বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ পদক্ষেপ প্রয়োজন

রূপম চক্রবর্ত্তী, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশুদ্ধ পানি, খাদ্য সংকট এবং নিরাপদ আশ্রয়ের অভাবে এক অবর্ণনীয় দুর্দশা এবং দুর্ভোগের মধ্যে দিন অতিবাহিত করছেন ফেনী, নোয়াখালি, চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির মানুষ। ফেনীর পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। তিনটি উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে ডুবে গেছে। এমন কোনো বাড়িঘর নেই যেখানে বন্যার পানিতে তলায়নি। মানুষের পাশাপাশি গৃহপালিত পশু পাখিও এখন পানিবন্দি। বিদ্যুৎ না থাকায় অচল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেট, মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা। যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে অনেকেই আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারেননি। বেশিরভাগ মানুষের ঘরে শুকনো খাবারও নেই। এল-নিনো, জেট স্ট্রিম, বঙ্গোপসাগরে মৌসুমি লঘু চাপসহ বেশকিছু প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর ওপর একই সময়ে সক্রিয়ভাবে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে।

১৯৮৮ সালের পর বন্যার ভয়াবহ চিত্র পরিলক্ষিত করলেন ফেনী জেলার নিম্ন অঞ্চলের মানুষ। ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফেনীর জেলা প্রশাসক শাহীন আক্তার বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘ফেনীর যে সব এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে তার অনেকগুলো সীমান্ত এলাকা।

পরিস্থিতি এতটাই দ্রুতই খারাপ হয়েছে গেছে আমাদের সামাল দিতে বেগ পোহাতে হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা দুর্গত এলাকায় পানিবন্দিদের উদ্ধারে কাজ করছি’। ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ত বৃষ্টিপাতের তথ্য অনুসারে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ওপর ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ দিনে মোট ৪৯০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২২ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত কুমিল্লা জেলায় মোট ৪৪৫ মিলিমিটার ও ফেনী জেলার পরশুরাম উপজেলায় ৪০৮ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ১৯ আগস্ট সকাল ৯টার পর থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট সকাল ৯টা পর্যন্ত দক্ষিণ ত্রিপুরার বাগাফা নামক স্থানে ৩৮০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যে স্থান বাংলাদেশের ফেনী জেলার পাশেই অবস্থিত। এই বৃষ্টির পানিগুলো বাংলাদেশের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। অন্যদিকে গোমতী নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় কুমিল্লা সদর উপজেলাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় বাড়িঘর, ফসলি জমি রাস্তা ঘাট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফেনী মুহুরী নদীর পানি প্রবেশ করায় জেলার সেনবাগ, কোম্পানীগঞ্জ ও কবিরহাট উপজেলার আরো নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জেলা সদর, কবিরহাট, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী, চাটখিল ও সুবর্ণচর উপজেলার মানুষ পানিবন্দি। বাড়িঘর ৩ থেকে ৫ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির শতাধিক গ্রাম তলিয়ে গেছে। এই উপজেলার মাছের খামার, ঘরবাড়ি ডুবে গেছে বন্যার পানিতে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, গত কয়েকদিন ধরে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গোমতী নদী সংলগ্ন অঞ্চলে এ বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বাংলাদেশে বন্যার প্রাথমিক কারণ, বাঁধের ভাটি অংশের অববাহিকায় এই বিপুল পানিপ্রবাহ। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর বাঁধটির অবস্থান সীমান্ত থেকে বেশ দূরে। এই বাঁধের উচ্চতা প্রায় ৩০ মিটার। ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের এই বাঁধ থেকে যে শক্তি উৎপাদন হয়, তার সুবিধাভোগী বাংলাদেশও।

বলা হচ্ছে, এখান থেকে বাংলাদেশ ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নেয়। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী থাকায় দুই দেশের জন্যই বন্যা এমন একটি সমস্যা, যা জনগণের জীবনে দুর্ভোগ সৃষ্টি করে। এ সমস্যা সমাধানে দ্বিপাক্ষিক পরামর্শ প্রয়োজন রয়েছে। গত ২২আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি উচ্চতর কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করেছেন যেন ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হলে দু’দেশ যৌথভাবে মোকাবিলা করতে পরে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ‘ড. ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আমরা যে ধরনের ফ্ল্যাগ মিটিং করি, উচ্চপর্যায়ের এমন একটি কমিটি করা গেলে এটি ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে মিটিং করবে এবং উভয় দেশ যৌথভাবে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করবে।’ ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ত্রিপুরায় এবার যে বন্যা হয়েছে তা নজিরবিহীন।

সেখানে ৫০ হাজারের মতো মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ত্রিপুরায় পানির পরিমাণ এত বেশি ছিল যে উপচে পড়ে পানি বাংলাদেশে ঢুকেছে। কেউ কাউকে দোষারোপ না করে বন্যার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করব। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বন্যা হচ্ছে। অবিরাম বৃষ্টিপাত, গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়া, সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রতিক্রিয়া, জোয়ার ভাটার বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া ছাড়াও আরো অনেক প্রাকৃতিক কারণে সময় অসময়ে বাংলাদেশে বন্যা হচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণের পাশাপাশি রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট কিছু কারণ যেখানে মানুষের অবাধ অনিয়ম ও বর্বরতার কারণে বন্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধ নির্মাণের ফলে প্রতি বছর নদীর পানি নিষ্কাশন পথ ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়।

নদী-নালা, খাল-বিল ভরাট করে রাস্তা বা বসতবাড়ি নির্মাণ, বনভূমি ধ্বংস করা ইত্যাদি। ভারত এবং বাংলাদেশের যৌথ প্রচেষ্টায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি বাংলাদেশের যে সব নদী নাব্যতা হারিয়েছে তার দিকেও সরকারকে খেয়াল রাখতে হবে। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা প্রকল্পসহ আর বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পের কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে হবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করে সাধারণ মানুষ এবং দেশের সম্পদ রক্ষা করতে হবে।