ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব

দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ানো দরকার
ভয়াবহ বন্যার তাণ্ডব

গত কয়েকদিনের অবিরাম বৃষ্টিতে এমনিতেই দেশের নিম্নাঞ্চলসমূহ প্লাবিত হতে শুরু করেছিল। এর মধ্যে ভারত ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীর প্রায় সবগুলো বাঁধের স্লুইসগেট আকস্মিকভাবে খুলে দেয়ায় এই মুহূর্তে গ্রেটার নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্তত ৯টি জেলা ভয়ংকর এক বন্যা পরিস্থিতির সম্মুখীন। এত দ্রুততার সঙ্গে এসব এলাকায় বন্যার পানি প্রবেশ করেছে যে, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাস্তা ও বাড়িঘর তলিয়ে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে লাখ লাখ পরিবার। ফেনী-নোয়াখালীর কিছু কিছু এলাকায় টিনের ঘরের চাল এবং একতলা ভবন পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়ার তথ্যচিত্র পাওয়া যাচ্ছে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ এক নজিরবিহীন বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল। এরপর প্রতিদশকেই বড় বন্যার অভিজ্ঞতা আমাদের থাকলেও এবারের বন্যা ৩৬ বছর আগের বন্যার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশে বন্যার কারণ আন্তর্জাতিক নদী আইনের বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করে অভিন্ন নদীর উপর আধিপত্যবাদী ভারতের একতরফা বাঁধ নির্মাণ, যথেচ্ছ পানিপ্রত্যাহার এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা প্রকল্প চালুর কথা বলে সেই ১৯৭৪ সালে একতরফা ফারাক্কা চালুর মধ্য দিয়ে ভারতের পানি আগ্রাসন শুরু হয়। এরপর একের পর এক প্রায় সবগুলো অভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে ভারত। পানি নিয়ে ভারতের আধিপত্যবাদী মনোভাবের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদী, নৌপরিবহন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীববৈচিত্র, কৃষি অর্থনীতি ও খাদ্য নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। পতিত স্বৈরাচার হাসিনা রিজিমের সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে ভারতের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সম্ভাব্য সবকিছু বিনা বাক্যব্যয়ে আদায় করে নিলেও গঙ্গা ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতে তারা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামে চলমান ভয়বহ বন্যার দুর্যোগ যতটা না প্রাকৃতিক, ভারতের আধিপত্যবাদী নীতির আওতায় পানি আগ্রাসন তার চেয়ে বেশি দায়ী।

দেড় দশকের মাফিয়াতান্ত্রিক লুটপাটে দেশের অর্থনীতি ভেতর থেকে ফোঁকলা হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে নির্লজ্জ ফ্যাসিবাদী দলীয়করণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দেশকে চরম ভঙ্গুর অবস্থায় ঠেলে দিয়ে হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকেই তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক মোদির ছত্রছায়ায় বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ধারাবাহিক তৎপরতা দেখা গেছে। দেড়মাস ধরে রাজপথে ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মুখে সরকার ও প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দেশে এক ধরনের স্থবিরতা ও অচলাবস্থা দেখা দিয়েছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসার আগেই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি নতুন সরকারের জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। বন্যার্ত এলাকাগুলো এখনো ক্রমাবনতিশীল। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর দুর্ভোগে পড়ে উদ্ধার ও ত্রাণের অপেক্ষায় রয়েছে। খেতের ফসল, গোলার ধান-চাল, ঘর-বাড়ি, সহায়-সম্পদ আকস্মিক বাণের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর ন্যূনতম আশ্রয় ও খাদ্য-পানীয়ের চরম সংকটে পতিত হয়েছে তারা। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টিপাতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বন্যা দেখা দেয়ায় ফারাক্কাসহ উজানের বাঁধের সবগুলো স্লুইস গেট ছেড়ে দেয়ায় অভাবনীয় পানির তোড়ে অনেকগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ জনপদ পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলো এরই মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কোথাও কোথাও আশ্রয় নেয়ার মতো কোনো শুকনো বা উঁচু জায়গা নেই। বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় বন্যা উপদ্রুত সবচেয়ে খারাপ এলাকাগুলোর প্রকৃত অবস্থার তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বন্যা উপদ্রুত এলাকায় মোবাইল ইন্টারনেট ফ্রি করে দেয়ার ঘোষণা দিলেও বিদ্যুৎ না থাকায় তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিকল্প ব্যবস্থায় তথ্য ও যোগাযোগ নেটওয়ার্ক চালু রাখার উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক।

সামগ্রিক অর্থে একটি ভগ্নস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে দেশকে স্থিতিশীল করার প্রয়াস চালাচ্ছে সরকার। এহেন বাস্তবতায় এমন ভয়াবহ বন্যার দুর্যোগ নতুন সরকার ও দেশের মুক্তিকামী মানুষের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী সরকারের পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে শত শত মানুষের মৃত্যুর রেশ কাটতে আরো অনেকদিন সময় লাগবে।

এরই মধ্যে আকস্মিক বন্যায় বেশকিছু মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। শিশু-বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষগুলোকে যথাশীঘ্র উদ্ধার করে আশ্রয় ও প্রয়োজনীয় সহায়তা নিশ্চিত করতে না পারলে আরো অনেক মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাতির এই ক্রান্তিকালে শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে এতবড় দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এই মুহূর্তে দেশের প্রত্যেক ধনী ও সামর্থ্যবান মানুষকে আর্ত মানবতার সেবায় এগিয়ে আসতে হবে। আটকে পড়া বন্যার্তদের উদ্ধার, আশ্রয় ও জরুরি খাদ্য সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী গণআন্দোলন পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। সেই ঐক্যকে কাজে লাগিয়ে জাতির সংকটকালীন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এই বন্যা শুধুমাত্র একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। এটি মানব সৃষ্ট দুর্যোগও বটে। এর পেছনে রয়েছে প্রতিবেশী দেশের আধিপত্যবাদী রাজনীতি। অতএব, এর ধারাবাহিকতায় আরো অনেক কিছু মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিতে হবে। খাদ্য মজুদ, খাদ্য নিরাপত্তা ও বাজার সিন্ডিকেটের উপর তীক্ষè নজর রাখতে হবে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি এবং আকস্মিকভাবে ভারত থেকে চালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য রপ্তানি বন্ধের মতো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে আগেই বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সাগরে নিম্নচাপ ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলেও বন্যার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। কুমিল্লা ও ফেনীর অস্বাভাবিক বন্যার পানি ঢাকাসহ মধ্যাঞ্চলে বিস্তৃত হলে এর প্রভাব সারাদেশেই পড়বে। আমাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কা মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। এখন দেশের স্থানীয় প্রশাসনে টালমাটাল অবস্থা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে যারা দাায়ত্বশীল ভূমিকা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবেন, তাদেরকে জনগণ মনে রাখবে। এই মুহূর্তে পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি দেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও কোস্ট গার্ডকে সর্বোচ্চ পরিষেবা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। এই দুর্যোগকালে পতিত স্বৈরাচারের এজেন্টরা যেন দেশে পরিকল্পিত গোলযোগ সৃষ্টি করে ফায়দা হাসিলের ষড়যন্ত্র করতে না পারে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত