ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আধুনিক সমাজের অগ্রসৈনিক প্রজন্ম জেড

ড. মতিউর রহমান, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
আধুনিক সমাজের অগ্রসৈনিক প্রজন্ম জেড

প্রজন্ম একটি সামাজিক ধারণা, যা নির্দিষ্ট সময়কালে জন্ম নেয়া মানুষের একটি গোষ্ঠীকে বোঝায়, যারা সাধারণভাবে একটি নির্দিষ্ট সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বড় হয়ে ওঠে। প্রজন্মের নামকরণ এবং তাদের বৈশিষ্ট্যগুলো বোঝার মাধ্যমে আমরা একটি সমাজের পরিবর্তন, অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের প্রবণতা বুঝতে পারি।

প্রজন্মের শ্রেণিবিভাগ সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে জন্ম নেয়া মানুষের অভিজ্ঞতা ও পরিবর্তনশীলতা প্রতিফলিত করে। বিভিন্ন প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পারি কীভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন তাদের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।

গ্রেটেস্ট জেনারেশন বা জিআই জেনারেশন, যারা ১৯০১ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের জীবনকাল ছিল বৃহত্তর মহামন্দা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। এই প্রজন্মের সদস্যরা কঠোর পরিশ্রম এবং দেশের প্রতি অনুগত মনোভাবের জন্য পরিচিত। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হয়ে শিখেছিল কীভাবে কঠোর পরিশ্রম এবং দৃঢ়তা দিয়ে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।

সাইলেন্ট জেনারেশন, যারা ১৯২৮ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের পরিচিতি ‘নীরব প্রজন্ম’ হিসেবে। তারা সরকার ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে খুব বেশি প্রতিবাদ জানায়নি। তাদের শৈশব ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু তারা প্রায়শই নিরাপদ ও স্থিতিশীল কর্মজীবনের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। তাদের জীবনসঙ্গতি তাদের কর্মদক্ষতা এবং পরিবারকে সমর্থন দেয়ার প্রবণতা দ্বারা চিহ্নিত।

বেবি বুমার জেনারেশন, যারা ১৯৪৬ থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের ‘বুম’ নামটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের জনসংখ্যার বৃদ্ধি নির্দেশ করে। এই প্রজন্মের সদস্যরা সামাজিক পরিবর্তন, নাগরিক অধিকার আন্দোলন এবং ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় বড় হয়েছেন। তারা প্রগতিশীলতা, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং ভোগবাদিতাসহ একটি উদ্দীপক জাতীয় মনোভাবের জন্য পরিচিত।

জেনারেশন এক্স, যারা ১৯৬৫ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তাদের পরিচিতি ‘বেবি বাস্টারস’ হিসেবে। তাদের জন্মহার বেবি বুমারদের তুলনায় কম ছিল এবং তারা প্রযুক্তিগত ও সামাজিক পরিবর্তনের সময় বড় হয়েছেন। এই প্রজন্মের সদস্যরা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সন্দেহপূর্ণ এবং স্বনির্ভরতার প্রতি আগ্রহী। তাদের জীবনকাল ছিল পরিবর্তনের এবং নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সাক্ষী।

মিলেনিয়ালস বা ওয়াই জেনারেশন, যারা ১৯৮১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন, তারা একটি যুগান্তকারী সময়ে বড় হয়েছেন। তাদের শৈশব ছিল ডিজিটাল প্রযুক্তির উন্মোচনের সময় এবং তারা ৯/১১ আক্রমণ ও গ্রেট রিসেশনের প্রভাব অনুভব করেছেন। এই প্রজন্মের সদস্যরা প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত এবং সামাজিক ও পরিবেশগত ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রজন্ম জেড হলো একটি নতুন প্রজন্ম, যার ১৯৯৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছে। এটি ডিজিটাল যুগের প্রথম প্রজন্ম, যারা ছোটবেলা থেকেই ইন্টারনেট, স্মার্টফোন এবং সামাজিক মিডিয়া দ্বারা প্রভাবিত।

তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রযুক্তি রয়েছে এবং তারা এই প্রযুক্তির সাথে একটি অদ্ভুত স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে।

প্রজন্ম জেড ধারণাটি প্রথম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, তবে এটি মূলত একটি সোশ্যাল ও ডেমোগ্রাফিক শ্রেণিকরণের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রজন্ম জেডের ওপর আলোচনা ও গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০১০ সালের দিকে, যখন বিশেষজ্ঞরা ও গবেষকরা ডিজিটাল যুগে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন।

এই ধারণার প্রবর্তক হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কিছু গবেষক ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রজন্ম জেডের ধারণার প্রাথমিক বিশ্লেষণ ও বর্ণনা মার্কিন গবেষক এবং ডেমোগ্রাফিক বিশ্লেষকদের দ্বারা করা হয়। এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ও আচরণ বিশ্লেষণের জন্য বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে।

মিডিয়া সংস্থা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং অন্য প্রতিষ্ঠান প্রজন্ম জেড সম্পর্কে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব, সামাজিক আচরণ এবং অর্থনৈতিক প্রবণতা সম্পর্কে তথ্য প্রদান করা হয়েছে।

প্রজন্ম জেডের আচরণ ও ক্রয় প্রবণতা বিশ্লেষণ করতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ও বিপণন সংস্থা তাদের গবেষণায় এ ধারণাটি ব্যবহার করে। এই সংস্থাগুলো বাজারের প্রবণতা এবং গ্রাহক আচরণ বুঝতে প্রজন্ম জেডের বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করে।

এভাবে, প্রজন্ম জেডের ধারণাটি একটি যৌথ প্রচেষ্টা ও গবেষণার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা মার্কিন গবেষক, মিডিয়া সংস্থা এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। প্রজন্ম জেডের সদস্যরা ডিজিটাল নেটিভ হিসেবে পরিচিত।

তারা এমন একটি পরিবেশে বড় হয়েছে যেখানে তথ্যের প্রবাহ সর্বদা অবিরাম এবং প্রযুক্তি একটি অভ্যস্ত অংশ। তাদের বড় হওয়ার সময়ে সামাজিক মিডিয়া, স্মার্টফোন এবং দ্রুতগতির তথ্যপ্রবাহ একটি অভ্যস্ত অংশ হয়ে উঠেছে।

প্রজন্ম জেডের সদস্যরা জন্ম থেকেই ডিজিটাল ডিভাইসের সাথে পরিচিত, যা তাদের যোগাযোগের পদ্ধতি, সামাজিক আচরণ এবং দৈনন্দিন জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে।

প্রজন্ম জেডের শিশুবেলায় মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট এবং ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার তাদের এমন একটি পৃথিবীতে বড় করেছে যেখানে তারা কল্পনা করে যে, প্রযুক্তি সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। এই প্রজন্ম সামাজিক নেটওয়ার্কিং সাইট, ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম এবং বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে তাদের অনুভূতি এবং মতামত প্রকাশ করে।

প্রজন্ম জেডের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো তাদের সামাজিক সচেতনতা এবং অন্তর্ভুক্তি। এই প্রজন্ম জাতিগত, সাংস্কৃতিক এবং লিঙ্গ বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয় এবং এই বৈচিত্র্যের প্রতি একটি ইতিবাচক মনোভাব রাখে। তারা সমাজের বিভিন্ন অংশের সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জগুলো বোঝে এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য কাজ করে।

এছাড়া, প্রজন্ম জেড অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবেশবান্ধব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সচেতন। তারা পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়ন সম্পর্কে সচেতন ও তাদের জীবনযাত্রার মধ্যে এই বিষয়গুলোর প্রতিফলন ঘটে। তারা পরিবেশবান্ধব পণ্যের প্রতি আগ্রহী এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্দোলনগুলোতে অংশগ্রহণ করে।

প্রজন্ম জেডের জীবনে প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা স্মার্টফোন, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে এবং যোগাযোগ করে। এই প্রযুক্তি তাদের জীবনযাত্রার অঙ্গ হয়ে উঠেছে এবং তারা বিভিন্ন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের মতামত প্রকাশ করে।

এই প্রজন্মের সদস্যরা প্রযুক্তির সহায়তায় নতুন ধরনের চাকরি, শিক্ষা এবং বিনোদনের সুযোগগুলো গ্রহণ করেছে। তারা অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে সহজেই জ্ঞান অর্জন করে এবং ডিজিটাল কর্মসংস্থানের সুযোগ লাভ করে।

অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং, গিগ ইকোনমি এবং ডিজিটাল মার্কেটিং এই প্রজন্মের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে উদিত হয়েছে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রজন্ম জেড বিভিন্ন পদ্ধতি এবং নতুন ধরনের সুযোগের প্রতি আগ্রহী। তারা অনলাইন কোর্স, ভার্চুয়াল লার্নিং এবং ই-লার্নিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করে। এই প্রজন্মের সদস্যরা প্রথাগত শিক্ষা পদ্ধতির বাইরেও নতুন শিক্ষামূলক পদ্ধতি অনুসন্ধান করে এবং তাদের পছন্দের ক্ষেত্রের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে চেষ্টা করে।

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে, প্রজন্ম জেড বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অনেক চাকরি এবং অর্থনৈতিক সুযোগ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। তবে, এই প্রজন্ম প্রযুক্তির সাথে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং উদ্ভাবনী মনোভাবের মাধ্যমে নতুন সুযোগ সৃষ্টির জন্য প্রস্তুত। তারা উদ্যোক্তা মনোভাব গ্রহণ করে এবং নতুন ব্যবসার সুযোগ সৃষ্টি করে।

প্রজন্ম জেড সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। তারা বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত সমস্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে এবং পরিবর্তনের জন্য কাজ করেছে।

এই প্রজন্ম সামাজিক মিডিয়ার মাধ্যমে সংগঠন এবং প্রচারণার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে ও সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য প্রচারণা চালায়।

তাদের রাজনৈতিক প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। প্রজন্ম জেড রাজনৈতিক বিষয়গুলোর প্রতি গভীর আগ্রহ এবং সচেতনতা রাখে। তারা নির্বাচন এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে এবং তাদের মতামত প্রকাশের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে। তাদের দ্বারা প্রভাবিত নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং সামাজিক আন্দোলন ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে পারে।

প্রজন্ম জেডের ভবিষ্যৎ প্রবণতা সমাজ এবং অর্থনীতির বিভিন্ন দিক প্রভাবিত করবে। তারা প্রযুক্তির উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে এবং নতুন ধরনের সমাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবণতা তৈরি করবে। তাদের ডিজিটাল দক্ষতা, সামাজিক সচেতনতা এবং উদ্ভাবনী মনোভাব ভবিষ্যতের সমাজের গঠনমূলক অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে।

প্রজন্ম জেড একটি পরিবর্তনশীল এবং শক্তিশালী প্রজন্ম যা আধুনিক সমাজের পরিবর্তন এবং উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাদের প্রযুক্তি, সামাজিক সচেতনতা এবং উদ্ভাবনী মনোভাব সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে।

এই প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য এবং তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব ভবিষ্যতের সমাজ এবং সংস্কৃতির গঠনমূলক অংশ হয়ে উঠবে। তাই, প্রজন্ম জেডের বিশ্লেষণ আমাদের তাদের সম্ভাবনা এবং চ্যালেঞ্জগুলোর সঠিক মূল্যায়ন করতে সাহায্য করবে এবং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে সাহায্য করবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত