ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের টনক নড়বে কবে

রায়হান আহমেদ তপাদার, গবেষক ও কলামিস্ট, [email protected]
ফিলিস্তিন ইস্যুতে বিশ্বনেতাদের টনক নড়বে কবে

ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি হত্যার সাম্প্রতিক এ ঘটনার দায় শুধু হামাস ও নেতানিয়াহু সরকারের নয়, রক্তের দাগ পশ্চিমাদের হাতেও লেগে রয়েছে। তবে এটা সত্যি যে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার সন্নিকটে ইসরায়েলি বসতিতে হামলা চালিয়েছেন। কিন্তু এ হামলা নির্দিষ্ট কোনো জায়গা থেকে শুরু হয়নি, কিংবা আগে থেকে সতর্কতাও ছিল না। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা কোনো প্ররোচনা দেয়নি। কিন্তু সেটা কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য তা কেউই বলতে পারে না। পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারগুলো ভালো করেই জানে, গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রকৃতপক্ষে কতটা প্ররোচিত করা হয়েছে। কেন না এসব সরকার দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েল যে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে আসছে, তাতে সমর্থন দিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনিদের তাদের জন্মভূমি থেকে বিতাড়ন এবং বাকি যারা আছেন, তাদের বসতিতে বন্দি করে রাখার ঘটনায় পশ্চিমা সরকারগুলো সমর্থন দিয়ে আসছে। গত ১৬ বছরে ইসরায়েলের প্রতি পশ্চিমাদের পৃষ্ঠপোষকতা একবারও দোদুল্যমান হয়নি। এমনকি গাজার পশ্চিমাঞ্চলের ছিটমহলকে ইসরায়েল খোলা আকাশের নিচে বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার থেকে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিবিরে পরিণত করার পরও তাদের সেই সমর্থনে একবিন্দুও চিড় ধরেনি। রেশন করে ফিলিস্তিনিদের খাবার ও বিদ্যুৎ-জ্বালানি দেয়া হয়। জীবনের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনগুলো মেটাতে দেয়া হয় না। ধীরে ধীরে তাদের সুপেয় পানির উৎস বন্ধ করে দেয়া হয়। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসার উপকরণ ও ওষুধপত্র পৌঁছাতে বাধা দেয়া হয়। ফলে এটি কোনোভাবেই অজ্ঞানতাজনিত সমস্যা নয়। ইসরায়েলের এসব অপরাধ সম্পর্কে ঠিক সময়েই জানতে পেরেছে পশ্চিমা সরকারগুলো। নিজেদের দূতাবাসের কর্মকর্তাদের গোপন তারবার্তায় এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে তারা জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্র ইসরায়েলের অপরাধের কথা জেনে আসছে। এখন পর্যন্ত পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা ইসরায়েলিদের আগ্রাসন বন্ধে কিছুই করেননি। কোনো অর্থপূর্ণ চাপ তারা দেননি। উল্টো তারা ইসরায়েলকে অবারিতভাবে সামরিক, আর্থিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে পুরস্কৃত করে আসছেন। মার্কিন নাগরিকরা আবারো কৃষ্ণাঙ্গ প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড় করাচ্ছেন, যখন তারই শ্বেতাঙ্গ পূর্বসূরি ভজকট পাকিয়ে অস্বস্তির কারণ হয়েছেন। বলা দরকার, ট্রাম্পের চার বছরের সার্কাসের পর ২০২০ সালেও এমনই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, ওই সময় সিনেটর কমলা হ্যারিস কৃষ্ণাঙ্গ নারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এখন কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়াইয়ের জন্য প্রধান একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। কমলার পক্ষে সবাই যেভাবে দাঁড়াচ্ছে, তা ২০০৮ সালে বারাক ওবামার ঐতিহাসিক প্রচারণার কথা মনে করিয়ে দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হাত রক্তে রঞ্জিত হওয়ার পর বারাক ওবামা ক্ষমতায় এসেছিলেন। কমলা হ্যারিসও এমন সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করছেন, যখন ওই অঞ্চল গভীর সংকটে নিমজ্জিত এবং সেখান থেকে উত্তরণে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন পথে পরিচালনার তাগিদ রয়েছে। এটা স্পষ্ট, কমলা বুঝতে পেরেছেন, ইসরায়েল বা ফিলিস্তিনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে প্রজন্মের পর প্রজন্মের যে মনোভাব ছিল, তার পরিবর্তন হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু কংগ্রেসে ভাষণ দেয়ার সময় কমলা নিজেও সিনেটে সভাপতিত্ব করতে অস্বীকার করেছিলেন। তিনি নেতানিয়াহুকে বলেছেন, এখন যুদ্ধ শেষ করার সময় এসেছে, এমনভাবে শেষ করা প্রয়োজন, যেখানে ইসরায়েল নিরাপদ, সব জিম্মি মুক্তি পাবে; গাজার ফিলিস্তিনের বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ শেষ হবে এবং জনগণ তাদের মর্যাদা, স্বাধীনতা ও নিজের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের অধিকার পাবে।

বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত সম্প্রতি যেভাবে রায় দিয়েছেন, ইসরায়েল অবৈধভাবে গাজা ও পশ্চিম তীর দখল করছে, তার আলোকে এগুলোই সঠিক পদক্ষেপ। কৃষ্ণাঙ্গ নেতাদের উত্থানে মার্কিন বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতার ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা হয়নি। জর্জ ডব্লিউ বুশ, ইরাক যুদ্ধ এবং বারাক ওবামার নির্বাচন নামে এক গবেষণাপত্রে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গ্যারি সি. জ্যাকবসন দেখিয়েছেন, ইরাক যুদ্ধে বুশের ব্যর্থতা বিষয়ে নেতিবাচক মতামত ওবামার উত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব ফেলেছিল। যুদ্ধের প্রতি সমর্থন ২০০৩ সালে যেখানে ৭৩ শতাংশ ছিল, তা ২০০৮ সালে ৩৩ শতাংশে নেমে আসে। বুশের জনপ্রিয়তা সমান্তরালভাবে কমে যায়, তখন রিপাবলিকান পার্টি বিশেষত তরুণ ভোটারদের সমর্থন হারায়। গাজায় ইসরায়েলের ভয়ংকর প্রচারণায় বাইডেনের সমর্থনের কারণেই কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্টের টিকিট পেয়েছেন। জুন মাসে জো বাইডেন যেভাবে বিতর্ক করেছিলেন, তা তার দল ও ডোনারদের বিব্রত করেছিল। তাদের অনেকেই তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, বিশেষ করে যখন তিনি নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বলতে অস্বীকার করে ইসরায়েলে আরো অস্ত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী হিসেবে নিন্দা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের বিব্রতকর বিতর্ক ডেমোক্র্যাটদের যতটা ক্ষতি করেছে, এর চাইতে বেশি ক্ষতি করেছে গাজা যুদ্ধে তার নীতি। সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশন পরিচালিত সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, ১০ জনের মধ্যে প্রায় চারজন ভোটারই জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় বাইডেনের আচরণের কারণে তাকে তাদের ভোট দেয়ার সম্ভাবনা কম। স্বতন্ত্র ভোটারদের প্রতি তিনজনের মধ্যে সবাই একই মত পোষণ করেন। এই জরিপের বাইরেও গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনগণের ব্যাপক ক্ষোভ আমরা দেখেছি।

