ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশন যেন বারোমাসি পান্তা-ইলিশ

এ এইচএ খান রতন, লেখক : কলামিস্ট
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশন যেন বারোমাসি পান্তা-ইলিশ

মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক হাইকমিশনার গোলাম সারোয়ার বিদায় নেয়ার শেষ দিকে, তড়িঘড়ি করে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের বিশ্বস্ত ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর হাইকমিশনের সাথে Expart Services Limited, Kuala Lumpur (ESKL) এর সাথে একটি অনৈতিক চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেন। এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ হাইকমিশনের ই-পাসপোর্ট, বিদেশিদের জন্য ভিসার অনুমোদন আর অন্যান্য সার্ভিসের জন্য একটা চুক্তি স্বাক্ষর সংশ্লিষ্ট বিষয়। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে সেই পাসপোর্ট ও ভিসা সেন্টারের উদ্বোধনের সময় তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া রেওয়াজ অনুযায়ী অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বা সচিব পর্যন্ত সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। Expart ServiceÕs Kualalampur Ltd ev ESKL-এর সাথে এ চুক্তির পর বিদেফশদের জন্য ভিসার অনুমোদন কার্যক্রম হাইকমিশন থেকে ESKL-এ চলে যায়, যার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। তার কিছুদিন পরে খাস্তগীর সাহেব প্রায় গায়ের জোরে লেবার উইং থেকে জেনারেল ট্রাভেল পাসের কার্যক্রম একরকম ছিনিয়ে নিয়ে ESKL-এ হস্তান্তর করেন। লেবার উইংয়ের সব অফিসার এবং পাসপোর্ট অফিসারের বিরোধিতা করলেও তিনি তার ইচ্ছামাফিক রেজুলেশন দেখিয়ে রেমিট্যান্স যোদ্ধা ও ভ্রমণ পিপাসুদের স্বার্থবিরোধী বিশাল অঙ্কের অনৈতিক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করে তা কার্যকর করেন। পূর্বে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে কেউ ট্রাভেল পাশ নিলে তার খরচ হতো চুয়াল্লিশ রিংগিত, আর এ কার্যক্রম চালুর পর একই কাজের জন্য বাংলাদেশিদের এখন খরচ হচ্ছে ঊনসত্তর রিংগিত। জনপ্রতি এই যে পঁচিশ রিঙ্গিত অতিরিক্ত খরচ মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের বহন করতে হচ্ছে, যার পুরোটাই যাচ্ছে ESKL ও গোলাম খাস্তগীরের পকেটে।

ফরেন ক্যাডারের অত্যন্ত মেধাবী ও সৎ কর্ম কর্তারা এই অনৈতিকতার সাথে মতবিরোধ করেও তা ঠেকাতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু, ড্রাইভার নিয়োগ থেকে শুরু করে বাড়ি ভাড়া বা বাড়ি পরিবর্তনসহ অন্যান্য ইস্যুতে ডেপুটি হাইকমিশনার খাস্তগীর সাহেবের সাথে দূতাবাসের কর্মকর্তাদের মতবিরোধ দেখা দিলেও সুকৌশলে তাদের এড়িয়ে দায়িত্ব পালনের সুযোগ না দিয়ে বরং ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছে। এমনকি অনেককে দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে কারণ হিসেবে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের চৌকস কর্মকর্তা ফারহানা আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তার বাবা একসময় বিএনপির রাজনীতি করতেন, তিনি সংসদ সদস্যও ছিলেন।

গত মার্চে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে পরপর দুই দিন মালয়েশিয়া হাইকমিশনের উপর রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছিল। Corruption in Media নামে একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিল একটি সংস্থা। যেখানে ক্যাম্পের ট্রাভেল পাস ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার উইংয়ের একজন কর্মকর্তা ফার্স্ট সেক্রেটারির দিকে আঙুল তোলা হয়। আর যে প্রতিষ্ঠানের নাম পত্রিকা ও সংক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীদের নজরে উঠে আসে তার নাম NZ travels. এই NZ travels কে হাইকমিশনে নিয়ে আসেন এনএসআইয়ের এক কর্মকর্তা। যেখানে বিরাট অঙ্কের অবৈধ আর্থিক লেনদেনের বিষয় রয়েছে; সঠিক তদন্তের মাধ্যমে অবশ্যই তা বেরিয়ে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট সবাই আশাবাদী।

এমনকি শেখ রাসেল ফুটবল টুর্নামেন্টের স্পন্সর হয় এই NZ travels. মজার ব্যাপার হলো পরবর্তীতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশক্রমে এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সেই কালোবিড়াল ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীরকে। বিশ্বস্তসূত্রে জানা যায় যে, তদন্ত কমিটির সামনে ট্রাভেল পাস ইস্যু নিয়ে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও তারা রিপোর্ট দাখিল করেন যে, কোনো অনিয়ম হয়নি। এর মানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক দুর্নীতির বিষয়টি তদন্ত কমিটি ইচ্ছা করেই এড়িয়ে যান।

সম্প্রতি মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের জন্য এনআইডি কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিন্তু হাইকমিশনে এডমিন ও ফরেন ক্যাডারের একাধিক যোগ্য অফিসার থাকা সত্ত্বেও এই দায়িত্ব অন্য কোনো নতুন কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছে। এতে দূতাবাসের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। পাশাপাশি এনআইডির সার্ভার, কম্পিউটারসহ সব মালামাল আবারো সেই ESKL-এর মধ্যেই ক্রয় করা হয়েছে। এমনকি মালয়েশিয়া হাইকমিশনের বাড়ি ভাড়াসহ যাবতীয় কর্যক্রমেই ব্যাপক অনিয়মের আশঙ্কা রয়েছে যা নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে বেরিয়ে আসবে।

আশঙ্কার কথা হলো মালয়েশিয়ায় এমআরপি পাসপোর্ট বন্ধের পাঁয়তারা করছে স্বয়ং হাইকমিশন।

অথচ মালয়েশিয়ায় ১৫ লাখ কর্মীদের মধ্যে ১১ থেকে ১২ লাখ কর্মীর হাতে রয়েছে এমআরপি পাসপোর্ট। তাই হুট করে এই সার্ভিস বন্ধ করে দিলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে মালয়েশিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশি রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। আর তারা তখন বাধ্য হবে এমআরপি বাদ দিয়ে ই-পাসপোর্ট করতে। এতে লাভবান হবে ESKL. তার মানে খোদ হাইকমিশন ব্যস্ত কীভাবে বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ মুনাফা বানাতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে।

এই ব্যাপারে পাসপোর্ট উইংয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। জনশ্রুতি রয়েছে যে, এই ESKL প্রতিষ্ঠানের একজন বেনামি অংশীদার ডেপুটি হাইকমিশনার খোরশেদ আলম খাস্তগীর নিজে। তাই সাড়ে তিন বছরের বেশি মালয়েশিয়ায় থাকার পরেও তিনি অন্যত্র যেতে আগ্রহী নন। হাইকমিশনের বিশ্বস্ত এক সূত্রে জানা গেছে, রাষ্ট্রদূত হিসেবে খাস্তগীরের বাহরাইন ও পোল্যান্ড যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও তার নিজের আগ্রহ মালয়েশিয়ায় অবস্থান করা। কারণ কি তা এখন, দেশে বিদেশে মালয়েশিয়া সংক্রান্ত ভুক্তভোগী সবাই জানে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত