ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বৈরাচার আইনের আওতায় আসে, কুশীলব ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়

মো. রহিসুল হক রইস
স্বৈরাচার আইনের আওতায় আসে, কুশীলব ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যায়

মসনদের মোহ আওয়ামী লীগের রক্তে মিশে আছে। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি দলটি এক দলীয় বাকশাল কায়েম করে দেশে প্রথম গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেয়। যার পরিণতি হিসেবে একুশ বছরের বেশি সময় অপেক্ষার পর অনেক অনুনয় বিনয় করে দলটি আবার ক্ষমতায় আসে। যদিও, নির্দিষ্ট সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিল দলটি। তবে, ২০০৯ সালে পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর স্বৈরতন্ত্রের ভূত তাদের মাথায় চেপে বসে। ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেশে আবার স্বৈরাচারের গোড়াপত্তন করে। কেবল শেখ হাসিনা ও তার রাজনৈতিক দোসরদের নয়, নেপথ্যের কুশীলবদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

২০১১ সালে তৎকালীণ প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের তর্কিত রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ ঘটে। যদিও রায়ের পর্যবেক্ষণে এমিকাস কিউরিদের মতামত অনুসারে রাষ্ট্র ও জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে পরবর্তী দুই মেয়াদ পর্র্যন্ত এ ব্যবস্থা চালু রাখার বিষয়টি বলা হয়েছিল। বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক তার অপরিনামদর্শী রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে দীর্ঘতম স্বৈরাচারের বীজ বপণ করেন। বিএনপিসহ দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করার জন্য জোড় দাবি জানালেও সরকার তাতে কর্ণপাত করেনি। তারা ১৪ দলসহ সমমনাদের নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের পথে হাঁটতে থাকে। তখন জাতিসংঘ একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে মধ্যস্ততা করার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের একগুয়েমীর কারণে তা ভেস্তে যায়। ২০১২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি গঠিত বিতর্কিত রকিবুদ্দিনের নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার জন্য প্রায় সব দল ঐকমত্যে আসে। বেগতিক আওয়ামী লীগ তখন কৌশলে ভারতের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদকে চাপ প্রয়োগ করে জোড়পূর্বক ভোটে আসতে বাধ্য করে। ঐদিন জাতীয় পার্টি নির্বাচনে না এলে আমাদের হয়তো গণতন্ত্রের কফিন দেখতে হতো না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ১৫৫ জন বি না প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়, যা দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি কলঙ্কময় অধ্যায়। রকিবুদ্দিন কমিশন ছিলেন দেশে পুনর্বার স্বৈরাচার সরকার গঠনের অনুঘটক। সরকার গঠনের পর বিরোধীদলের উপর আরো চড়াও হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা ও নির্যাতনে বিএনপির নেতাকর্মীদের রীতিমতো কোণঠাসা করে রাখে। এরই মধ্যে বেগম খালেদা জিয়াকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে রাখা হয়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রেপ্তারি পরওয়ানা জারি করা হয়, গণমাধ্যমে তার বক্তব্য প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। এমন বাস্তবতায় বিএনপির হাইকমান্ড নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। ২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি কেএম নুরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। এই কমিশনও আওয়ামী লীগকে জেতানোর এজেন্ডা নিয়ে কর্মকাণ্ড শুরু করে। নির্বাচনে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে বিএনপি সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন করে। শেখ হাসিনা সব রাজনৈতিক দলকে ভোটে আসার জন্য আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুকন্যা আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন। সেই নির্বাচনে তিনি কি আস্থার প্রমাণ দিয়েছিলেন জাতি তা নিজ চোখে দেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমামের কূটকৌশলে প্রশাসনের সহযোগিতায় আরেকটি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে স্বৈরাচারকে ওয়াক অভার দেয়ার জন্য রুটিন ওয়ার্ক শুরু করে দলীয় সরকার। এইচটি ইমাম পুলিশ-প্রশাসনকে শতভাগ দলীয়করণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে গণতান্ত্রিক ধারা থেকে ফ্যাসিবাদী ভূমিকায় অবতীর্ণ করেন। ইমাম সাহেবের কুটচালে শেখ হাসিনার মসনদ পাকাপোক্ত হয়ে ওঠে। ২০১৮ সালের নীল নকশার নির্বাচনে আরেক খলনায়ক ছিলেন তৎকালীণ সেনাপ্রধান আজিজ ইউ আহমেদ। বঙ্গবন্ধুকন্যার পাতানো ফাঁদে পা দেয় জাতীয় ঐক্য। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সমমনা নেতাকর্মীরা ছাড়া কেউ ভোট কেন্দ্রে আসতে পারেনি, দিনভর জালভোট প্রদানের মাধ্যমে এক ঐতিহাসিক ভোট উৎসবে লিপ্ত হয় আওয়ামী লীগ, তাদের ফ্র্যাংকেনস্টেইন চরিত্র সাড়া বিশ্বে ফুটে ওঠে। নির্লজ্জের মতো প্রহসনের নির্বাচনে সহযোগিতা করে সেনাবাহিনীর মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করেছেন, পাশাপাশি স্বৈরাচার সরকারের পথকে আরো বিস্তৃত করে। যদিও হুদা কমিশনে মাহবুব তালুকদার নামক একজন সৎ, আদর্শবান ও দেশপ্রেমিক নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তিনি সাহসের সাথে নির্বাচন কমিশনের সব অনিয়মের প্রতিবাদ করেছেন। ২০১৮ সালের প্রতারণামূলক নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিরোধীদলকে শেষ করার সব অপকৌশল প্রয়োগ করতে থাকে আওয়ামী লীগ। দমন-পীড়নের মধ্য দিয়ে কেটে যায় পাঁচ বছর। ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি গঠিত হয় হাবিবুল আওয়াল কমিশন। উত্তরসূরীদের মতো তারাও দেশে আওয়ামী ঘরানার নির্বাচন মঞ্চস্থ করার জন্য সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যদিও একটি নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন মহল হতে চাপ আসে। সবার ধারণা ছিল এবার মনে হয় একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে ফিরছে সরকার। কিন্তু না, তারা সংবিধানের দোহাই দিয়ে আরেকটি পাতানো নির্বাচন আয়োজনের কারসাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। গত বছর ২৮ অক্টোবর পল্টনে সমাবেশ ডাকে বিএনপির সমাবেশে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার নাটক সাজায়। সেদিন পুলিশের একজন কনস্টেবল নিহত হয়। পুলিশ হত্যার দায়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের প্রেপ্তার করতে থাকে। পরবর্তীতে হাবিবুল আওয়াল কমিশনের প্রত্যক্ষ মদদে আরেকটি ভোটার বিহীন জাতীয় নির্বাচন করে বাংলাদেশের মর্যাদা বিশ্বের বুকে ভুলুণ্ঠিত করে। এক রকম বিনা ভোটে ক্ষমতায় এসে কাউকে পরোয়া না করার মনোভাব গড়ে ওঠে স্বয়ং শেখ হাসিনার।

পহেলা জুলাই হতে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে তিনি পাত্তাই দেননি। ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ঢালাওভাবে রাজাকারের নাতি-পুতি বলে সম্বোধন করে কোটি তরুণের মনে চরম আঘাত দিয়েছেন। মুহূর্তে ফুঁসে ওঠে গোটা দেশ। পুলিশ ও ছাত্রলীগ বেপোরোয়া হয়ে শত শত শিক্ষার্থীর লাশ ফেলে। বিষয়টি আদালতে দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হক মন্তব্য করেন রাজপথে বিক্ষোভ করে নয়, সমস্যা সমাধানের জন্য আদালতে আসতে হবে। বিচার বিভাগ বিশ্বাস ও যোগ্যতা হারায়। বিচারপতি ওবায়দুল হকের গড়িমসির কারণে ছাত্র জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে হত্যা করেও স্বৈরাচারের শেষ রক্ষা হয়নি। স্মরণাতীতকালের গণবিস্ফোরণের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায় শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধু কন্যার এমন পরিণতি হয়তো তার চরম শত্রুরাও কখোনো চিন্তা করেনি। স্বৈরাচার যায়, স্বৈরাচার আসে, কিন্তু তাদের কুশীলবরা এক সময় আলোচনার বাইরে থেকে যায়। তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, প্রয়াত নাটের গুরুদের জন্য চাই মরোণোত্তর বিচার।।

লেখক: সুপ্রিমকোর্টের

আইনজীবী ও সাংবাদিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত