ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

যৌন হয়রানি এবং আমাদের নৈতিক অবক্ষয়

প্রদীপ সাহা, লেখক কলামিস্ট
যৌন হয়রানি এবং আমাদের নৈতিক অবক্ষয়

যৌন হয়রানির সুস্পষ্ট ও সহজবোধ্য কোনো সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। সাধারণভাবে নারীদের তার বাড়িতে, কর্মক্ষেত্রে, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে, পথে, যানবাহনে কথা, ইঙ্গিত ও ফন্দির মাধ্যমে শারীকিভাবে সমাজবিরোধী কার্যকলাপে লিপ্ত হওয়াকে যৌন হয়রানি বুঝানো হয়। তবে যৌন হয়রানির ধারণা এত ব্যাপক যে, সংজ্ঞার মাধ্যমে এর সবকিছুকে ধরে রাখা সম্ভব নয়। অন্যভাবে বলা যায়, যৌন হয়রানি হলো যে কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণ, যৌনতা সুযোগের অনুরোধ অথবা যৌন আবেদনমূলক মৌখিক বা শারীরিক আচরণ অথবা যৌন প্রকৃতির অন্য কোনো প্রকারের আচরণ। এটি অন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধ, অপমান বা হয়রানিরূপে গণ্য হয়। যদিও সাধারণত একটি বিশেষ ধরনের আচরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যৌন হয়রানি সংঘটিত হয়। এটা বিপরীত লিঙ্গের বা সমলিঙ্গের মানুষের প্রতি হতে পারে। কাজেই নারী-পুরুষের যে-কেউ যৌন হয়রানির ভুক্তভোগী কিংবা অপরাধকারী হতে পারে।

নারী নির্যাতনের আলোচনায় যৌন হয়রানি হলো একটি বিশেষ দিক। আধুনিককালে নারীরা অধিক সংখ্যায় কর্ম গ্রহণ করায় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসায় কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন হয়রানি বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা যৌন হয়রানিবিরোধী আন্দোলন করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সমস্যা সমাধানের জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু তাতেও এ বিষয়টি এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। যৌন হয়রানির বিষয়টি দিন দিন বেড়েই চলেছে আমাদের দেশে। ফলে নারীদের চলাচলে সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করে। এ অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি পেতে হবে। আর যদি তা না হয়, তবে আমাদের সভ্যতার বিকাশ কোনোদিনই হবে না।

নারী নির্যাতনের একটি রূপ হলো যৌন হয়রানি। এই যৌন হয়রানির প্রকৃত ঘটনা সমাজে প্রকাশিত হলে নারীরা মানসিক শাস্তি পায় সবচেয়ে বেশি। এ সামাজিক ধিক্কারকে অনেক নারীই সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো যৌন হয়রানির শিকার। আমাদের সমাজে অহরহ চোখের আড়ালে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে; যার ফলে নারীদের আত্মহত্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যৌন হয়রানিতে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে নারীকে যৌন প্রস্তাব মেনে নিতে হয়। সাধারণত কর্মক্ষেত্রে বা শিক্ষাক্ষেত্রে এসব হয়রানি হয়ে থাকে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির শিকার চাকরীজীবী মহিলা দোটানায় ভোগেন। অভিযোগ করলে চাকরি হারানোর ভয় থাকে। অন্যদিকে ক্ষোভ চেপে রাখতে গেলে মানসিক অশান্তির সৃষ্টি হয়। ফলে মহিলা কর্মজীবীদের মধ্যে চাকরি বদলের প্রবণতা পুরুষের চেয়ে বেশি দেখা যায়। ছাত্রীদের জন্য যৌন হয়রানি শিক্ষাজীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলে। শিক্ষকের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ফলাফল লাভেও বঞ্চিত হয়। ছাত্রীদের অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকরা দুর্বল ছাত্র-ছাত্রীদের নিচের গ্রেডে ফেলে দেন। ফলে ভুক্তভোগী ছাত্রীটি শিক্ষার প্রতি মায়া-মমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে ভুক্তভোগীরা প্রায়ই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর প্রক্টর কার্যালয় সেটি গোপন রাখে। হয়রানি ও হুমকির মুখে তিনি গত ১৫ মার্চ ২০২৪ কুমিল্লায় নিজবাড়িতে আত্মহত্যা করেন। ঘটনার আগে তিনি ফেসবুকে লিখেছিলেন- ‘তার সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান এ ঘটনার জন্য দায়ী’। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ছেলেটির পক্ষ নিয়ে অবন্তিকার সঙ্গে খারাপ আচরণ করেছেন। তিনি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। শিক্ষার্থী গণমাধ্যমকে জানান, ২০২১ সালে তার বিভাগের এক শিক্ষক তাকে যৌন হয়রানি করেন। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের কাছে অভিযোগ করলে বিভাগের চেয়ারম্যান ও অভিযুক্ত শিক্ষক তাকে সেটি তুলে নিয়ে নানাভাবে চাপ দেন। রাজি না হওয়ায় তারা তাকে হাত-পা কেটে হত্যা করাসহ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি দেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবি-এর প্রভাষকের জন্য আবেদন করেন। জাহাঙ্গীরনগরে সাবেক এক ছাত্রী সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন এবং তার নিয়োগ আটকে দেন। শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, অভিযোগের পক্ষে সব তথ্যপ্রমাণ তার কাছে আছে; যৌন হয়রানির কারণে তিনি স্নাতকোত্তর করতে পারেননি। স্নাতকোত্তর শেষ সেমিস্টার থেকেই ওই শিক্ষক তাকে যৌন হয়রানি শুরু করেন। এর ফলে তার শেষ সেমিস্টারের ফলও ভালো হয়নি। ২৩ মার্চ ২০২৪ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক পোস্টে তিনি ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও পরীক্ষায় কম নম্বর দেয়ার অভিযোগ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অভিযুক্ত শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রায় আট বছর আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এর চার বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হন। গত ছয় বছরে তিন দফায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগে শিক্ষক হওয়ার আবেদন করে তিনি ব্যর্থ হন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত ১৪টি অভিযোগ জমা পড়েছে। এর মধ্যে ১২টির অভিযোগ নিষ্পত্তি হয়েছে, দুটি অভিযোগ তদন্তাধীন অবস্থায় আছে। ২০২৩ সালের মে মাসে অর্থনীতি বিভাগের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে এক ছাত্রকে ছয় মাসের জন্য বহিষ্কার ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। গত ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের এক শিক্ষককে স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যূত করা হয়। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ মীর মশাররফ হোসেন হলের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে হলসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার পর ইউজিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাস নারীবান্ধব করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশানুরূপ কোনো পদক্ষেপ নেয়নি অথবা গৃহীত পদক্ষেপের কোনো সফলতা আসেনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটছে। শিকার হচ্ছেন নারীরা। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের শীর্ষ পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে ২৭টি যৌন হয়রানির ঘটনা পাওয়া গেছে। হাইকোর্টের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘অভিযোগ কমিটি’ বা ‘প্রতিরোধ সেল’ গঠন করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা এ কমিটির কথা জানেনই না; অনেক ঘটনা তারা গোপন রাখেন হয়রানির ভয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানালেও তা গোপন রাখা হয়। কোনোরকম ব্যবস্থাই নেয়া হয় না। ঘটনা প্রকাশ্যে এলে তারপর সক্রিয় হন প্রশাসন। জবাবদিহিতার অভাব, সময়মতো তদন্ত ও দৃশ্যমান শাস্তি না হওয়া এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ার কারণে এসব স্থানে যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো ঘটেই চলেছে। মানুষ গড়ার শেষ ধাপটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে থাকে। সেখানেই যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে আমরা ব্যথিত হই। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। এমন ঘটনা সর্বত্র হয়ে থাকে, বহির্বিশ্বে ঘটে থাকে- এসব বলে বিষয়টিকে হালকা করে দেয়ারও অবকাশ নেই। বহির্বিশ্বে এমন ঘটনা ঘটলে সেখানে বিচার হয় এবং পুনরাবৃত্তি কম হয়। কিন্তু আমাদের এখানে বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি ঘাড়ে চেপে বসে আছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো যদি নারীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে, তাহলে কি তা টিকে থাকবে? আমাদের সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষিত থাকুক সম্পূর্ণভাবে- এটাই প্রত্যাশা করি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আমাদের আইনি কাঠামো খুবই দুর্বল। যৌন হয়রানি রোধে এ পৃথক আইন কতটা কার্যকর হতে পারে, তা আমাদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা প্রয়োজন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত