ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার হোক বিশেষ এজেন্ডা

ড. আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী
স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার হোক বিশেষ এজেন্ডা

ছাত্রজনতার নেতৃত্বে ঘটিত সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী সফল আন্দোলন বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বে এক বিরল ঘটনা। অগুনতি প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয় স্বাধীনতা-পরবর্তী জাতীয় জীবনে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সত্যিকার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের স্থান অগ্রগণ্য। এমডিজি বা এসডিজিতে যতগুলো লক্ষ্য সন্নিবেশিত হয়েছে, তার বেশিরভাগেরই স্বাস্থ্যের সঙ্গে কোনো না কোনো সরাসরি সম্পর্ক বিদ্যমান। তার মানে স্বাস্থ্যের উন্নতি ছাড়া অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রাও অপূর্ণ রয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যাবে। গত কয়েক দশক স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা দেখতে পেয়েছি যে, ২০১০ সাল থেকে সেই অগ্রযাত্রায় এক স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মাতৃমৃত্যুর কথাই ধরা যাক। ১৯৯০ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ তার মাতৃমৃত্যুহার প্রতি ১ লাখ জন্মে ৬০০ থেকে ১৯৪-তে নামাতে পেরেছিল, যা ছিল এক বিস্ময়কর ব্যাপার। কিন্তু পরবর্তী প্রায় এক দশকে তার আর কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। স্থবিরতার এই চিত্র আমরা শিশুমৃত্যুহার এবং অন্যান্য সূচক যেমন প্রজনন হারের বেলায়ও দেখতে পাই। বলা হয় যে, উন্নয়নের সহজলভ্য বা লো হ্যাঙ্গিং ফ্রুটসগুলো আমরা ঠিকমতোই আহরণ করতে পেরেছিলাম।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অঙ্গীকার অনুসারে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুহার ২০৩০ সালে ৭০ হওয়ার কথা। এখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, এটা এখন এক অলীক কল্পনামাত্র, যা কোনোভাবেই অর্জনীয় নয়। কিন্তু আমাদের তো এগিয়ে যেতে হবে। বলাবাহুল্য, সফলভাবে এগিয়ে যেতে হলে এখন অপেক্ষাকৃত দুর্ভেদ্য বা হাই হ্যাঙ্গিং ফ্রুটসগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বিগত সরকারের আমলে নাগরিক সমাজ এবং দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ের ওপর বারবার আলোকপাত করেছেন। এর প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুঃখজনকভাবে, সরকারের কোনো মহলই এটা কখনো আমলে নেয়নি। বরং এক ধরনের আত্মতুষ্টি তাদের পেয়ে বসেছিল। যার ফলস্বরূপ যে কোনো ধরনের সংস্কারের বিপক্ষে তারা অবস্থান নিয়েছিল।

শত শত শহীদের জীবন এবং কোটি মানুষের আত্মত্যাগের ফসল এই বিজয়। উন্নয়নের ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী এই বিপ্লব দেশবাসীকে আন্দোলিত করেছে, তাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনার সুযোগ করে দিয়েছে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও আমূল সংস্কার ঘটানোর একটা সুযোগ আমাদের দ্বারপ্রান্তে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা যদি সত্যিই এগিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের কিছু কঠিন কাজে হাত দিতে হবে। আমরা জানি যে, বাংলাদেশের উন্নয়নে সুশাসন একটি প্রধানতম সমস্যা। সুশাসনের অভাবে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। স্বাস্থ্য খাত এ থেকে কোনোভাবেই আলাদা নয়। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি তো একটি বারোমেসে সমস্যা। কোভিড অতিমারির সময়ে ঘটা অজস্র দুর্নীতির খবর তো আমাদের দৃশ্যপটে এখনো জ্বলজ্বল করছে। আমরা জানি এসব ঘটে জবাবদিহিতা এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাবে। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বেসরকারি বা ব্যক্তি খাত এখন এক জগদ্দল পাহাড়রূপে আবির্ভূত হয়েছে। ১৯৮২ সালে এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে ব্যক্তি খাতকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। দুঃখজনকভাবে, এরপর এই অর্ডিন্যান্সের পরিবর্ধন বা পরিমার্জন কোনোটাই হয়নি। এদের কার্যকলাপ তদারকির জন্য কোনো স্পষ্ট আইনি বিধান নেই। যার ফলে অসাধু এবং বেআইনি কাজ করেও তারা পার পেয়ে যায়। ডাক্তারদের পেশাগত আচরণ অবলোকনে কয়েক দশক আগে স্থাপিত বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অনেক চিকিৎসক তাদের অসাধু চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন। শাস্তির কোনো ব্যবস্থা নেই।

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার আরেকটি নেতিবাচক দিক হলো বিনিয়োগ। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে যে হারে বিনিয়োগ করে, তা বিশ্বে প্রায় সর্বনিম্ন। দেশের জাতীয় আয়ের মাত্র শূন্য দশমিক সাত শতাংশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যয় হয়। জাতি হিসেবে এটা দুর্ভাগ্যজনক। এই কিঞ্চিৎ বিনিয়োগ দিয়ে একটি আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি যে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মানব উন্নয়ন খাতগুলো ছিল পতিত সরকারের সর্বনিম্ন অগ্রাধিকার। আমাদের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। তারা স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে। সেই শ্রীলঙ্কা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে জাতীয় আয়ের নিরিখে আমাদের চেয়ে প্রায় চার গুণ অধিক অর্থ ব্যয় করে। দেশে যে যৎসামান্য টাকা স্বাস্থ্য খাতে দেয়া হয়, তাও আবার আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় খরচ করতে পারে না। গত কয়েক বছরে পুরো বরাদ্দের ৮০ ভাগ বা আরো কম খরচ হয়েছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো অপ্রতুল ধারণক্ষমতা। মন্ত্রণালয়ের সুষ্ঠুভাবে বাজেট প্রণয়ন, প্রস্তাব ও তহবিল ব্যবহারের দক্ষতার অভাব সর্বজনবিদিত। আরেকটি কারণ হলো, দূরদৃষ্টি বা ভিশনের অভাব। আমরা যদি একটি উন্নত জাতি হিসেবে পৃথিবীতে আত্মপ্রকাশ করতে চাই, তাহলে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কেমন হবে তার একটা দর্শন আমাদের স্বাস্থ্য পরিকল্পনাবিদদের মধ্যে থাকা উচিত এবং সে হিসেবেই বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। এক ‘চিন্তা-দৈন্য’ যেন আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে গ্রাস করে আছে।

যেসব উন্নয়নশীল দেশ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে, তাদের একটা মাপকাঠি হলো সেসব দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বিনিয়োগ। বাংলাদেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা উপজেলা থেকে ইউনিয়ন এবং কমিউনিটি ক্লিনিক পর্যন্ত ব্যাপৃত। প্রাথমিক স্তরকে উপেক্ষা করে নগরপ্রধান বড় বড় হাসপাতালভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা সামাজিক বৈষম্যকেই লালন করছে। আমাদের উচিত হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিনিয়োগ বাড়িয়ে একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী রেফারেল সিস্টেম তৈরি করা, যার ফলে নগর হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ অনেক কমে যাবে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় একটি বিশেষ সমস্যা হলো তার মানবসম্পদ। এখানে সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা রয়েছে। ডাক্তার, নার্স বা মিডওয়াইফের সংখ্যা, বিশেষভাবে শেষোক্তদের, প্রয়োজনের তুলনায় অত্যল্প। এ সংকট কাটাতে বিগত কয়েকটি সরকার সরকারি ও বেসরকারি খাতে অনেক নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের লাইসেন্স দিয়েছে। এগুলো মানবসম্পদ সংকট কাটাতে অবদান রাখছে। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এ ধরনের শত শত প্রতিষ্ঠানের গুণমান যাচাই এবং এদের মান জোরদারকল্পে তেমন কোনো কার্যকরী পন্থা চালু হয়নি। একইভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায়ও আমাদের নজর দিতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ বাংলাদেশের ৫০ বছর পালন উপলক্ষে একটি দীর্ঘ গবেষণাভিত্তিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশ কীভাবে তার প্রতিবেশীদের চেয়ে স্বাস্থ্যের বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে রয়েছে। এ গবেষণায় প্রাপ্ত একটি বিষয় অবশ্য অনেককেই আশাহত করেছে। স্বাস্থ্য গবেষণার ক্ষেত্রে আগে যদিও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিল কিন্তু গত কয়েক বছরে পাকিস্তান আমাদের পেছনে ফেলে এসেছে।

২০৩০ সালের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং সরকারের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন দলিলপত্রে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা বা ইউনিভার্সেল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) অর্জনে তৎকালীন সরকারের অঙ্গীকারের কথা বলা হয়েছিল। দুঃখজনক হলো, এটা কীভাবে অর্জিত হবে, এর জন্য বাড়তি টাকা কোথা থেকে আসবে তার কোনো রোডম্যাপ কেউ কোনো দিন বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেনি।

জাতীয় জীবনে ছাত্রজনতার বিপ্লব আমাদের এক বিশাল প্রাপ্তি। এতে এ দেশের ছাত্র-জনতা অশেষ ত্যাগ স্বীকার করেছে। আমরা জানি যে, প্রতিটি সংকটেরই একটা ইতিবাচক দিক থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের দেশগুলো ধ্বংসাবশেষের ওপর তৈরি করে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিখরচায় উন্নত স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত হয়। নব্বইয়ের দশকে এক নৃশংস গণহত্যার পর আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডা তৈরি করল তাদের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা বা ইউএইচসি কর্মসূচি। আমার মতে, বাংলাদেশের জরাজীর্ণ স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে এ বিপ্লব একটি মহাসুযোগ এনে দিয়েছে। এ লক্ষ্যে জাতি হিসেবে আমাদের কী কী করণীয়, সে ব্যাপারে আমাদের গুণিজন মোটামুটি একমত। এই এজেন্ডাকে মোটা দাগে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা যায়।

১. উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি স্থায়ী জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন স্থাপন করা, যার কাজ হবে দেশব্যাপী স্বাস্থ্যসুরক্ষা বা ইউএইচসি কর্মসূচি কীভাবে চালু করা যায়, তার রোডম্যাপ তৈরি করা এবং তা বাস্তবায়নে নজরদারি করা।

২. স্বাস্থ্যব্যবস্থার জবাবদিহিতা নিশ্চিতকল্পে একটি ‘ন্যাশনাল হেলথ সিকিউরিটি অফিস’ স্থাপন করা, যার কাজ হবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘পারচেজার’ ও ‘প্রোভাইডার’ ভূমিকাকে আলাদা বা বিযুক্ত করা এবং প্রোভাইডারদের নজরদারি করা। ৩. সুশাসন ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। ৪. স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ পর্যায়ক্রমে মোট জাতীয় আয়ের দুই ভাগে নিয়ে যাওয়া এবং বাজেটে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার অগ্রাধিকার বাড়ানো। ৫. মেডিক্যাল শিক্ষা ও গবেষণা কাজরত প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা, মান ও নজরদারি বাড়ানো। আমার বিশ্বাস, এই পথ ধরে চললে আমরা আমাদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে দৃপ্তপদভারে এগিয়ে যেতে পারব। এভাবেই আমরা আমাদের শহীদদের ঋণ শোধ করতে পারব। আমাদের অর্জন অনেক তবে এখানে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ নেই। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হলে সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই, যা ছাত্রনেতারা বারবার উল্লেখ করছেন। ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারকে সাহসী ভূমিকা নিয়ে এ কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের দিকে এগোতে হবে।

লেখক : বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের আহ্বায়ক যুক্তরাষ্ট্রের

কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

এবং ব্র্যাকের প্রাক্তন

ভাইস চেয়ারপারসন

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত