ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লার বন্যা উপদ্রুত কোনো কোনো এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল ও অবনতিশীল বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি যত দীর্ঘায়িত হবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ততই বাড়বে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশ যখন অভাবনীয় এক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতার সম্মুখীন, ঠিক তখনই দেশের ১২ জেলার লাখ লাখ মানুষ ভয়াবহ বন্যার শিকার হলো। এই বন্যাকে শ্রেফ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। এটি একদিকে যেমন ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ে অতি বৃষ্টির কারণে উজানের ঢল থেকে সৃষ্ট, অন্যদিকে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ত্রিপুরার ডুম্বুর ব্যারাজের স্লুইস গেট খুলে দেয়ার ফল। দীর্ঘ ১৬ বছর পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ভারতীয় বশংবদ স্বৈরশাসকের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি যখন অত্যন্ত জটিল ও নাজুক অবস্থায় উপনীত হয়েছে, দিল্লিতে থাকা হাসিনার নির্দেশনায় একের পর নানাবিধ প্রতিবিপ্লবী ঘটনা সংঘটিত করার অপপ্রয়াস দেখা যাচ্ছে, তখন এই প্রলয়ঙ্করী বন্যা দেশে-বিদেশে রাজনৈতিক বন্যা বা ভারতের পানি আগ্রাসন হিসেবেই বিবেচিত হয়েছে। বাংলাদেশকে না জানিয়ে ডুম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেয়ার পর অস্বাভাবিক ও অপ্রস্তুত জনপদগুলো দুইদিনের মধ্যে ১০-১২ ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকটি জেলায় বিপুলসংখ্যক মানুষ বন্যায় সরাসরি আক্রান্ত হয়েছে। এখনো প্রায় ২৮ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছে। হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র, স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসায় আশ্রয় নিয়েছে। এতবড় দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো ৫০ জনের কম হলেও বন্যার ট্রমা ও শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেক বেশি।
একটি রাজনৈতিক ক্রান্তিকালে এই অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যায় মানুষের মধ্যে এক ধরনের ঐক্য ও গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ত্রাণ তহবিলে নজিরবিহীন সাড়া দিয়েছে নগরবাসী। সারাদেশের মানুষ বানবাসি মানুষের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসার এক অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া গেছে। ফেনী, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, কুমিল্লামুখী হাইওয়েতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে ত্রাণবাহী গাড়ির বহর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি করতে দেখা গেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, ত্রাণসামগ্রীর অভাব নেই। দেশের এই দুর্যোগ মুহূর্তে স্থানীয় সরকার বা জেলাপ্রশাসন, উপজেলা প্রশাসনের মতো স্থানীয় সরকারের নিস্ক্রিয়তার কারণে ত্রাণ তৎপরতায় এক ধরণের সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় অনভিজ্ঞ মানুষ ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বন্যা উপদ্রুত এলাকায় হাজির হলেও স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া ত্রাণসামগ্রীর সঠিক ও সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পুলিশ বাহিনী এখনো অনেকটাই নিষ্ক্রীয় ভূমিকা পালন করছে। স্থানীয় প্রশাসনে এখনো পতিত স্বৈরাচারের বসানো ব্যক্তিরাই বহাল তবিয়তে রয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিংবা ছাত্র-জনতার ঐক্য ও কর্মপ্রক্রিয়াকে তারা সফল দেখতে চায় না। ত্রাণ সহায়তা ও বিতরণে সরকারি বরাদ্দ এবং স্থানীয় প্রশাসনের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সাধারণ মানুষের ব্যাপক সাড়া এবং সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে আকস্মিক বিপদ অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। দুর্গম এলাকাগুলোতে ত্রাণ তৎপরতায় বিলম্ব ও এবং সময়মত ত্রাণ পৌঁছাতে না পারায় আটকে পড়া অনেক মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। তবে দীর্ঘায়িত বন্যার ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে নিঃস্ব ও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে নতুনভাবে এগিয়ে চলতে পুনর্বাসন ও জীবন-জীবিকার বন্দোবস্ত নিশ্চিত করার উদ্যোগই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে এখনই পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া হয়তো সম্ভব নয়। কারণ বন্যা পরিস্থিতি এখনো নিশ্চিত পরিণতি লাভ করেনি। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বন্যার আর্থিক ক্ষতি ২০ হাজার কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় বন্যার পানি কমলেও উপদ্রুত মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। বন্যা-পরবর্তী আশ্রয়ণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম সর্বস্ব হারানো পরিবারগুলোর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এতদিন আটকে পড়া মানুষদের জন্য শুকনো খাদ্য, নিরাপদ পানি ও শুকনো স্থানে আশ্রয় লাভই ছিল সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। এখন পানি নেমে যাওয়ার পর মানুষ ঘরে ফিরবে। কিন্তু অনেকেরই ঘরবাড়ি ভেসে গেছে। খেতের ফসল, গোলার ধান-চাল, খামার, গবাদিপশু, মাছের ঘের, ঘরের আসবাবপত্র, শিক্ষার্থীদের টেবিল-চেয়ার শিক্ষাপোকরণ সবকিছুই বাণের পানিতে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল-মাদ্রাসা, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বিদ্যুৎসংযোগ ও সরঞ্জামের পুনঃস্থাপন নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়বে। এখনো সারাদেশের মানুষ বন্যার্তদের ত্রাণ সহায়তায় কাজ করছে। বন্যা-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় প্রতিটি দুর্গত পরিবারের নগদ অর্থের প্রয়োজন পড়বে। তাদের জরুরি স্বাস্থ্যসেবা, জীবনযাত্রার উপকরণ, হাড়ি-পাতিল, তৈজশ, বিছানাপত্র, গৃহসামগ্রী, ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ইত্যাদি সবই কিনতে হবে। এজন্য তাদের হাতে নগদ অর্থের যোগান থাকতে হবে। এরপরই তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে। নতুন করে চাষাবাদে ফেরার জন্যও তাদের গবাদিপশু, ট্রাক্টর, সার-বীজ ইত্যাদি কিনতে হবে। এ জন্যও প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের নগদ অর্থের দরকার। শুধুমাত্র সরকারের পক্ষে দ্রুততম সময়ে এত মানুষের জরুরি চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য বেসরকারি পর্যায় থেকে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো, যোগাযোগব্যবস্থা, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মেরামতি কাজ দ্রুততম সময়ে শেষ করার জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যঝুঁকি ও স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। নিরাপদ পানির ব্যবস্থা এবং পানিবাহিত ও মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঠিক ও সুষ্ঠু’ পরিকল্পনা, স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা এবং আর্থিক খাতের সমন্বয় নিশ্চিত করা জরুরি। সংকট কাটিয়ে বন্যা উপদ্রুত এলাকাগুলোতে দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থা ও কর্মচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হবে, এমনটাই সবার প্রত্যাশা।