনে হয়েছিল, বাক্যের এই অংশ পরিস্থিতির মাত্রা চাপা দিতে বিশেষভাবে তৈরি করা। ক্রেমলিন কুরস্ক ওব্লাস্টে এক জরুরি অবস্থা জারি করে, যা পরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান- এ রূপ দেয়া হয়। এই সংযত আইনশৃঙ্খলার ভাষা ও ন্যাটোর সঙ্গে অস্তিত্বের লড়াইয়ে স্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত শব্দ বিনিময়ের মধ্যে পার্থক্যটা খুব কমই পরিস্থিতি জটিল করতে পারে। এখন পর্যন্ত এই অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হলো- প্রতিপক্ষের ওপর চাপ তৈরি করতে রাশিয়ার বড় ধরনের আক্রমণ চালানো জরুরি হলেও, এজন্য তারা সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পর্যাপ্ত রিজার্ভ বা সেনাবাহিনীকে আনতে পারছে না। এটি আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়ার এক ধরনের অক্ষমতা। অন্যদিকে, পশ্চিমের দেশগুলো থেকে ইউক্রেনে নতুন সামরিক সরবরাহ আসতে শুরু করেছে, যা তাদের প্রতিরক্ষায় সাহায্য করবে। ইউক্রেনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের রিসার্চ ফেলো মাইকোলা বিয়েলেসকভ বলেছেন যে, মার্কিন কংগ্রেস এপ্রিলে ইউক্রেনের জন্য ৬ হাজার ১০০ কোটি ডলারের সামরিক সহায়তা প্যাকেজ পাস করার পরই রাশিয়া আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে।

কিন্তু এই সুযোগের জানালা বন্ধ হতে শুরু করেছে। এই নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজের ফলে ভূমিতে রাশিয়ার শক্তি হ্রাস পাবে। এ কারণেই অনেক স্থান থেকে ইউক্রেনকে সরে যেতে হলেও সেই ব্যবধান এখন কমে আসছে। তবে মে মাসের শেষের দিকে, খারকিভ অঞ্চলে রাশিয়ার আক্রমণের গতি কমে যায়। কিন্তু রাশিয়ার আক্রমণের গতি ধীর হয়ে গেলেও এবং ইউক্রেনীয় বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হয়ে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হলেও তার অর্থ এই নয় যে, রাশিয়া হেরে যাচ্ছে। এই যুদ্ধে বিভিন্ন ঘটনাকে প্রভাবিত করছে, তা হলো- গ্লাইড বোমা, যা এই যুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্রগুলোর মধ্যে একটি। বিশ্লেষক মাইকোলা বিয়েলেসকভের মতে, রাশিয়ান সামরিক বিমানঘাঁটিতে আঘাত করাই গ্লাইড বোমা এড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায়। অন্যটি হচ্ছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে হামলা যা ফ্রন্টলাইনে ইউক্রেনের বিপর্যয় ও সেইসাথে ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে ক্রমাগত রাশিয়ান হামলা, যুক্তরাষ্ট্রকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে দান করা অস্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে তার মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরোদমে আক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক কিছুই পরিকল্পনা মাফিক এগোয় নি। তবে ইউক্রেনের প্রতি পশ্চিমের সমর্থনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মস্কোর সংকল্প আগের মতোই শক্তিশালী রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য মার্কিন কংগ্রেসে একটি নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজ গৃহীত হওয়ার পরে রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ লিখেছেন, ‘আমরা অবশ্যই জিতব, ৬১ বিলিয়ন রক্তাক্ত মার্কিন ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও জিতব। শক্তি এবং সত্য আমাদের পক্ষে’। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের উপদ্বীপ দখল পুতিনের গৌরবের মুকুট হিসেবে রয়ে গেছে। এ ঘটনা দেশটির সর্বশ্রেষ্ঠ শাসকদের মধ্যে তিনি একজন ও রাশিয়ার ইতিহাসে তাকে স্থান দেয়ার ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

এর পরও ইউক্রেন যখন ক্ষেপণাস্ত্র ও সামুদ্রিক ড্রোন মোতায়েন করে পুরো রাশিয়ার ব্ল্যাক সি ফ্লিটের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ডুবিয়ে দিতে বা নিষ্ক্রিয় করতে চেয়েছিল, তখন ক্রেমলিনের কাছ থেকে কোনো পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বিপরীতে পুতিন তার বাকি যুদ্ধজাহাজগুলো ক্রিমিয়া থেকে সরিয়ে ফেলে রাশিয়ার বন্দরে নিরাপত্তা খোঁজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পুতিন উস্কানি পেতে পারেন এই ভয়ে, পশ্চিমা বিশ্ব ২ বছরেরও বেশি সময় ধীরগতিতে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এখনও মাঝে মাঝে ইউক্রেন এটাই প্রমাণ করেছে, যখনই রাশিয়ার স্বৈরশাসক পরাজয়ের সম্ভাবনার মুখোমুখি, তখন তিনি সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি পিছু হটেছেন। যেহেতু ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী এখন পুতিনের শেষ সীমানা অতিক্রম করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ছাড়াই রাশিয়া আক্রমণ করেছে, সুতরাং কিয়েভের আত্মরক্ষার ক্ষমতায় সীমাবদ্ধতা বা যুদ্ধজয়ে ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলোর ব্যাপারে অস্বীকার করার আর কোনো অজুহাত নেই। ইউক্রেনের যুদ্ধ কতদিন স্থায়ী হতে পারে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে, যুক্তরাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র টেলিগ্রাফের সম্পাদক এবং তার ইউক্রেন দ্য লেটেস্ট পডকাস্টের উপস্থাপক ফ্রান্সিস ডিয়ারনলি বলেছেন, পশ্চিম সক্রিয় হওয়ার পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল হয়েছে এবং ওয়াশিংটন- জেলেনস্কির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে এবং এগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। যা কিয়েভের টিকে থাকার জন্য যথেষ্ট হলেও এর মাধ্যমে তারা নিশ্চিতভাবে যুদ্ধ জয় করে ফেলবে, সেটা বলা যাবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এবারের ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধ প্রয়োজন বা পূর্বাভাসের চেয়েও অনেক বেশি সময় ধরে চলছে। এ যেন এক রহস্যঘেরা বিতর্কে রূপ নিয়েছে। যার শেষ পরিণতি কী হবে, এ মুহূর্তে তা বলা মুশকিল।

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত