ড. ইউনূসকে সর্বোতভাবে সহযোগিতা করতে হবে

প্রকাশ : ২৮ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিপ্লবের মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে ৮ আগস্ট রাতে। ১৮ দিনের মাথায় গত রোববার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিয়েছেন। একে একটি অসাধারণ ও পরিপূর্ণ ভাষণ হিসেবে সহজেই অভিহিত করা যায়। ছাত্র-জনতার বিপ্লব, তাদের নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন, স্বৈরাচারের রাষ্ট্র ধ্বংসের বিবরণ, স্বপ্নের বাংলাদেশের বিপুল সম্ভাবনা, সরকারেরর কর্মলক্ষ্য ও উদ্যোগ, তার মেয়াদকাল, নির্বাচন, বৈদেশিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা ইত্যাদি নানা বিষয় ভাষণে উঠে এসেছে। শুরুতেই তিনি ছাত্র-গণবিপ্লবে যারা নিহত হয়েছেন, তাদের স্মরণ করছেন। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় হতাহতদের কথা উল্লেখ করেছেন। অতঃপর তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রসঙ্গ এসেছে এবং তিনি বলেছেন- ‘বিপ্লবী ছাত্র-জনতা জাতির এ ক্রান্তিকালে আমাকে এক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তারা নতুন এক বাংলাদেশ গড়তে চায়। নতুন প্রজন্মের এ গভীর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার সংগ্রামে আমি একজন সহযোদ্ধা হিসেবে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি।’ তিনি এ সংগ্রামে সব বয়সের, পেশার, ধর্মের মানুষের বিনাদ্বিধায় যোগদানের আহ্বান জানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নয় মাসের সশস্ত্র লড়াই ও লাখ লাখ শহীদের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরশাসন ধ্বংস করে দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্র-গণবিপ্লবে যে পরিবর্তন এসেছে, তাকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়েছে। ড. ইউনূস তার ভাষণে বিচারবিভাগ, প্রশাসন, পুলিশ, নির্বাচন কমিশন, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতির শোচনীয় অবস্থার কথা বলেছেন এবং এসব সংস্কারে সরকারের উদ্যোগের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘ফ্যাসিবাদী সরকার প্রধানের দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই। সেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটাই; উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যহত করতে না পারে। সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ ছাত্র-জনতার আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের পথনকশা তার এ বক্তব্যের মধ্যে ফুটে উঠেছে। এই পথনকশার বাস্তবায়ন সহজসাধ্য নয়, অত্যন্ত দূরূহ। এজন্য পর্যাপ্ত সময় দরকার, গণ ও রাজনৈতিক সমর্থন দরকার, আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও আবশ্যক। ড. ইউনূস এমন এক ব্যক্তি, দেশে যার সর্বজনমান্যতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তিনি অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তিত্ব। তার উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্যরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে স্বনামধন্য ও খ্যাতিমান। তার এই টিম আকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে সক্ষম, এ আস্থা দেশবাসীর আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের আশু কার্যতালিকায় রয়েছে প্রশাসন, পুলিশ, বিচারবিভাগ, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিবর্তন ও সংস্কার, যাতে এগুলো স্বপ্ন বাস্তবায়নে কার্যযোগ্য হয়। সরকার এরইমধ্যে পরিবর্তন ও সংস্কারে হাত দিয়েছে। সেটা দেশের মানুষের মধ্যে যেমন তেমনি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিন সপ্তাহের কম সময়ের এই সরকারকে নানা বাধা ও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের সম্মুখীন হতে হয়েছে। পুলিশের অসহযোগিতা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অপপ্রচার, জুডিশিয়াল ক্যু ইত্যাদির মোকাবিলা করতে হয়েছে। এখনো নানাভাবে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তাঘাটে নেমে পড়া, মানববন্ধন, ঘেরাও ইত্যাদিকেও দেশের মানুষ ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের অংশ হিসেবে দেখছে এবং এ সবের পেছনে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের হাত রয়েছে বলে মনে করছে। আনসার সদস্যরা গত রোববার সচিবালয়ে জোর করে ঢুকে যা করেছে, তা অনভিপ্রেতই শুধু নয়, শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবেও গণ্য। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে, সচিবালয়ের আশপাশে, প্রেসক্লাব, শাহবাগ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ও সড়কে প্রতিদিনই আন্দোলনকারীদের কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে। রিকশা চালকরাও গতকাল শাহবাগে রাস্তা দখল করে তাদের দাবি-দাওয়া জানিয়েছে। পর্যবেক্ষকরা দাবি-দাওয়া পেশের এই হিড়িক দেখে মনে করছেন, পতিত স্বৈরাচারের দোসর, সুবিধাভোগী ও অনুগ্রহভাজনরা বিভিন্ন সংগঠন, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের আড়ালে আন্দোলনবাজী করছে। এর মাধ্যমে তারা সরকারকে বিব্রত করছে, কাজ করতে বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এদের কঠোর হাতে দমন করা জরুরি। যে কোনো মহলের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। সেটা অনুকূল সময়ে করা উচিত। দেখা যাচ্ছে, কেউই এই ঔচিত্যবোধের পরিচয় দিচ্ছে না। এখানেই প্রশ্ন উঠছে। সরকার সদ্যই দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছে। এর মধ্যেই ভয়াবহ বন্যায় দেশের একাংশ ডুবে গেছে। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন উঠতে পারে, এটা কি দাবি-দাওয়া বা আন্দোলনের সময়? ড. ইউনূস তার ভাষণে সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলেছেন। এখন সর্বদাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে পড়া, ব্যক্তিবিশেষকে জিম্মি করা ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এসব করলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা ব্যহত হবে বলে উল্লেখ করেছেন। আমরাও আশা করি, সরকারের উপর অহেতুক চাপ সৃষ্টি করা থেকে সবাই বিরত থাকবো।

ছাত্র-জনতার বিপ্লব অসাধারণ, নজিরবিহীন হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে দেশে-বিদেশে। ছাত্ররা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা স্বৈরাচারী সরকারকে এভাবে উৎখাত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারে, তা ছিল অভাবনীয়। এই অসম্ভাব্য বিষয় সম্ভব হয়েছে। এ বিপ্লব উপমহাদেশের পাকিস্তান ও ভারতে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তারুণ্যের জাগরণ ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানে সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণরা নব উদ্যমে আন্দোলনে নেমেছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-তরুণরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে। নারী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ভারতজুড়ে যে আন্দোলন হয়ে গেল, তার মধ্যেও বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রভাব ছিল বলে বলা হয়েছে। ধর্ষণের প্রতিবাদে এত বড় আন্দোলন ভারতে এর আগে হয়নি। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের প্রভাব আমাদের জাতীয় নানা ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। আমাদের ক্রিকেট দল ২১ বছর পর টেস্টে ১০ উইকেটের ব্যবধানে পাকিস্তানকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এখানেও তারুণ্যেরই জয় হয়েছে। ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অনুপ্রেরণা এ বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে বলে অনেকের ধারণা। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর রেমিট্যান্সে বড় রকমের উল্লম্ফন ঘটেছে। বন্দরে গার্মেন্ট রফতানি, জাহাজীকরণ বেড়েছে, যা গার্মেন্টের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দেয়। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচিকে সমর্থন করে সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা ফিরিয়ে দেয়ার এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়েছে। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের নবধারা সূচিত হয়েছে। রাশিয়া সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। জাপান, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নেরও সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছে। ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের বিস্তার ঘটতে পারে, যদি সার্বভৌম সমতার নীতি প্রাধান্য পায়। এসব কিছুর পেছনে ড. ইউনূসের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

ড. ইউনূসের নেতৃত্বেই নতুন বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি রচিত হবে, এটা অতিরিক্ত আশা নয়, সম্ভাবনাময় বাস্তবতা। তাকে, তার সরকারকে নিঃশর্ত সমর্থন জানাতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে। এটা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার সরকার কতদিনে বিদায় নেবে, এমন আগ্রহের পরিপ্রেক্ষিতে তার জবাব- ‘এটা আপনাদের হাতে, কতদিনে আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন।’ নির্বাচন কবে হবে, এ প্রশ্নের জবাবে তার বক্তব্য- ‘সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে, কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।’ বিএনপির তরফে বলা হয়েছে, যত দিন প্রয়োজন এ সরকার ক্ষমতায় থাকুক। অন্যান্য দলও একই মত পোষণ করে। ড. ইউনূস এর আগেই নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে উত্তরণ তাদের লক্ষ্য বলে মন্তব্য করেছেন। সে পর্যন্ত সবাইকে অপেক্ষা করতে হবে। সরকারকে সর্বপ্রযত্নে সহায়তা করতে হবে।