ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বন্যার্তদের পাশে দেশ

শিক্ষার্থীরা নতুন পথ দেখালো
বন্যার্তদের পাশে দেশ

তরুণরা আমাদের গর্ব ও অহংকার। তারা আমাদের আশা-ভরসার স্থল এবং ভবিষ্যতের কাণ্ডারি। শিক্ষার্থী-তরুণরা দেখিয়ে দিয়েছে। কীভাবে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশকে মুক্ত করা যায়। তারা দ্বিতীয় স্বাধীনতা উপহার দিয়েছে, এজন্য অকাতরে তারা জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, অঙ্গ দিয়েছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তারা বিশ্বের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। অথচ, এই শিক্ষার্থীদের নিয়ে নানা রকম অপপ্রচার, হতাশা ও অসন্তোষ ছিল। তারা নেতিবাচক সব কিছুকে উপড়ে পায়ে দলে অভুতপূর্ব ইতিহাস সৃজন করেছে। সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরাচারের, যা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল আমাদের বুকের ওপর, কী অপরিসীম শক্তিতে, ত্যাগে ও ঐক্যে তা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে আমাদের শিক্ষার্থী তরুণরা। তাদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এক সময় গণআন্দোলনে রূপ নেয় এবং অবশেষে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। স্বৈরাচার খড়কুটার মতো ভেসে যায়। শিক্ষার্থী তরুণরা এখন রাষ্ট্রের সেবা ও সংস্কারে নেমে পড়েছে। এর মধ্যেই প্রলয়ঙ্কারী বন্যা দেশের একটা বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবিয়ে দিয়েছে। সেখানে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন মানবিক বিপর্যয়। বন্যাকবলিত ১১টি জেলায় এখন পর্যন্ত অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে, ৫৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ১০ লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে রয়েছে। তাদের খাদ্য, পানীয় ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রীর অভাব দেখা দিয়েছে প্রচণ্ডভাবে। জাতির এই কঠিন দুর্যোগের সময় আবার ময়দানে হাজির শিক্ষার্থী তরুণরা। বন্যা দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তা সম্প্রসারিত হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে একটা অভুতপূর্ব সাড়া সৃষ্টি হয়েছে। শিশু, নারী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ, যার যা সামর্থ্য তাই নিয়ে জমা দিচ্ছে ত্রাণ সংগ্রহকেন্দ্রে। খাবার, পানি, ওষুধপত্র, জামাকাপড়সহ মানুষের প্রয়োজনীয় যাবতীয় জিনিসপত্র ত্রাণকেন্দ্রে জমা হচ্ছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে স্থানাভাবও দেখা দিয়েছে। এ এক অনন্য সাধারণ দৃশ্য। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষ ত্রাণসামগ্রী জমা দিচ্ছে। টাকাও দিচ্ছে অনেকে। শিশু-শিক্ষার্থীরা তাদের টিফিনের পয়সা, ভিক্ষুক তার ভিক্ষার্জিত অর্থ, রিকশাওয়ালা ও দিনমজুররা তাদের কষ্টের অর্থ দিয়ে যাচ্ছে দুর্গত মানুষের জন্য। মানুষ যে মানুষের জন্য সেটা পুনরায় প্রমাণিত হচ্ছে। শিক্ষার্থী তরুণদের উদ্যোগে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ত্রাণ সংগ্রহ ও বিতরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় মোকাবিলায় গণঅংশগ্রহণ অনেকদিন দেখা যায়নি। বিগত স্বৈরসরকারের আমলে সরকারি সাহায্য, ত্রাণ ইত্যাদি যখন ঢালাওভাবে লুটপাটের শিকার হয়েছে তখন দুর্গতত্রাণে মানুষ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। স্বৈরাচারের পতনে মানবিকতা ফিরে এসেছে, তার জোয়ার আমরা প্রত্যক্ষ করছি।

শিক্ষার্থী তরুণরা, ব্যাপক অর্থে ছাত্র-জনতা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতাই এনে দেয়নি, জাতীয় দুর্যোগ-বিপর্যয় কীভাবে একতাবদ্ধ হয়ে মোকাবিলা করতে হয় তারও নজির সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে থেকে জাতীয় ঐক্য আরো মজবুত ভিত্তি লাভ করেছে। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বন্যার্তদের সহায়তা প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তরফেও একই আহ্বান জানানো হয়েছে। আশার কথা, দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে এসব আহ্বান ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছে। মানুষ তাদের উৎসব-অনুষ্ঠানের খরচ কমিয়ে, সাংসারিক খরচ কাটছাঁট করে বন্যার্তদের সহায়তা করছে। মানুষের প্রতি মানুষের হামদরদী এর চেয়ে আর কীভাবে হতে পারে! শিক্ষার্থী তরুণরা জাতিকে পথ দেখিয়েছে, অভাবনীয় আশাবাদ তৈরি করেছে। জাতীয় সংহতি বুলন্দ করেছে, আস্থার জায়গা নির্মাণ করেছে। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে বন্যার্তদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ঐক্য-সংহতির সঙ্গে তারুণ্যের শক্তি সংযুক্ত হলে সমস্যা যতই বড় হোক, সংকট যতই বিস্তৃত ও গভীর হোক, তার সমাধান হবেই। এ প্রত্যয় আমাদের উদ্দীপ্ত করে, অনুপ্রাণিত করে। বন্যা স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহ হলেও মনে রাখতে হবে, দেশের একাংশের মধ্যে তা সীমিত। আশা করা যায়, অচিরেই পরিস্থিতি সফলভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। বন্যাদুগর্তদের দুর্বিষহ অবস্থার অবসান ঘটবে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, বন্যা মোকাবিলাই সরকারের এ মুহূর্তের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সরকারের সমস্যা-সংকট ও কাজের অবধি নেই। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংস্কার, দ্বিতীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন ইত্যাদি তাকে এগিয়ে দিতে হবে। গণমানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করতে হবে। কিন্তু এখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে বন্যা মোকাবিলা। তারুণ্যর সহযোগ সরকারের সঙ্গেই আছে।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার এখনো পতিত স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া প্রশাসনের পূর্ণ সহযোগিতা পাচ্ছে না। শুরুতেই পুলিশের অসহযোগিতার কথা কারো অজানা নেই। এখন পুলিশ কর্মে ফিরে এলেও কর্তব্যসম্পাদনে অনুৎসাহ লক্ষ্যযোগ্য। ওদিকে জনপ্রশাসনের ভালো মতো সহযোগিতা সরকার পাচ্ছে না। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় স্থানীয় প্রশাসন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। সঠিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস পর্যন্ত আবহাওয়া দফতরের পক্ষে দেয়া সম্ভব হয়নি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের ক্ষমতার অনেক গল্প প্রচারিত হয়েছে। এখন তার ব্যর্থতা চোখে পড়ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনো পদক্ষেপই লক্ষ করা যাচ্ছে না, যদিও বাঁধ ভাঙার অনেক ঘটনা এর মধ্যেই ঘটেছে। দায়িত্ব পালনে অনীহা-অবহেলা এর কারণ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাস্তবতাদৃষ্টে পতিত সরকারের দোসর সচিবদের অবিলম্বে সরিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। বলেছেন, যেসব ব্যক্তি শেখ হাসিনার পাশে থেকে তার দোসর হয়ে মানুষের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, লুটপাট ও বিদেশে টাকা পাচার করেছে তাদের আমরা অন্তর্র্বতী সরকারের আশেপাশে দেখতে চাই না। বস্তুত, পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের স্বপদে, স্বস্থানে বহাল রেখে অন্তর্বর্তী সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের ক্লিন করা জরুরি এবং তাদের স্থলে সৎ, যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ করা প্রয়োজন। সরকার এক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। কোথায় সরকারের অপারগতা, এ প্রশ্ন এখন উঠছে। সরকারের সফল হতে হলে স্বৈরাচারের দোসর সচিব ও উচ্চপদস্থদের সরিয়ে দেয়ার বিকল্প নেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের উচিত বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপযুক্ত টিম গঠন করা এবং তাদের মাধ্যমে সরকারের এজেন্ডা ও কাজ বাস্তবায়ন করা। লক্ষ্য করা গেছে, বিজিবি পতিত স্বৈরাচারের হয়ে হত্যাসহ অনেক দুষ্কর্ম করেছে। কিন্তু সেই বিজিবিই এখন জনবান্ধব ও দেশপ্রেমিক বাহিনী হিসেবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে কিছু পরিবর্তনে এবং এর সদস্যদের দায়িত্ববোধের কারণে। পক্ষান্তরে আনসাররা দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। এ ধরনের আন্দোলনবাজদের শক্ত হাতে দমন করা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা এদিকে দৃষ্টি দেবেন বলে আমরা আশা করি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত