পানিবন্দি মানুষ : উঠে দাঁড়াবেই বাংলাদেশ

প্রদীপ সাহা, লেখক কলামিস্ট

প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গত কয়েকদিনের টানা ভারি বর্ষণ এবং ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলা হঠাৎ করে প্লাবিত হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, মৌলভীবাজার, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম জেলায়। এসব এলাকায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যাদুর্গত এলাকার গ্রামীণ সব সড়ক, ফসলি মাঠ পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যাকবলিত মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছেন। কোনো কোনো নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দিয়ে প্রবল বেগে পানি প্রবেশ করায় ডুবছে জনপদ। মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন, মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কও বন্ধ হয়ে গেছে। ভেসে গেছে কয়েক হাজার পুকুর-খামারের মাছ। দুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন। বিবিসি জানিয়েছে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ভারত ত্রিপুরার ডম্বুর গেট খুলে দিয়েছে। অন্যদিকে, উপকূলীয় এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি ঘনীভূত হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপে পরিণত হওয়ায় নদ-নদীতে পানি বেড়েছে এবং ভারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। প্রতি বছরই এখানে কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। একের পর এক এলাকা ভেসে গেছে, বেড়ে চলেছে বানভাসি মানুষের সংখ্যা। যেদিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। জনপদগুলো মনে হয় একেকটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। পানির স্রোতে ভেসে গেছে বাড়িঘর, গাছপালা, সবকিছু। ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ সবাই সমান কাতারে অবস্থান করছে।

বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় সাধারণত মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন ধরনের বন্যা হতে দেখা যায়। যে কোনো স্থানে বন্যা হওয়ার পর সেখানে মাটি, ফসল, কৃষিজমি, পশু, মৎস্য ও সম্পদেও প্রচুর ক্ষতি হয়। এছাড়া আছে অকাল মৃত্যু ও আর্থ-সামাজিক সমস্যা। বন্যাকবলিত এলাকায় জনসমস্যার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আশ্রয়ের সমস্যা, রান্না-বান্নার সমস্যা, খাবার পানির অভাব, জ্বালানির অভাব, পানি নিষ্কাশন সমস্যা, গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি সংরক্ষণে সমস্যা, যোগাযোগ সমস্যা, সাপ, পোকামাকড় ও সংক্রামক ব্যাধির ভয়, স্বাস্থ্য সমস্যা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি।

এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে ১৭৮৭ থেকে ১৮৩০ পর্যন্ত সংঘটিত বারবার বন্যায় ব্রহ্মপুত্রের পুরনো গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যায়। প্রায় প্রতি বছর বন্যা হলেও বিগত ১৯৮৮ সালের বন্যার ভয়াবহ পরিস্থিতি সমগ্র দেশ ও জাতিকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা নিয়মিত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০২২ সালে সিলেট বিভাগ ছাড়াও কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের ১৫টি জেলা বন্যাকবলিত হয়েছিল। গণমাধ্যমের বদৌলতে বন্যার ভয়াবহতার ছবি দেখে আমরা আতঙ্কিত হয়েছিলাম। মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে, বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অপেক্ষা করছে খাবারের জন্য- চারিদিকে শুধু থৈ থৈ পানি। দেখা গেছে, ছোট প্রিয় সন্তানকে বন্যার পানি থেকে নিরাপদে রাখতে ভাতের হাঁড়িতে বসিয়ে রাখছে। সম্প্রতি ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে- একটি ছোট শিশু ভয়ার্ত চোখে গলাপানির উপরে তাকিয়ে আছে। বন্যার মর্মান্তিক এসব দৃশ্যগুলো সহজেই বুঝিয়ে দেয়- ওরা কত অসহায়! আবার অনেকে বলছেন ছবিটি এআই দিয়ে বানানো। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ সংগঠকদের মতে, প্রতিটি নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে পানি ধারণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। হাওরে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, রাস্তা ও স্লুইসগেট নির্মাণসহ নির্বিচারে কাটা হচ্ছে পাহাড়-টিলা, গাছপালা। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির জন্য মূলত এসবই দায়ী। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ২৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল অর্থাৎ ১৮ শতাংশ ভূখণ্ড বন্যা কবলিত হয়। ব্যাপকভাবে বন্যা হলে সমগ্র দেশের ৫৫ শতাংশের অধিক ভূখণ্ড বন্যার প্রকোপে পড়ে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের মতে, বন্যার প্রধান কারণ হচ্ছে ভূ-তাত্ত্বিক কাঠামোতে বাংলাদেশ নিম্নভূমি ও সমতল এবং অধিকাংশ অঞ্চলের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়া আছে বঙ্গোপসাগরে জোয়ার-ভাটার তীব্রতা, বিপুল পরিমাণ পলি জমার কারণে বিভিন্ন নদ-নদীর স্বাভাবিক নিষ্কাশন ক্ষমতা হ্রাস, আবহাওয়াগতভাবে নিম্নচাপের সৃষ্টি ও অধিক বৃষ্টিপাত, অপরিকল্পিতভাবে ভূমির ব্যবহার, নদী-অববাহিকা অঞ্চলে ব্যাপক বন কর্তন, গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ ও অন্যান্য নদীতে বাঁধ নির্মাণের প্রভাব ইত্যাদি।

বন্যাকবলিত এলাকায় আশ্রয় এবং খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট ব্যাপক আকার ধারণ করে। বন্যায় দেখা গেছে, দলবেঁধে মানুষ ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ গলাবদ্ধ পানিতে হেঁটে হেঁটে ছুটছে, কেউ-বা ছুটছে নৌকায়। সেনাবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ডের সদস্যরা তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় অনবরত উদ্ধার করছে পানিবন্দি মানুষকে। বানভাসি মানুষের জন্য এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। পানিবন্দি মানুষের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে খাদ্যসামগ্রী, বিশুদ্ধ পানি, স্যালাইন ইত্যাদি। ভবনের মালিকরাও বিপর্যস্ত মানুষদের আশ্রয় দিয়েছেন, যথাসাধ্য তাদের খাবারের ব্যবস্থাও করে দিয়েছেন। এটাই মানবতা। এই যে মানবতা, অসহায়-দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো- এখানেই সত্যিকার মানুষের পরিচয়, আর মানুষের বেঁচে থাকার সার্থকতা।

পৃথিবীর বহু দেশ বন্যা এমনকি সমুদ্রের গ্রাস থেকে জনপদ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। চীন এবং হল্যান্ডের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একসময় চীনে প্রতি বছর হাজার হাজার একর জমির ফসল বন্যার পানিতে নষ্ট হয়ে যেত, ভেসে যেত বাড়িঘর ও মানুষ। চীন সরকার সেই ভয়ংকর বন্যা প্রতিরোধে সক্ষম হয়েছে। হল্যান্ডের সাফল্য আরো ব্যাপক। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে হল্যান্ডের অবস্থান প্রায় আড়াই হাজার ফুট নিচে। এ অবস্থায় সমুদ্রের বুকে দেশটি হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র ছিল না। কিন্তু বাঁধ তৈরি করে এখানে এমন অবস্থা করা হয়েছে যে, সমুদ্রের সাধ্য নেই দেশটিকে গ্রাস করে। শুধু এ দুটি দেশে নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধে মানুষের চিন্তা-ভাবনা আরো অনেক ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। আমাদের দেশ বাংলাদেশ।

এ দেশকে বন্যার গ্রাস থেকে রক্ষা করার জন্য বিগত ৫০-৬০ বছরে বহু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, বন্যা প্রতিরোধের জন্য বাঁধ নির্মিত হলেও সেগুলোর বেশিরভাগই ত্রুটিমুক্ত হয়নি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁধ নির্মাণ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাঁধের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হবার উপক্রম হয়েছে। অন্যদিকে, এসব বাঁধ যথাযথ শক্ত বা মজবুত না হওয়ায় পানির তোড়ে ভেঙে গেছে এবং প্লাবিত হয়েছে বহু জনপদ।

আমাদের এদেশ হঠাৎ করে বন্যা পরিস্থিতি উত্তরণের ব্যবস্থা নেই। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি সঠিক পরিকল্পনা এবং সফল বাস্তবায়ন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হলো নদ-নদীগুলো সঠিক নিয়মে খনন করতে হবে এবং এলাকার পানি বের হওয়ার জন্য সঠিক ও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে কিছু সংযোগ খাল তৈরি করতে হবে। বন্যাকবলিত এলাকায় উপস্থিত সংকট নিরসনে দুর্গতদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা অবশ্যই জোরালো এবং নিশ্চিত করতে হবে। সরকার এবং বিভিন্ন সংগঠনকে বিভিন্নভাবে এসব বানভাসি মানুষদের সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু শুধু সরকার কিংবা এসব সংগঠনের ওপর নির্ভর করলেই চলবে না, অসহায় মানুষদের পাশে আমাদেরও দাঁড়াতে হবে। নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী পানিবন্দি এসব মানুষদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। এ দেশের মানুষ হিসেবে এটাই আমাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য।