ব্যাংক কমিশন গঠনের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত

জনপ্রত্যাশা পূরণ হবে

প্রকাশ : ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

‘তুমি যদি টাকা ধার করো, তবে তুমি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ; আর যদি টাকার মালিক হও, তাহলে ব্যাংক তোমার কাছে দায়বদ্ধ’ অস্ট্রিয়ান এই প্রবাদে প্রতীয়মান হয় ব্যাংক ও গ্রাহকের মধ্যে আস্থার সম্পর্কই সবচেয়ে বড়। আর্থিক খাতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাংক খাত গ্রাহকের সেবা নিশ্চিতকরণে এবং তার আমানতের সুরক্ষার প্রয়োজনে যেসব ব্যবস্থা নিয়ে থাকে তা যদি ত্রুটিমুক্ত না হয়, তাহলে এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান হতে বাধ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য, শেষেরটিই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, অর্থনীতিতে টেকসই সংস্কারের জন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি অর্থনীতিতে এর বাইরে আরো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এসবই আর্থিক খাত স্থিতিশীল ও সংস্কার করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য এ সরকারের নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। ১৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বৈঠকে এসব সিদ্ধান্ত হয়। আমরা মনে করি, ব্যাংক খাত সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাংক কমিশন গঠন সময়ের প্রেক্ষাপটে সুসিদ্ধান্ত।

ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যাংকিং কমিশন কার্যকর ভূমিকা রাখবে- এই অভিমত অর্থনীতির বিশ্লেষকরা ব্যক্ত করেছেন। আমরাও মনে করি, ব্যাংক খাতের সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে এবং এজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। উচ্চ খেলাপি ঋণ ও সুশাসনের অভাবের কারণে ব্যাংক খাতে যে অস্থিরতা চলছিল তা মোকাবিলায় দীর্ঘদিন ধরেই ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি উত্থাপিত হচ্ছিল। বিলম্বে হলেও ব্যাংকিং কমিশন গঠনের সিদ্ধান্তটি অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। আমরা জানি, বর্তমানে দেশের ব্যাংক খাত কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। উচ্চহারের খেলাপি ঋণ ও বিভিন্ন আর্থিক সূচকে অধোগতি ব্যাংক খাতের জন্য যেসব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে- তা নিশ্চয়ই উদ্বেগের কারণ। আমরা মনে করি, ব্যাংকিং কমিশনের উদ্দেশ্যগুলো স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত ও নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে হওয়া উচিত। এই খাতের সামগ্রিক অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন জরুরি। আর্থিক খাতের সঙ্গে সম্পর্কিত তথ্যের প্রাপ্তি ও তথ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া চলমান সমস্যা ও সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করাও দরকার।

ব্যাংক খাতের দুরবস্থার জন্য ব্যক্তি বা মহল বিশেষের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠেছে। সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতকে যারা কুরে কুরে খেয়েছেন তারা বিগত রাজনৈতিক সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট প্রভাবশালী। এই প্রেক্ষাপটে আমরা বলব, তাদের চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এ ব্যাপারে কোনোরকম অনুকম্পা দেখানোর সুযোগ নেই। প্রশাসনিক, নিয়ন্ত্রক, আইন ও কাঠামোগত সংস্কারের জন্য সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর সুপারিশ প্রদান করা ব্যাংক কমিশনের হবে মুখ্য দায়িত্ব। আমরা আরো মনে করি, ব্যাংক কমিশন যদি ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করে সুপারিশ সুনির্দিষ্ট আকারে উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে সরকারের কাছে সংস্কার কাজটি সহজ হবে। ব্যাংক খাতের ক্রমশ খারাপ অবস্থার কারণে অর্থনীতিবিদরা ক্রমাগত একটি অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা বলে এলেও বিগত সরকারের আমলে এর প্রতি কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি, কমিশনের কার্যসীমা নির্দিষ্ট সময়বদ্ধ হওয়া উচিত- যাতে তাদের সুপারিশক্রমে সরকার দ্রুত সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে তা বাস্তবায়ন করতে পারে।

স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাংক কমিশনকে তার অগ্রগতি সম্পর্কে জনগণকে নিয়মিতভাবে তথ্য দেওয়ার যে অভিমত অর্থনীতিবিদরা ব্যক্ত করেছেন এর সঙ্গে আমরা দ্বিমত পোষণ করি না। একই সঙ্গে আমরা এও গুরুত্বের সঙ্গে বলতে চাই, এই কমিশনে যারা অন্তর্ভুক্ত হবেন তাদের দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও দূরদর্শিতা যেন দৃষ্টান্তযোগ্য হয়- এ ব্যাপারেও খেয়াল রাখতে হবে। প্রভাবমুক্তভাবে যাতে কমিশন কাজ করতে পারে, সেই নিশ্চয়তাও সমভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। তারা তাদের দায়িত্বগুলো সর্বোচ্চ পেশাদারত্বের সঙ্গে পালন করতে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতাণ্ডপ্রতিকূলতার মুখোমুখি না হন তাও নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্তর্বর্তী সরকারকে কখন কমিশন সুপারিশ দেবে এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে- এ ব্যাপারেও আগাম সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। অর্থনৈতিক সব ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই ব্যাংক খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পৃক্ত। কিন্তু যেভাবে এই খাতকে রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তির জোরে তছনছ করা হয়েছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা মনে করি, ব্যাংক খাতের ক্ষত উপশমে সবার আগে জরুরি সুশাসন। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ব্যাংক খাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বহুমাত্রিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে এই খাতে সৃষ্ট উপশম কীভাবে করা সম্ভব। অনিয়ম রুখতে তদারকি বাড়ানোর পাশাপাশি বিভিন্ন অভিযোগের নিষ্পত্তির বিষয়টি করতে হবে গতিশীল। আমরা মনে করি, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণ করা কঠিন কিছু নয়।

আমরা জানি, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ জালিয়াতিসহ বিভিন্ন অনিয়ম শনাক্তকরণে কাজ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি অ্যান্ড কাস্টমার্স সার্ভিসেস অংশ বা স্তর (এফআইসিএসডি)। উল্লেখ্য, এই প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ ব্যাংকের একমাত্র ডিপার্টমেন্ট; যেখানে গ্রাহকসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীও তাদের ব্যাংকিং লেনদেনসংক্রান্ত যেকোনো তথ্য অভিযোগ আকারে জানাতে পারে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, ইতোমধ্যে ওখানে অনেক অভিযোগও এসেছে। আমরা মনে করি, এগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। দেশ থেকে অর্থ পাচার ও ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অস্তিত্ববিহীন প্রতিষ্ঠানের নামে লোপাট হয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা- এই অভিযোগ অমূলক নয়। অর্থ পাচার আমাদের অর্থনীতি তথা জাতীয় স্বার্থের জন্য বড় হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখছি, তারল্য সংকটসহ নানামুখী জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, এই খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানকে। নিকট অতীতে এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা বলেছি, ব্যাংক খাতের বিদ্যমান পরিস্থিতি নিরসনে জবাবদিহি সংস্কৃতি পুষ্ট করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সংকটের উৎসে নজর দিয়ে দ্রুত যথাযথ প্রতিবিধানে মনোযোগ গভীর করা বাঞ্ছনীয়। সুশাসনকে সর্বরোগের দাওয়াই হিসেবে অভিহিত করা হয়। আমরা এও মনে করি, শুধু সুনীতির প্রতিপালনেই নিশ্চিত হতে পারে সুশাসন। আমরা বিশ্বাস করি, সুশাসনের আলো যত ছড়াবে, অনিয়ম-দুর্নীতির ছায়াও ততই দ্রুত দূরীভূত হবে।

ব্যাংকের টাকা জনগণের টাকা। ব্যাংক শুধু এই আমানত রক্ষাকারী দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। দেশের জনগণের টাকা বেহাত হোক কিংবা ফেরত না আসুক এমন বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অনিয়ম রোধে স্বচ্ছতাণ্ডজবাবদিহি নিশ্চিত করার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি ধরা পড়লে এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করতে হবে কালক্ষেপণ না করে। ব্যাংক কমিশন ব্যাংক খাতে সৃষ্ট সব অনিয়ম-দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধানসহ প্রতিবিধানের পথ বাতলে দেবে এবং জনপ্রত্যাশা পূরণ হবে- এ আশা আমরা রাখি।