ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে

নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে
রাষ্ট্র সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে

অন্তর্বর্তী সরকারের বয়স দু’সপ্তাহ হয়নি। এর মধ্যেই সরকারকে ভারতে পালিয়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও তার দিল্লির প্রভূদের একের পর এক চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কথিত ‘আওয়ামী পুলিশে’র কর্মবিরতির মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঢেউ তোলার কোশেশ করা হয়েছে। জুডিশিয়াল ক্যু করার অপপ্রয়াস চালানো হয়েছে। অতঃপর ১৫ আগস্ট পাল্টা অভ্যুত্থানের পাঁয়তারা করা হয়েছে। এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র সরকার ও ছাত্র-জনতা সফলভাবে মোকাবিলা করেছে। তাই বলে চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র থেমে যায়নি। এখনো অব্যাহত আছে। নানাভাবে নানারূপে গণবিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার অপতৎপরতা চলছে। এখন দেখা যাচ্ছে, দলে দলে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ সরকারের কাছে হাজির হচ্ছে নানা দাবি নিয়ে। দাবিনামা দীর্ঘ। চাকরি স্থায়ীকরণ, সংস্কার, পুনর্বহাল, জাতীয়করণ, বৈষম্যের অবসান ইত্যাদি। মৌখিক দাবি নয়, রীতিমতো রাস্তায় নেমে অবস্থান নিয়ে, মানববন্ধন করে দাবি জানান দেয়া হচ্ছে। গত রোববার রাজধানীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনে, বিভিন্ন স্থান ও সড়কে দাবিদারদের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ করা গেছে। দৈনিক ইনকিলাবে এর বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। আমরা এখানে তা পুনরুল্লেখ করছি না। এভাবে দাবির হিড়িক পড়ে যাওয়া পর্যবেক্ষক মহলে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এরা কারা? এতদিন কোথায় ছিল? এখনই এত তাকিদ কেন? সরকার বসতে না বসতেই এত তাড়ার কারণ কী? একথা নতুন করে উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, স্বৈরশাসনের সাড়ে ১৫ বছরে প্রশাসন, পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের অন্তত ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির অনুসারী। মেধা-যোগ্যতায় চাকরি হয়েছে যাদের, তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। বাকিদের চাকরি হয়েছে অর্থের বিনিময়ে। এতদিন তারা দিব্যি আরামে চাকরি করেছে, কোনো দাবি-দায়া তোলেনি। এই ক্রান্তিকালে তারা দাবির পাহাড় নিয়ে হাজির কেন?

বিশ্লেষকদের মতে, এটাও পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের একটি ষড়যন্ত্র। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করা বা বেকায়দায় ফেলানো এর আসল উদ্দেশ্য। সরকারের সামনে বিপুল কাজ অপেক্ষা করছে। তা ব্যাহত করার মতলবেই ‘আওয়ামী’দের মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত মেট্রোরেলের কথা উল্লেখ করা যায়। মেট্রোরেল চালু করার দিন-তারিখের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘোষণা অনুযায়ী সেই দিন তারিখে চালু হয়নি। লাইন, কোচ, সংকেতব্যবস্থা সবই ঠিক আছে। তারপরও মেট্রো চালু না হওয়ার কারণ কর্মচারীদের কর্মবিরতি। কর্মকর্তারা বাড়তি সুবিধা নিচ্ছে, তারা সুবিধা-বঞ্চিত, এই অজুহাতে তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাচ্ছে। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা থাকার কথা নয়, মেট্রোরেলে কর্মকর্তা-কর্মচারী হিসেবে যাদের চাকরি হয়েছে, তারা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ইত্যাদির সদস্য। তারা এই দাবিতে আগে কর্মবিরতি পালন করেনি। এখন করছে কেন? বলা বাহুল্য, ডাল মে কুচ কালা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় মেট্রোরেলের দুটি স্টেশন দুর্বৃত্তরা পুড়িয়ে দেয়। পতিত স্বৈরাচার এজন্য দায়ী করে আন্দোলনকারীদের। ক্ষয়-ক্ষতির অতিরঞ্জিত বিবরণ দেয়া হয়। বলা হয়, মেট্রো ফের চালু হতে এক বছর লেগে যাবে। স্বৈরসরকারের পতনের পর দেখা যাচ্ছে, এখনই মেট্রো চালু হতে পারে। স্টেশন দুটি ছাড়া মেট্রোর আর তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। মেট্রোস্টেশনে আগুন দেয়া নিয়ে নানা কথা চালু আছে। কারো মতে, বাস মালিকদের লোকেরা আগুন দিয়েছে। কারো মতে, মেট্রোর কর্মচারীরাই সরকারের নির্দেশে আগুন দিয়েছে। আশা করা যায়, তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে। মেট্রোরেল চালু না হওয়ায় দিয়াবাড়ি-মতিঝিলের যাত্রীদের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে। এই রুটে দুর্বিষহ যানজট প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা কর্মবিরতির মাধ্যমে জনভোগান্তি ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা এখনই নেয়া দরকার। সাধারণের অভিমত: দেশে কাজের লোকের অভাব নেই। যারা পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের অভিসন্ধি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তাদের না বিদায় করে অনুকম্পা দেখানোর মানে নেই। প্রসঙ্গত বলা জরুরি, দেশে দুই কোটিরও বেশি যুবক রয়েছে, যারা কর্ম প্রত্যাশী। এর মধ্যে অন্তত ২০ লাখ যুবক উচ্চ শিক্ষিত। সরকারি হিসাবেই বলা হয়েছে, প্রতি তিনজন বেকারের মধ্যে একজন উচ্চ শিক্ষিত- বিএ, এমএ পাস। গত ১৬ বছরে আওয়ামী ক্যাডাদেরই, যাদের বেশিরভাগ অর্ধশিক্ষিত ও অযোগ্য, চাকরি হয়েছে। যোগ্য-মেধাবীদের চাকরি হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সূচনাই হয়েছে, চাকরির ক্ষেত্রে অনিয়ম ও বৈষম্য নিরসনের দাবিতে। এখন ছাত্র-সমাজের এবং অভিভাবকদের দাবি, তরুণ বেকারদের চাকরি দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। গ্লোবাল সাউথ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-তরুণদের ভূয়োসী প্রশসংসা করেছেন এবং আমাদের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুকে ছাত্র-তরুণদের রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পতিত স্বৈরাচার গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার, সুশাসন, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিই শেষ করে যায়নি, রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কূটনীতিকদের ব্রিফ করতে গিয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছেন। তিনি আরো যোগ করেছেন, এমন একটি সময়ে দায়িত্ব নিয়েছি যখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। বিচার বিভাগের ভঙ্গুর অবস্থা। ১৫ বছরে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি করা হয়েছে। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হয়ে গেছে। তার বক্তব্যের মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জন নেই। এমতাবস্থায়, অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। আইনশৃংখলা প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, দুর্নীতি নিরোধ, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সংস্কার এখন জরুরি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান জনমনে যে আশা জাগিয়েছে, তার বাস্তবায়ন সরকারকে করতে হবে। এসব দায়িত্ব যখন সরকারের ঘাড়ে তখন পতিত স্বৈরাচার ও ভারত লাগাতার ঘুঁটি চেলে যাচ্ছে। সংখ্যালঘু নির্যাতনের একটা বড় ঘুঁটি চেলেছিল। বলা হয়েছিল, বহু হিন্দু নিহত হওয়া ছাড়াও তাদের বাড়িঘরে, দোকানপাটে, মন্দিরে শত শত হামলা হয়েছে। রাহুল আনন্দ, রোকেয়া প্রাচী প্রমুখকে সাক্ষ্য দিতে সামনে আনা হয়েছিল। কিন্তু এসব বর্ণনা ও উপস্থাপনা ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেছে। ফ্রান্স ২৪, বিবিসি, আলজাজিরা প্রভৃতি আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রমাণ দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, হিন্দু নির্যাতনের অভিযোগ সত্যের অপলাপ ছাড়া কিছু নয়। এক্ষেত্রে অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য দেয়া হয়েছে। পরিশেষে আমরা বলবো, সরকারকে ছাত্র-জনতার সাথে একাট্টা হয়ে সমস্ত চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্র সংস্কার ও গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত