জনপ্রশাসনকে গতিশীল হতে হবে

মন্ত্রণালয়গুলোর তৎপরতা দরকার

প্রকাশ : ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিগত সাড়ে ১৫ বছরে স্বৈরচার শেখ হাসিনা সরকার জনপ্রশাসন দলীয়করণ এবং তার আজ্ঞাবহ করে গড়ে তুলেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তার অকস্মাৎ পতন এবং পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জনপ্রশাসনে তার অনুগতরা যারপরনাই বিস্মিত, হতবাক, মূঢ় এবং হতাশ হয়ে পড়েছে। কারো কারো মধ্যে ক্ষোভ যেমন রয়েছে, তেমনি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার যাতে ঠিকমতো কাজ করতে না পারে কিংবা ব্যর্থ হয়, সেই ষড়যন্ত্রও চলমান রয়েছে। জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতেও দায়িত্ব পালনে এক ধরনের শৈথিল্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, প্রশাসনে স্বৈরাচারের দোসর, যারা রাষ্ট্রের কর্মচারি এবং জনগণের সেবক, তারা এখনও শেখ হাসিনার পতনের শোক কাটিয়ে সম্বিত ফিরে পাচ্ছে না। কাজে-কর্মে তাদের তেমন মনোযোগ নেই। ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে দেশের যে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনাতা’ অর্জিত হয়েছে, এতে তারা যেন নাখোশ। তারা স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে চলার কথা ভুলতে পারছে না। অথচ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ অর্জনের পরপরই দেশ গঠনে নেমে পড়েছে। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পুলিশ যখন গর্তে ঢুকে গেছে, তখন এই শিক্ষার্থীরাই সড়কে থেকে ট্র্যাফিক কাজ সামলেছে। সড়কের শৃঙ্খলা বজায় রাখাসহ পরিবেশ পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে নিরলস কাজ করেছে। তাদেরকে সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহায়তা করেছে। অন্যদিকে, পুলিশ বাহিনী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দাবি মেনে না নিলে কাজে যোগ দেবে না বলে গো ধরে বসে থাকে। শুধু পুলিশই নয়, জনপ্রশাসনে কর্মরতরাও একই ধরনের আচরণ করতে থাকে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে কোনো কিছু অবহিত না করেই ভারত বাঁধ খুলে দিয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলের ১১ জেলাকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি ও লাখ লাখ মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি করেছে। দেশের মানুষ ভারতের এ আচরণকে ষড়যন্ত্র এবং পানি আগ্রাসন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। হঠাৎ বন্যায় আক্রান্তদের জন্য দেশের সকল মানুষ যেভাবে বন্যার্তদের উদ্ধার এবং সাহায্যার্থে ঝাপিয়ে পড়েছে, সহমর্মী হয়ে ছুটে যাচ্ছে, তার ছিঁটেফোটাও জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বন্যার পূর্বাভাস দিতে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আবহাওয়া অধিদফতর ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেন পূর্বাভাসি দিতে ব্যর্থ ও যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাদের ঘাড়ে এখনো পতিত স্বৈরাচারী সরকারের ভূত চেপে আছে। লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার গড়ে তোলা দলীয় জনপ্রশাসন অন্তর্র্বতী সরকার গঠনের পর একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যায়। প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে কর্মচারিরা কাজে যোগদান করতে গড়িমসি করেছে। অনেকে অফিসে এসে কোনোরকমে হাজিরা দিয়ে চলে গেছে। অর্থাৎ তারা অন্তর্র্বতী সরকারকে চরমভাবে অসহযোগিতা করার মনোভাব দেখিয়েছে। এর বিপরীতে তারা নিজেদের নানা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। অথচ স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যখন শিক্ষার্থীসহ আপামর জনসাধারণ জীবন দিয়ে আন্দোলনরত, তখন জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিরা তাতে যোগ দেয়া দূরে থাক, কীভাবে শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখা যায়, এ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। বলা যায়, জনগণের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছিল। যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, তখনও তারা নানা ধরনে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে নানা ব্যানারে দাবি-দাওয়া নিয়ে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে এবং বাইরে আন্দোলন করা শুরু করে। এর অর্থ হচ্ছে, অন্তর্র্বতী সরকার যাতে স্থিতিশীল হতে ও ঠিক মতো কাজ করতে না পারে। দেশে এখন যে ভয়াবহ বন্যা চলছে, তা নিয়ে জনপ্রশাসনের তেমন কোনো উদ্বেগ ও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তারা যে রাষ্ট্রের কর্মচারি বা জনগণের সেবক, তা ভুলে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের শোকে যেন পাথর হয়ে বসে আছে। সব দেশেই নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হলে প্রশাসনে রদবদল হয়। এটা স্বাভাবিক বিষয়। এতে আতঙ্কিত বা ভীত হওয়ার কিছু থাকে না। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফসল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখা যাচ্ছে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সাজিয়ে যাওয়া ও তার অনুগত প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তাদের উপর অর্পিত রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রতি অনুগত না হয়ে, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার অনুগত কর্মকর্তা ও কর্মচারি হিসেবে কাজ করা। তারা যদি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য হয়ে পেশাদারিত্বের সাথে কাজ করত, তাহলে তাদের ভীত হওয়া কিংবা রাষ্ট্রীয় কাজে শৈথিল্য প্রদর্শন করার কোনো কারণ থাকত না। পতিত স্বৈরাচার সরকারের হয়ে কাজ করার ফলে তারা অন্তর্র্বতী সরকারকে নানাভাবে অসহযোগিতা করছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। ভয়াবহ বন্যায় যেখানে শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষ দুর্গতদের উদ্ধার ও ত্রাণকার্যক্রমে ঝাপিয়ে পড়েছে, সেখানে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের কোনো বিচলন দেখা যাচ্ছে না। এটা তাদের নিষ্ঠুর স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার মনোভাবেরই বহিঃপ্রকাশ। তা নাহলে, ত্রাণ ও দুযোর্গ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়গুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারিদের মধ্যে তেমন কোনো তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না কেন? জনপ্রশাসনে কেন স্থবিরতামূলক আচরণ দেখা যাবে? অন্যদিকে, সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনী স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্যার্তদের উদ্ধার ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তারা জনগণের অকুণ্ঠ প্রশংসা ও ভালবাসা পাচ্ছে।

আমরা বার বার বলে আসছি, স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার রেখে যাওয়া দলীয় জনপ্রশাসন থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সংস্কার তথা রাষ্ট্র মেরামতের কাজ করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্র্বতী সরকারকে যতদিন প্রয়োজন ততদিন সময় দিতে হবে। সাড়ে ১৫ বছরের রাষ্ট্রযন্ত্রের জঞ্জাল দূর করে প্রকৃত রাষ্ট্রীয় যন্ত্রে পরিণত করা সহজ কাজ নয়। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ ছাত্র-জনতার বহুল আকাঙ্ক্ষার রাষ্ট্র গঠনের কাজ নিরলসভাবে করে যাচ্ছে। তারা ছুটির দিন শুক্র ও শনিবারও কাজ করছে। তাদের এই কাজে সহায়তা করা জনপ্রশাসনের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের সর্বাত্মক সহায়তা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদেরকে পতিত স্বৈরাচার সরকারের মাইন্ডসেট থেকে বের হয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ ও জনআকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করতে অধিক তৎপরতার সাথে কাজ করতে হবে। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকে জনগণের সেবায় আত্মনিবেদিত হয়ে তাদের সমস্যা নিরসন ও সুবিধা-অসুবিধা দেখতে হবে। ছাত্র-জনতা যেভাবে নতুন করে দেশগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, জনপ্রশাসনকেও সেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য প্রদর্শন কিংবা ষড়যন্ত্র ছাত্র-জনতা বরদাশত করবে না। অন্তর্র্বতী সরকারকেও এ কথা স্মরণে রেখে কাজ করতে হবে, ষড়যন্ত্র যেমন রয়েছে, তেমনি তা চলমান রয়েছে। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা এবং দমন করেই তাকে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে।