ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের সম্ভাবনা

বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের সম্ভাবনা

গত জুলাইয়ের শুরুতে শিক্ষার্থীরা চাকরির কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সামনে রেখে রাজধানীর শাহবাগ চত্বরে নেমে পড়েছিল। তাদের কারো গলায় ঝোলানো ছিল, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’; কারো গলায় ছিল, ‘ভেঙে ফেল, কোটার ঐ শিকল’ লেখা কার্ড ঝুলানো। এগুলো খুব স্বাভাবিক দাবি ও যৌক্তিক আন্দোলন ভেবে তখন কেউ ততটা গা করেনি। কেউ কখনও ভাবেননি যে, এর দ্বারা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা কী বুঝাতে চেয়েছিল এবং আসলেই দেশে কী ঘটতে পারে! আগস্টের পাঁচ তারিখে তাদের ভাবনাটা এমন একটি বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটিয়ে ফেলে জাতিকে নতুন কিছু অন্বেষণের সন্ধান দিতে বিরাট সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিয়েছে, তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের শিকল ভাঙার গান ‘কারার ঐ লৌহ কপাট, ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ অথবা অনুপ্রেরণা সংগীত ‘চল চল চল, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’ অথবা ফররুখের ‘রাত পোহাবার কত দেরী, পাঞ্জেরী’। এ সব বিমূর্ত আহ্বান বাস্তবাতার আঁকরে পরিণত হয়ে আজ আশার আলো দেখাচ্ছে। এগুলো শুধু কবিতার তত্ত্বীয় পংক্তিমালা নয়, যুগে যুগে বার বার এসব কথা ছন্দ হয়ে ফিরে আসে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তরুণের আহ্বানে দীপ্ত শিখা হয়ে। গত ৫, ৬, ৭ আগস্ট তারিখে উন্মত্ত ঘটনাপ্রবাহ দেখে মনে হচ্ছিল, জাতিকে কে পরিচালনা করছে? কোন দিকে যাচ্ছি আমরা? ইত্যাদি।

তখন অনেকের কাছে সবকিছু গোলেমেলে মনে হলেও সংগ্রামী সমন্বয়কারী তরুণদের দৃঢ়চেতা বক্তব্য, সৎসাহস, কণ্ঠের অমিততেজ ও দেহ-মনের সৌষ্ঠব-ভঙ্গিমার সম্মিলিত জোর এবং নৈতিক অবস্থান দেখে শুনে জাতি ধীরে ধীরে তাদের প্রতি আশ্বস্ত হয়ে পড়ে, যা ৮ আগস্ট একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে বাস্তব রূপ নেয়। এর মধ্যিখানে তাদের কেউ টলাতে পারেনি। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাদের সবার বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল সেটা হচ্ছে, তাদের প্রত্যেক সমন্বয়কারীর মধ্যে সুষ্ঠু কো-অর্ডিনেশন এবং অখণ্ড চেতনায় একই সুরে কথা বলার দক্ষতা ও যোগ্যতা। তারা আমাদের প্রিয় ছাত্রছাত্রী। তারা অসীম, অগাধ মেধাবী ও ন্যায়পরায়ণ। কোনো গুজবে তারা কেউ কান দেয়নি। কোনো প্রকার ভয়ভীতি ও প্রলোভনে তারা সাড়া দেয়নি। তারা সবসময় কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের কাছে পরামর্শ নিয়েছে এবং প্রিয় শিক্ষকরা তাদের সবসময় আগলে রেখেছেন। সরকার নানা প্রকার অন্যায়, অত্যাচার চালিয়ে তাদের বিভক্ত করার প্রচেষ্টা চালালেও তারা ছিল দুর্বার, দুর্দম, অনড়।

মৃত্যুকে তারা একবিন্দুও ভয় করেনি। ডিকটেটিভ পুলিশের ভয়ংকর কৌশলের কাছে তারা মাথা নত করেনি, অত্যাচারিত হয়েও মুখ ফুটে বলেনি কোনো কথা। ৩২ ঘণ্টা অনশন করে জানিয়ে দিয়েছে তাদের অবিচল অবস্থানের কথা। ওই কয়দিন অবরুদ্ধ থাকার সময় প্রকাশ করেনি কোনো ধরনের নৈতিক ও মানসিক দুর্বলতা। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষের নজর ছিল তাদের দৃঢ় অবস্থানের উপর। মানুষের অশেষ দোয়া, আশা, ভালোবাসা সবকিছুই তাদের মাতার ওপর মেঘের সুশীতল ছায়া হিসেবে সবসময় বইছিল যেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দল বেঁধে তাদের উদ্ধারের জন্য গিয়ে হেনস্তা হয়েছে ডিবির কাছে। কথা বলতে না পেরে চরম মনোকষ্ট নিয়ে ফিরে এলেও শিক্ষকদের সঙ্গে গোটা জাতি সেই মনের কষ্ট ভাগ করে নিয়ে আন্দোলনকে প্রবল গতিবেগে রূপান্তরিত করে দিয়েছে, যেটা হঠকারী আটককারীদের বোঝার শক্তিতে কুলায়নি। বরং তারা অন্যায় সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বারবার রং ট্রিগার চেপে মানুষের মনকে তিক্ত করে ক্ষমতাসীনদের ভিত উল্টানোকে ত্বরান্বিত করে তুলেছে। এর ফলে শ্যামল-সবুজ বাংলাদেশের বুকে ইতিহাসের এক করুণ, রক্তিম অধ্যায় রচিত হয়ে গেছে। শুরুটা করেছিল অবিশ্বাস্য সাহসী, অমিততেজী শহীদ আবু সাঈদ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে মডার্ন চত্বরের নিকটে বুক পেতে বুলেট ধারণ করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার মাধ্যমে। এটাই দেশের জন্য তারুণ্যের আত্মত্যাগ, তারুণ্যের গৌরবদীপ্ত অহংকার, যা হয়তো কেয়ামত পর্যন্ত এই জাতি স্মরণ করতেই থাকবে। এরপর যা ঘটে গেছে তাকে নতুন করে বলার অপেক্ষা নেই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের

প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত