ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসলামে ইজারা অর্থনৈতিক গুরুত্ব

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবা : ০১৯৬৩৬৭১৯১৭
ইসলামে ইজারা অর্থনৈতিক গুরুত্ব

ইজারায় জামানতের একটি ধরন হলো আর্থিক জামানত। এ পদ্ধতিটি দোকান, গুদাম, অফিস, ফ্যাক্টরি ও বাসা-বাড়ি ইত্যাদি ইজারার ক্ষেত্রে সমাজের বহুল প্রচলিত। সাধারণত ইজারা নেয়ার সময় ভাড়াটিয়াকে দোকান বা ভূমির মালিকের নিকট অগ্রিম হিসাবে নগদ অর্থ দিতে হয়। জামানত হিসাবে নগদ অগ্রিম অর্থ নেয়ার বিষয়টি পূর্বযুগে তেমন চালু ছিল না। গত শতাব্দিতে তা বহুল প্রচলন লাভ করেছে। আর্থিক জামানত কখনো মোটা অঙ্গের হয়ে থাকে। আবার কখনো কম অঙ্কের হয়ে থাকে, যা দুইয়েক মাসের বাড়ার পরিমাণ হতে পারে। ইজারা দেয়া যেমন শরিয়তে বৈধ, তেমনি আর্থিক জামানত গ্রহণ করাও শরিয়তে বৈধ। জামানতের অর্থ আমানত হিসাবে রাখা। চুক্তিমতে পরে তা ফেরত দেয়া হয়। তবে অনেক সময় অফেরতযোগ্য মোটা অঙ্কের আর্থিক জামানতও গ্রহণ করা হয়, যা আসলে দখলি স্বত্বের বেচাকেনা হিসাবে গণ্য করা হয়। তাও শরিয়তে বৈধ। বিভিন্ন সরকারি মার্কেট ইত্যাদিতে এর প্রচলন দেখা যায়। এরূপ অবস্থায় উভয় পক্ষের চুক্তিটি কাগাজ স্পষ্টভাবে লিখিত হতে পারে। যাতে মতানৈক্যের সম্ভবনা না থাকে। ইজারগ্রহীতা অপরকে ভাড়া দিয়েও আর্থিক জামানত গ্রহণ করতে পারে। তাও শর্তসাপেক্ষে বৈধ। কখনো মালিক ভাড়াটিয়া থেকে কিছু টাকা ভাড়া ব্যতীত অগ্রিম নেয়, যা আর ফেরত দেয় না। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটা অবৈধ। যা মূলত পজিশন বিক্রি। বর্তমান সময়ে দোকান বা ঘর ভাড়া হয় আর্থিক জামানত গ্রহণ করে। ভাড়া নেয়ার সময় দোকান বা ভূমির মালিকের কাছে কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে দিতে হয়। যাকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়। তাতে স্থান, অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা অনুপাতে তারতম্য হয়ে থাকে। ভাড়াটিয়া মালিককে এক সাথে কখনো মোটা অঙ্কের জামানত দেয়, আবার কখনো সামান্য অঙ্কের। তাও কখনো ফেরতযোগ্য হয়, আবার কখনো অফেরতযোগ্য হয়। ফেরতযোগ্য জামানত আবার কখনো কর্তনযোগ্য হয়। সেই হিসাবে বিভিন্ন বিন্যাসে অগ্রিম জামানত গ্রহণ করা হয়। সমাজে তাকে বিভিন্ন নাম দ্বারা অখ্যায়িত করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন শব্দের প্রকাশ করা হয়। কোথাও বলা হয় সেলামি বা অগ্রিম। আর্থিক জামানতের সকল প্রকার মোটামুটি বৈধ। কেননা, ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো নিষিদ্ধ হওয়া। দলিল পাওয়া গেলেই তা পালন করা যাবে। নতুবা তা বিদ‘আত হবে। আর লেনদেনের ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো মুবাহ বা বৈধ হওয়া। নিষেধের দলিল পাওয়া গেলেই কেবল সেটি সম্পাদন করা অবৈধ হবে। তবে অনেক সময় আর্থিক জামানতের মাধ্যমে ইজারা নেওয়ার পরও ভাড়াটিয়া মালিকের বিভিন্ন ধরনের হয়রানির সম্মুখীন হয়। এ ব্যাপারে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। বাংলাদেশ ১৯৯১ সালে বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে এ সকল প্রকার অনিয়ম থেকে উভয় পক্ষ বিরত থাকতে পারে। ইজারা শব্দটি আল-আজরু শব্দ থেকে নির্গত। এর অর্থ পারিশ্রমিক, সম্মানী বিনিময় ও পুরুস্কার। পরিভাষায় ইজারা হলো যে কোনো বস্তুর উপকারিতা বা সুবিধা ভাড়ার বিনিময়ে বিক্রি করা।

আলাউদ্দিন আল-কাসানী রা. (মৃ. ৫৮৭ হি.) বলেন, ইজারা হলো (যে কোনো বস্তুর) সুবিধা বা উপকারিতা বিক্রি করা, যা বর্তমানে বিদ্যমান নেই। বুরহানুদ্দীন আল-মারগীনানী রহ. (মৃ. ৫৯৩ হি.) বলেন, ইজারা হলো, বিনিময় দ্বারা (কোনো বস্তুর) সুবিধা ও সেবা অর্জনের জন্য চুক্তি করা। শরিয়তে ইজারা বৈধ। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, তাদের একজন বললো, হে পিতা! তুমি একে শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত কর, কারণ তোমার শ্রমিক হিসাবে উত্তম হবে সে ব্যক্তি যে শক্তিশালী, বিশ্বস্ত। তিনি মূসা (আ.) কে বললেন, আমি আমার এই কন্যাদ্বয়ের একজনকে তোমার সাথে বিয়ে দিতে চাই, এই শর্তে যে, তুমি আট বছর আমার কাজ করবে, যদি তুমি দশ বছর পূর্ণ কর, সেটা তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। ইনশাআল্লাহ তুমি আমাকে সদাচারি পাবে। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত নবী (স.) ও আবু বকর (রা.) বনী দিলের এক ব্যক্তিকে, (যে পরবর্তীতে বনী আবদ ইবন্ আদীর সদস্য হয়েছিল) ইজারা নিলেন। সে একজন দক্ষ পথপ্রদর্শক ছিলেন (খিররিত হলো দক্ষ পথ প্রদর্শক)। সে আস ইবন ওয়ায়িলের বংশের সাথে বন্ধুত্বের চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল। সে লোকটি কাফির কুরাইশদের ধর্মালম্বী ছিল। তারা তাকে নিরাপদ মনে করেন; তাই তারা তাকে তাদের বাহন দুটি সোপর্দ করলেন ও তাকে তিন রাত পরে সওর পর্বতে দ্বারে উপস্থিত হওয়ার জন্য অঙ্গীকার নিলেন। সে তাদের নিকট তাদের দুই বাহন নিয়ে তিন রাত পরে ভোরবেলা হাজির হলো। যখন তারা যাত্রা শুরু করলেন। তাদের সাথে আমির ইবন্ ফুুহাইরা ও দীল গোত্রের পথ প্রদর্শক ও চলল। সে তাদের নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি নদীর কিনারা দিয়ে যাত্রা শুরু করল। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী (স.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বললেন আল্লাহ বলেন, আমি তিন ব্যক্তির পক্ষে কিয়ামতে বাদী হবো। এক ওই ব্যক্তি যে আমার নাম দিয়ে শপথ করে চুক্তি করেছে, অতঃপর সে তা ভঙ্গ করেছে। আর ওই ব্যক্তি যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করেছে, অতঃপর তার মূল্য ভক্ষণ করেছে। আর ওই ব্যক্তি যে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করল। তার থেকে সে যথাযথ কাজ নিল কিন্তু তার মজুরি দিল না। এ ব্যাপারে আরো অনেক দলিল কোরআন ও সুন্নাহতে বিদ্যমান। ফকীহগণ ইজারা বৈধ হওয়ার ব্যাপারে ইজমা পোষণ করেছেন। জামানত শব্দটি মূলত আরবি। এর অভিধানিক অর্থ যিম্মাদারি ও কাফালত গ্রহণ। জামানতের সংজ্ঞায় ডক্টর সাদী বলেন, সাধারণভাবে কোনো ব্যক্তি বা ঋণ বা কোনো স্বত্বের দাবির ক্ষেত্রে মূল ব্যক্তি দায়-দায়িত্বের পাশাপাশি কফিলের দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা। ড. মুহাম্মদ রুয়াস কালা’জী বলেন, Guarantee কোনো দাবির ক্ষেত্রে মূল ব্যক্তির দায়িত্বের পাশাপাশি অপর কারো দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করা। ইংরেজিতে একে গ্যারান্টি বলা হয়। জামানত কয়েক ধরনের রয়েছে। এক কাফালত সূত্রে জামানত। যাকে কাফালতও বলা হয়। তা আবার কয়েক ধরনের হতে পারে। ব্যক্তিকে হাজির করার জামানত। যেমন কেউ বিচারককে বলেন, তাকে জামিন দিন, তাকে হাজির করার দায়িত্ব আমি নিলাম বা অর্থের জামানত বা কেউ কারো প্রাপ পরিশোধের ব্যাপারে কাফালাত গ্রহণ করা। যেমন বলা হয়, সে তোমার পাওনা না দিলে তুমি আমার নিকট থেকে তা গ্রহন করবে বা তোমার পাওনা আদায়ের দায়িত্ব আমি নিলাম। ব্যাংকের এলসির ক্ষেত্রে এই রীতি অনুসৃত হয়। ক্রেতার পক্ষ থেকে ব্যাংক রপ্তানিকারকের পাওনা আদায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এরকম যে কোনো লেনদেনের জন্য জামানত গ্রহণ করা যেতে পারে। জামানত গ্রহন শরিয়তে বৈধ। এর কিছু প্রমাণ নিম্নে তুলে ধরা হল: পবিত্র কুরআনে এসছে, যে তা নিয়ে আসতে পারবে তাকে একটি উটের বোঝা পুরুস্কার দেয়া হবে। আমিই তার দায়িত্ব নিলাম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত