ইসলামে সংখ্যালঘুর অধিকার

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবা : ০১৯৬৩৬৭১৯১৭

প্রকাশ : ২২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। মানবজীবনের এমন কোনো দিক নেই, যার সুস্পষ্ট নির্দেশনা এতে নেই। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেশে সব মানুষের পারস্পরিক দায়িত্ব-কর্তব্যের নির্দেশনা ইসলামে বিদ্যমান। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মের মানুষ মুসলিমদের থেকে কী ধরনের আচরণ লাভের অধিকারী তারও বিবরণ রয়েছে এ জীবন বিধানে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ইসলাম স্বাধীন বিশ্বাসের নিশ্চয়তা, উপাসনালয়ের নিরাপত্তা বিধান, উপাসনা করার সুযোগ, সুসম্পর্ক ও সহানুভূতিমূলক ব্যবহারের নিশ্চয়তা, সুবিচার লাভ ও অত্যাচার-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার এবং সামাজিক সংহতি বজায় রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে।

ইসলামের মূল বিষয় হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতে বিশ্বাস। এ তিনটি বিষয় মেনে নেয়ার পর অন্য যে কোনো শরিয়ত (যেহেতু রহিত হয়ে গেছে) মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রসূলের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন শরিয়ত প্রদান আল্লাহর পক্ষ থেকে বড় করুণা। তাই পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হয়েছে, ‘আমি তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরিয়ত ও স্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি। ইচ্ছা করলে আল্লাহ তোমাদের এক জাতি করতে পারতেন কিন্তু তিনি তোমাদের যা দিয়েছেন, তা দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করতে চান’। এ আয়াতটিতে একত্ববাদের অধীনে আল্লাহ যে বিভিন্ন শরিয়ত বা পথ পাঠিয়েছেন, তার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। শরিয়তের এই ভিন্নতা মহান আল্লাহর অলৌকিক বিষয়। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মানিত করেছেন। আল্লাহ মানুষের মধ্যে এমন সব গুণ দান করেছেন যার মাধ্যমে সে সত্য-মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। আর এ কারণে আল্লাহ মানুষকে ইচ্ছার স্বাধীনতা ও পছন্দণ্ডঅপছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছেন। এ গুণের কারণেই সে স্বেচ্ছায় ইসলামে দীক্ষিত হবে, তাকে জোর করে ইসলামে দীক্ষিত করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহ বলেছেন, ‘দীনের ব্যাপারে কোনো জোর জবরদস্তি নেই।’ কাউকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য বাধ্য করা যাবে না। মুসলিম সমাজে বসবাসরত সংখ্যালঘুরা তাদের নিজ নিজ ধর্ম পালনে স্বাধীন। এতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার কারো নেই। বিশ্বে যেমন বিভিন্ন ধর্ম রয়েছে তেমনি বিভিন্ন উপাসনালয়ও রয়েছে। যেমন, মুসলিমদের মসজিদ, হিন্দুদের মন্দির বা টেম্পল, খিস্টানদের গির্জা, বৌদ্ধদের প্যাগোডা ও ইহুদিদের সিনাগগ। ইসলাম যেভাবে অন্য ধর্মের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়, তেমনি মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় অন্য ধর্মের উপাসনালয়ের অবস্থিতিও স্বীকার করে। মুসলিম অধ্যুষিত দেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীর বসবাস যেমন ইসলামে স্বীকৃত, তেমনি নিজস্ব উপাসনালয়ে উপাসনা করার নিরংকুশ অধিকারও স্বীকৃত। ইসলাম তাদের উপাসনালয়ের নিরাপত্তা বিধানেও বদ্ধপরিকর। সুতরাং মুসলিম দেশে বসবারত ভিন্ন ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম পালনের জন্য উপসনালয় তৈরি ও তা সংরক্ষণ করার অধিকার লাভ করে। এ ক্ষেত্রে মুসলিমদের বা সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে, তাদের ধর্মীয় উপাসনালয় সংরক্ষণে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মুসলিম সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের ধর্ম অনুযায়ী উপাসান করার পূর্ণ অধিকার লাভ করে। তাদের ধর্মে যে সব বিধি-বিধান স্বীকৃত সেসব পালন করার নিশ্চয়তা ইসলাম তাদের প্রদান করে। একদল মুসলিম দার্শনিক মুসলিম অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার সীমা-পরিসীমা নির্ধারণ করতে গিয়ে অভিমত দিয়েছেন যে, তারা শূকরের মাংস, মদ এবং তাদের ধর্মে এ ধরনের যা কিছু বৈধ তা পান ও ভক্ষণ করতে পারবে। মুসলিম সরকার তাদের এগুলো ভক্ষণ ও পান করতে বাধা দান করার অধিকারী নয়। মহান আল্লাহ সংখ্যালঘুদের সাথে সুসম্পর্ক সৃষ্টি ও তা বজায় রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। সংখ্যালঘুদের নারী-পুরুষ, শিশু, শ্রমিক, বৃদ্ধ, রুগ্ন ও প্রতিবন্ধী মানুষ যারা মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকারক নয়, ইসলাম তাদের প্রতি মানবিক ও ন্যায় আচরণের অনুপ্রেরণা যোগায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি, তোমাদের স্বদেশ থেকে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ এ নির্দেশনা রসূলুল্লাহ স. ও তার অনুসারীগণ বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। ভিন্নধর্মের মানুষের সাথে মুহাম্মদ স. সহানুভূতিশীল ব্যবহার করতেন এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখতেন। ভিন্নধর্মের কোনো প্রতিবেশী অসুস্থ হলে তিনি তাকে দেখতে যেতেন এবং তার মাথার কাছে গিয়ে বসতেন। কোনো ইহুদি আমন্ত্রণ জানালেও তিনি তার আমন্ত্রণে সাড়া দিতেন। তিনি ভিন্নধর্মের অনুসারীকে উপহার দিতেন এবং তাদের কাছ থেকে উপহার গ্রহণ করতেন। আলেকজান্দ্রিয়ার গভর্নর এবং মিসরের বায়জান্টাইন সম্রাটের ভাইসরয় মুকাওকিস কর্তৃক প্রেরিত দুজন তরুণী, কিছু কাপড় ও সওয়ারির জন্য একটি খচ্চর উপহার হিসেবে গ্রহণ তার আন্তঃধর্মীয় সুসম্পর্ক সৃষ্টির উজ্জ্বল প্রমাণ। তরুণীদের একজন হলেন মারিয়ায়ে কিবতীয়া এবং অপরজন হলেন শিরিন। খচ্চরটির নাম দুলদুল। হুনায়েনের যুদ্ধে রসূলুল্লাহ স. এটির উপর আসীন ছিলেন। মুসলিম দেশে সংখ্যালঘু নাগরিকরা ন্যায়বিচার লাভের অধিকারী। এ অধিকার তাদের মহান আল্লাহ প্রদান করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্রে তারা ন্যায়বিচার লাভ করতে পারে দুটি উপায়ে। তারা বিচার পেতে পারে মুসলিম দেশে প্রচলিত ইসলামী আইনের আওতায়, যদি ইসলামী আইন চালু থাকে অথবা তাদের স্ব স্ব ধর্মের আইন অনুযায়ী। বর্তমানে মুসলিম দেশে যদি সংখ্যালঘুদের ব্যক্তিগত বিষয়ে মোকাদ্দমা উপস্থিত হয় তবে মুসলিম সরকার তাদের ধর্ম অনুযায়ী তা ফায়সালা করার ব্যবস্থা করবেন।