ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

১ সেপ্টেম্বর : গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন

আসাদুল করিম (শাহীন)
১ সেপ্টেম্বর : গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনে শহীদ জিয়ার রাজনৈতিক দর্শন

বাংলাদেশের রাজনীতির এক চরম সংকটময় মুহূর্তে যখন বাকশালী একনায়কতন্ত্রের অবসানের পরেও এদেশের রাজনীতি কোনো সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ করতে পারছিল না, সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্ত রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে-বাইরে ক্রমাগত কোন্দলের কারণে ভেঙে খান খান হচ্ছিল, তখনই শহীদ জিয়া এলেন, রাজনীতির বদ্ধঘরে সূর্যের আলো ছড়াতে, তারই নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি।

জাতীয়তাবাদী দল গঠনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সব অনিশ্চয়তার কালো মেঘ দূরীভূত হয়। জাতি প্রভাত দিনের রাঙা আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ঘোষণাপত্রের শুরুতে এই কথাগুলো লেখা আছে- ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালী ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমির এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ও সুরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি। বিবর্তনশীল ইতিহাস এবং সাম্প্রতিক জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে, ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহত গণপ্রচেষ্টা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের কালজয়ী রক্ষাকবচ। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অতন্দ্র প্রহরী হচ্ছে যথাক্রমে :

১। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে অনুপ্রাণিত ও সংহত ইস্পাতকঠিন গণঐক্য। ২। জনগণভিত্তিক গণতন্ত্র ও রাজনীতি এবং ৩। ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত জনগণের অক্লান্ত প্রয়াসের ফলে লব্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি- আত্মনির্ভরশীলতা ও প্রগতি।

সুদৃঢ় এবং অভেদ্য জাতীয় ঐক্যবোধ এবং জাতীয় অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা না থাকলে সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদের গ্রাস থেকে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষা করা দুঃসাধ্য। জাতীয় ঐক্যের অভাব, বিশেষত দেশপ্রেমিক শক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে সমঝোতা ও মৌলিক ঐক্যবোধের অভাব বাংলাদেশের মতো আপাত দরিদ্র অথচ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র সহজেই বৈদেশিক আধিপত্যবাদ এবং অভ্যন্তরীণ বিধ্বংসী প্রক্রিয়ার শিকারে পরিণত হতে পারে। কয়েক বছর আগের ইতিহাস এই বিশ্লেষণের সত্যতাকে প্রমাণ করেছে। আমাদের জাতীয় অনৈক্য ও বিভেদের সুযোগ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী ও সম্প্রসারণবাদী শক্তিসমূহ বাংলাদেশের উন্নতি ও প্রগতির পথ রুদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার মাধ্যমে আমাদের জাতিকে বিভ্রান্ত, নিরুৎসাহ ও পশ্চাৎগামী করারও প্রয়াস পেয়েছে। এসব অশুভ শক্তির তৎপরতার ফলে আমাদের সার্বভৌমত্ব খর্ব হয়ে পড়েছিল, কৃষি ও শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন হয়েছিল মারাত্মকভাবে ব্যাহত, রাজনীতি হয়েছিল বিদেশি প্রভুদের সেবাদাস, পররাষ্ট্রনীতিতে এসেছিল দাসসুলভ স্থবিরতা, সমাজ জীবনে নেমে এসেছিল মূল্যবোধের চরম সংকট এবং সর্বগ্রাসী বিভ্রান্তি, শিক্ষাঙ্গনে হামলা চালিয়ে সৃষ্টি করেছিল অপরিসীম নৈরাজ্য। এককথায় বাংলাদেশি জাতির স্বাধীন, স্বার্বভৌম সভ্য অস্তিত্ব হয়েছিল মহা-বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের ঐক্যবদ্ধ জাতীয় বিপ্লব এই ভয়াবহ প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে যে নতুন ঊষার আহ্বান জানায় গত আড়াই বছরের অধিককালের পরিসরে তার বলিষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে ১৯৭৮-এর ৩রা জুনের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি নাগরিকের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হওয়ার ফলে জাতীয় ভিত্তিক ঐক্যের ইতিবাচক দিকটি আমাদের জনজীবনে প্রাসঙ্গিকভাবে সংঘবদ্ধ হয়েছে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে জনমুখি রাজনীতিকে মানবমুখি অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের পরম অভিপ্রায় নিয়ে এদেশে একটি নতুন ভোরের সৃষ্টি করেন শহীদ জিয়া, তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। এই দলের জন্য তিনি যে দর্শন ও কর্মসূচি উপহার দিয়েছেন তা হলো-

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক ইস্পাত কঠিন গণঐক্য উৎপাদনের রাজনীতি এবং জনগণের গণতন্ত্র, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা, সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্য দূরীকরণ, মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগ এবং আইনের শাসন, মানবিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন, স্থানীয় সরকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, ন্যায়বিচারভিত্তিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ, দেশের সম্পদের উন্নয়ন ও সদ্ব্যবহার, নারি সমাজের সার্বিক মুক্তি ও প্রগতি জাতি গঠন, সমাজ ও উৎপাদনমুখি কার্যক্রমে যুব শক্তিকে কাজে লাগানো, পল্লী উন্নয়নে অগ্রাধিকার, গণমুখি কৃষি নীতি ও কার্যক্রম, সমবায়ের ভিত্তিতে জাতীয় উন্নয়ন, সৃজনশীল উৎপাদনমুখি এবং গণতান্ত্রিক শ্রম নীতি, সার্বিক জীবনমান উন্নয়নভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, গণমুখি ও জীবন নির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম, উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা, প্রাকৃতিক সম্পদের সদ্ব্যবহার, অনুন্নত এলাকা ও জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য ব্যাপক গণপ্রচেষ্টা, সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সুনিশ্চিতভাবে দেশকে রক্ষা করা, জাতীয় প্রগতি ও সমৃদ্ধির অগ্রসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণ সাধন, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও প্রচার, বাংলাদেশি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ক্রীড়ার বিকাশ, সব ধর্মের শিক্ষা ও অনুশীলন, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সমৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক প্রীতি ও সখ্য গড়ে তোলা। উল্লেখিত বিষয়গুলো হলো, শহীদ জিয়ার বৈপ্লবিক কর্মসূচির প্রধান কৌশল। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য মানুষের এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা কায়েমই ছিল তার স্বপ্ন এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল গঠনের উদ্দেশ্যই ছিল দেশ ও জাতি গঠন। দুশ’ বছর পরাধীন থাকার ফলে জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য সর্বোত্তম প্রচেষ্টা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে তা অর্জন করা। এ দেশের মানুষের অন্তরের প্রবহমান আদর্শকে, জাতীয় স্বাতন্ত্র্য এবং জাতির আত্মপরিচয়কে ভিত্তি করে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তার রাষ্ট্রদর্শনের ফর্মুলাটি প্রণয়ন করেছিলেন তার প্রথম প্রকাশ ১৯৭৮ সনের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয়তাবাদী দল গঠনের মধ্যে জাতি দেখতে পেয়েছিল। শহীদ জিয়া অনুভব করতে পেরেছিলেন, দর্শন ছাড়া কোনো রাজনীতি জনগণের হৃদয়ের গভীরে শিকড় গ্রথিত করতে পারে না। আর যখনই কোনো রাজনীতি জনগণের হৃদয়ে শিকড় গাড়তে ব্যর্থ হয় তখন সেই রাজনীতি যেমন স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করতে ব্যর্থ হয়, তেমনি স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলাও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তিনি স্পষ্টত বুঝতে পেরেছিলেন, দলের দর্শনকে যদি দলীয় কর্মীরা বুঝে উঠতে না পারে তাহলে দলের কর্মসূচি বাস্তবায়ন তো দূরে থাক; সামান্য আঘাত আসলেও দল তা সামলিয়ে উঠতে পারে না। তার ভাষায় ‘দলীয় দর্শন না বুঝবার যে দুর্বলতা তার ফলে আমরা অনেক জায়গায় মার খাচ্ছি এবং আপনাদের মধ্যে অনেকে বিপথগামী হয়ে লাইসেন্স পারমিটের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। কারণ আপনারা ভাবছেন, এই তো সুযোগ, কিছু করে নিই। নইলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। বস্তুত, আমাদের দেশে রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থ ভিত্তিকই ছিলো এবং এখনো আছে। তাই আমরা পার্টির দর্শন ও দেশের স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এখনো শিখিনি।’

তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একটি লিখিত ভিত্তিও দাঁড় করে গেছেন, এ কথা আমরা আগেই বলেছি। কি সেই ভিত্তি? তার ভাষায় ‘আমরা বলি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ। আমাদের আছে জাতিগত গৌরব, রয়েছে সমৃদ্ধশালী ভাষা এবং আছে ধর্মীয় ঐতিহ্য। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে আমরা এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। আমাদের আছে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর এসব স্বাধীনতা যুদ্ধের রক্তাক্ত চেতনায় অবগাহিত। একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে এত উপাদানের সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখা যায়নি।

বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দল গঠনের মধ্যে আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, শোষণমুক্ত প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, জাতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য প্রভৃতি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলের ভিতরে পরিপূর্ণতা লাভ করছে। তাই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের চেতনাকে বুকে ধারণ করেই সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে যেতে হবে। বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন এবং চেতনা থেকে এই দেশের জনগণকে নিজেদের সত্তা রক্ষা এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি রক্ষা করার ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে।

শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী দর্শনের ওপর এটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালু করেন। এসবের ফলে রাজনৈতিক ধ্যান-ধারাণায় ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ একটি অধ্যায় অতিক্রম করে। কিন্তু যেহেতু এই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাংলাদেশের স্বোপার্জিত সাংস্কৃতিক সোসিয়ো-পলিটিক্যাল এবং জিয়ো-পলিটিক্যাল স্বাতন্ত্র্যিক ধারার একটি বাস্তবসঙ্গত উত্তরাধিকার, সেহেতু কেবল রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে সামগ্রিক জাতিসত্তার বিচারে এর একটি রাষ্ট্রনৈতিক রূপরেখা পরিষ্কার থাকা দরকার এবং এইসঙ্গে জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনালোকের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।

আজকের এই বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক সংকটে আমরা শহীদ জিয়ার দর্শনকে চেতনায় ও মননে ধারণ করতে পারি। যখন রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি প্রভুদের নেতৃত্ব প্রকট তখন স্বাদেশিক মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির জাগরণ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আমরা যদি শহীদ জিয়ার আদর্শ ও স্বপ্নকে লালন ও প্রতিপালনে অগ্রসর হই তবে অপশাসকের হাত থেকে দেশের গণতন্ত্রকে সমুদ্ধার সম্ভব হবে। আসুন আমরা শহীদ জিয়ার সেই পছন্দের গানটি আবার গেয়ে উঠি-

প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ

জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।

লেখক : সহ-প্রচার সম্পাদক, বিএনপি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত