ছাত্র আন্দোলন এবং বিপ্লবী হয়ে ওঠা

কাজী খাদিজা আক্তার

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৪ সালের সাধারণ ছাত্রদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া এবং এই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নিয়ে এক দফা দাবির মাধ্যমে সরকারের পতন এবং বিজয়ের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বপালনের জন্য আন্দোলনের দুই সমন্বয়কের দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ, এই যে স্ক্রিপ্ট বিহীন এতোবড়ো এক সাহসী ইতিহাস গড়ে তোলা তা কেবল আমরা সাধারণ জনতা সিনেমাতেই উপভোগ করেছি। দেশের কোটি কোটি মানুষের চোখে মুখে বিস্ময়। এ এক নতুন ইতিহাস, নতুন বাংলাদেশ, অবাক পৃথিবী। ইতিহাসে প্রথম ছাত্র আন্দোলন হয় ১৬০ খ্রিস্টাব্দে চীনে। সেখানে ইমপেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তখন সরকারের কয়েকটি নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নামেন এবং তাদের আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন কিছু গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী। আন্দোলন ব্যাপক সারা ফেললেও সরকার এই আন্দোলন কঠোর হস্তে দমন করে। ৩০ হাজার মানুষের এই ছাত্র আন্দোলনকে দমিয়ে দিয়ে ১৭২ জন শিক্ষার্থীকে কারগারে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন চালায় সরকার। যুগে যুগে এমন অনেক ছাত্র আন্দোলন স্থান পেয়েছে ইতিহাসের পাতায়। কখনো সফল, কখনো বিফল হলেও সামনের পথ প্রসারিত করে দিয়েছে ভবিষ্যৎ ছাত্র জনতার জন্য। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররা যুগে যুগে অত্যাচার, অবিচার, অসমতার বিরুদ্ধে এবং অধিকারের পক্ষে আন্দোলন করেছে। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮-এর কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং ’২৪-এর বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলন। তবে আমাদের বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের বিজয় দেখিয়ে দিয়েছে কীভাবে একতাবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়। বিপ্লবী হয়ে উঠতে হয়। ২০২৪ সালের ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই সংগঠনটি সৃষ্টি হয়। কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন পরবর্তীতে অসহযোগ আন্দোলনে রূপ নেয় এবং প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য রাজপথে নেমে আসে। গত ১৬ জুলাই আবু সাঈদের সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে শহীদ হওয়ার পর আন্দোলনের দানা বাঁধে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র জনতার মধ্যে। আরো বেশি বিস্ফোরিত হয়। ধীরে ধীরে আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। আর যেখানে দেশের সর্বোচ্চসংখ্যক জনতা এক হয় সেখানে ন্যায়সংগত কারণে জনতাই সঠিক এবং বিজয়ী বলে সাব্যস্ত হয়। এই আন্দোলনকে বিপ্লব বলেও অবহিত করা যায়। কারণ বিপ্লবের মাধ্যমেই আমূল পরিবর্তন হয়। এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন। প্রথমটি এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন। দ্বিতীয়টি একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার। ছাত্রদের এই আন্দোলনে মূলত দেশ সংস্কারের প্রতিজ্ঞাই প্রস্ফুটিত হয়। তাই বিপ্লব ঘটেছে রাজপথে, বিপ্লব ছড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিপ্লব দেখেছি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের চোখে মুখে। বিপ্লবী হয়েছে কোটি প্রবাসী বাঙালি। সরদার ফজলুল করিম তার ‘এরিস্টটল-এর পলিটিক্স’ বইটিতে বিপ্লব কখন এবং কেন হয় তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘যারা সমতার জন্য উদগ্রীব তারা যদি বিশ্বাস করে যে, তারা যদিও অধিকতর যারা পাচ্ছে তাদের সমান তথাপি তারা কম পাচ্ছে তবে তারা বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটায় ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত তারা যখন নির্দয় এবং অত্যাচারী হয়ে ওঠে এবং যখন তারা নিজেরা মুনাফা অর্জন করতে থাকে তখন তারা যেমন পরস্পরের বিরুদ্ধে আঘাত করে, তেমনি যে শাসনব্যবস্থা তাদের ক্ষমতার উৎস তার বিরুদ্ধেও তারা আঘাত হানে। এরপর আসছে অত্যধিক ক্ষমতার কথা। এক বা একাধিক ব্যক্তি একেবারে অনুপাতহীনভাবে কিংবা নাগরিক সংস্থার সংগে বিষমভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে থাকে তখন এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।