গত বছরের নভেম্বর মাসে এই যুদ্ধের প্রতিবাদে ৩ লাখ মানুষ ওয়াশিংটনের সড়কে নেমে আসে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা যে বিক্ষোভ করেছে, তাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সবচেয়ে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন বলতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন এনএএসিপি ও অন্যান্য সংস্থা স্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। বেশ কয়েকটি রাজ্য, বিশেষত মিশিগানের মতো দোদুল্যমান রাজ্যে সংগঠকরা প্রার্থী মনোনয়নের প্রাথমিক নির্বাচনকালে বহু ডেমোক্র্যাটকে বাইডেনকে সমর্থন দেয়ার পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অনিচ্ছুক ভোটার হিসাবে নাম লেখাতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। সম্প্রতি সাতটি প্রধান শ্রমিক ইউনিয়ন ইসরায়েলে মার্কিন অস্ত্রের চালান বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে এরই মধ্যে কমলা হ্যারিস ফিলিস্তিনিদের জন্য অন্তত একটু বেশি সহানুভূতির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন অপরাধী। তার হোয়াইট হাউসে যাওয়ার অধিকার নেই। তার মানে এই নয় যে, আমরা গাজায় গণহত্যা বন্ধ করার জন্য আর চাপ দেব না। কমলা হ্যারিস সবচেয়ে বড় ভূমিকা যা পালন করতে পারেন তা হলো, গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করা। রাজনৈতিক নেতাদের সবার চোখের সামনে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। আর তাই এত দিন পর এসে কোনো কোনো রাজনীতিবিদ তাদের নিজেদের পাতানো অমানবিক কর্মকাণ্ডের পরিণতি দেখে ভীত হয়ে পিছু হটতে শুরু করেছেন। তাদের যদি সত্যিকার অর্থে কোনো সততা থাকত, তাহলে তারা তাদের রাজনৈতিক কাপুরুষোচিত কর্মকাণ্ডের কারণে নিহত ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনি এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া ও অনাহারে থাকা লাখ লাখ নির্দোষ ফিলিস্তিনির জন্য অশ্রুপাত করতেন।

মানবতার বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ সম্পর্কে আজ পাঠ্যবইয়ে স্কুলপড়ুয়া শিশুদের শেখানো হয়। অতীতের এই ধরনের অপরাধগুলো কীভাবে ঘটতে পারে, তা নিয়ে ভাবতে বলা হয়। সেসব বই থেকে শিক্ষার্থীরা সেই রাজনীতিকদের নাম শিখছে, যারা নৃশংস ঘটনা ঘটিয়েছিলেন বা তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ইতিহাসের বই আজকের সেই নেতাদের ছি ছি করবে, যাদের হাতে এই গণহত্যা বন্ধ করার সুযোগ ছিল; কিন্তু তারা তা না করে উল্টো যুদ্ধে নেমে উল্লাস করার পথ বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের জীবনকে সমানভাবে দেখতে পারা এবং সে অনুযায়ী উভয়ের সঙ্গে ন্যায়ানুগ আচরণ প্রদর্শনের অক্ষমতার জন্য তারা অমর হয়ে থাকবেন। গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থতার জন্য তারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। বিশ্বে এমন রাজনীতিবিদের প্রয়োজন, যাদের সত্যিকার অর্থে উত্তেজনা প্রশমন ও কূটনীতিকে সহজতর করার ক্ষমতা ও ইচ্ছা আছে। কিন্তু তার বদলে তাদের যুদ্ধের তৃষ্ণা আমাদের সবার জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। যুক্তরাজ্য সরকার লড়াইয়ের শুরুতেই উভয় পক্ষকে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানাতে পারত। তার বদলে তারা বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ ইয়েমেনের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা শুরু করেছে এবং ইসরায়েলে অস্ত্র রপ্তানি দ্বিগুণ করার নীতি নিয়েছে। যা সত্যিকার অর্থেই দুঃখজনক। যুক্তরাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ প্রশ্রয় ও মদদের কারণে ইসরায়েল সত্যিকারের দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। তবে কানাডা, নেদারল্যান্ডস, জাপান, স্পেন ও বেলজিয়ামের মতো দেশ ইসরায়েলের এই আচরণের কারণে তেল আবিবের কাছে অস্ত্র বিক্রি স্থগিত করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েলের দুর্বৃত্তায়নকে প্রভাবশালী দেশগুলো স্বীকার করতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, যে কারো পক্ষে আশা করা সম্ভব, খুব শিগগিরই ইসরায়েল তার মিত্রদের কাছে, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অসহনীয় বোঝা হয়ে পড়বে এবং এটিই ফিলিস্তিনের মুক্তির পথ খুলে দেবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত