ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চব্বিশের বন্যা যতোটা না প্রাকৃতিক তার চেয়েও বেশি ভূরাজনৈতিক

মো. তাহমিদ রহমান, লেখক: প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি) নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা
চব্বিশের বন্যা যতোটা না প্রাকৃতিক তার চেয়েও বেশি ভূরাজনৈতিক

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী ও জীবন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শত সহস্র নদ-নদী-খাল-বিল জালের মতো ছড়িয়ে আছে সমগ্র দেশে। বাংলাদেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, মানুষের জীবনাচরণ বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। এই জনপদ একসময় তেরশত নদীর দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। অথচ বর্তমানে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীসহ মোট নদীর সংখ্যা ৪০৫টি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য বাংলাদেশের অবদান অতি নগণ্য হলেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে একটি। আর এই জলবায়ু হুমকির সবচেয়ে বড় কারণ হলো- নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহে বাঁধা সৃষ্টি করে কৃত্রিম বাঁধ নির্মাণ। নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ হচ্ছে প্রকৃতি গতবিষয়। এই প্রকৃতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিবেশী ভারত আমাদের নদীগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে শাসন করে আসছে, যার কুফল গুনতে হচ্ছে- বাংলাদেশের জনসাধারণকে। প্রাণিকুল বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান হলো বিশুদ্ধ মিঠা পানি। সেই পানি যখন স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারবে না, তখন প্রাণিকুল ধ্বংস হতে বাধ্য। আমি নদীর পাড়ে জন্ম ও বেড়ে উঠা মানুষ। নদী যে মানব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা হৃদয় দিয়ে জানি।

পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই বঙ্গীয় বদ্বীপটির মানুষের জীবন, সভ্যতা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের অনেকাংশই এর উপর দিয়ে বয়ে চলা ৪০৫টি নদনদী দ্বারা এখনো নিয়ন্ত্রিত হয়। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদী যার মধ্যে ৫৪টি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অভিন্ন এবং ৩টি বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অভিন্ন। তিনটি বৃহৎ নদী পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা হিমালয় থেকে উৎসরিত হয়ে চীন, ভুটান, নেপাল, ভারত ও বাংলাদেশ হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। এই তিনটি নদীর অববাহিকার মোট আয়তন ১.৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার। ভারত তাদের দেশের অভ্যন্তরে আন্তঃসীমান্ত এই নদীগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করায় আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রমত্তা নদী হয়ে গেছে শীর্ণকায় মরা খাল। গঙ্গার ফারাক্কা, তিস্তার গজলডোবা, মহানন্দার ফুলবাড়ি, বরাকের টিপাইমুখ, খোয়াইয়ের চাকমা, গোমতীর ডম্বুর ও মহারানী বাঁধগুলোর দ্বারা বাংলাদেশের মানুষ যুগের পর যুগ অত্যাচারিত হয়ে আসছে।

ভারত বর্ষায় পানির গতি নিয়ন্ত্রণ না করে এবং শীতে পানির ন্যায্য হিস্যা প্রদান না করে গত কয়েক দশক ধরে অবন্ধুসুলভ আচরণ করছে। অভিন্ন নদীর উজানে ৭০টির অধিক ড্যাম ও বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত, প্রতি বছর যার দরুন বন্যার করুণ মূল্য দিতে হয় বাংলাদেশকে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেয়ায় দীর্ঘদিন ধরে পদ্মার পানি কমে গেছে। এই পানি চারটি নদীর ধারাকে প্রবাহিত রেখে ঢাকার দিকে আসত। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার নাব্য কমে যাওয়ায় তা আর ঢাকার দিকে আসছে না, ফলশ্রুতিতে ঢাকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। এই বাঁধের কারণে খুলনা অঞ্চলের পানির লবণাক্ততা অনেক গুন বৃদ্ধি পেয়েছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, করতোয়া, মহানন্দার উজানে ড্যাম ও বাঁধ নির্মাণের ফলে উত্তরবঙ্গে নদীর পানি শুকিয়ে যাচ্ছে ফলে শুষ্ক মৌসুমে ভূ-উপরিভাগে পানি পাওয়া যাচ্ছে না।

সম্প্রতি অতিবৃষ্টির কারণে উজানে তথা ভারতে বন্যা হয়েছে এবং প্রতিবছরই এটা হয়ে থাকে। সেই বন্যার পানি প্রতিবছর নদীর দুকূল ছাপিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। তাই বাংলার মানুষ জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে কীভাবে প্রকৃতির বন্যার সঙ্গে বসবাস করতে হয়। কিন্তু এবারের বন্যার পানির সঙ্গে রক্তচক্ষু ধারণ করে বাঁধের যে পানি আসছে তাতো আগ্রাসনের পানি। এই বাঁধের কপাট খুলে দেয়া পানি তো অবন্ধুসুলভ ভূরাজনৈতিক পানি। এই পানির স্রোতধারা তো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর জলবোমার আঘাত। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত একাধিক আন্তর্জাতিক আইন ও নীতিমালা রয়েছে। এর আলোকে অবশ্যই এখনই বাংলাদেশ সরকারকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। হেলসিংকী নীতিমালা ১৯৬৬-এর ৪ ও ৫ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত দেশ অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অন্য দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনা করবে। এজন্য অবশ্যই অন্য দেশে যাতে কোনো ক্ষতি না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। ২৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একই অববাহিকাভুক্ত একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অববাহিকায় প্রবাহিত পানির ব্যবহার সম্পর্কে গৃহীত পদক্ষেপ অবহিত করবে।

জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক অববাহিকা নীতিমালার ৭ এর ১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পার্শ্ববর্তী একই অববাহিকার অন্যান্য দেশের যাতে কোন বড় ধরনের ক্ষতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আইন অনুযায়ী আন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ নির্মাণের কারণে তার পানির প্রবাহ, স্রোতের গতিবেগ প্রতিদিনই মনিটরিং করে বাংলাদেশকে জানানো ভারতের অবশ্য কর্তব্য। রাষ্ট্রব্যবস্থায় সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন পরবর্তী গণঅভ্যুত্থানের ফলে বাংলাদেশের মানুষ যখন সীমাহীন আশা নিয়ে স্নিগ্ধ সোনালী সকালের স্বপ্ন দেখছিল, ঠিক তখনি পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ত্রিপুরা রাজ্যের ডম্বুর বাঁধের সবগুলো কপাট একসঙ্গে খুলে দিয়ে ভারত অবন্ধুসুলভ আচরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে। ডম্বুর বাঁধের পানি উপচে পড়ার আশঙ্কা থাকলে বাঁধের সবগুলো কপাট একসঙ্গে না খুলে অল্প কয়েকটি খুলেও উপচে পড়া নিয়ন্ত্রণ করা যেত। ভারত সরকারের মাথায় রাখা দরকার প্রয়োজনে আচরণ বদলানো যায়; কিন্তু প্রতিবেশী বদলানো যায় না। বাংলাদেশ ও ভারতের ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে আছে। কিন্তু বাঁধের কপাট খুলে দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশের মানুষের জীবনকে সংকটে ফেলে হৃদয়ে রক্তক্ষরণের যে ইতিহাস ভারত রচনা করল তা আর কোনোদিন উপশম হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু ডুম্বুর ড্যাম না, ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর উজানে আরো অনেকগুলো ব্যারেজ-ড্যাম আছে। যেমন : যৌথনদী কমিশনের তৈরি মানচিত্র অনুসারে বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে ৩৫ কিলোমিটার উজানে মুহুরী নদীর উপর মুহুরী (কলসী) ব্যারেজ, ৫২ কিলোমিটার উজানে গোমতি নদীর উপর মহারানী ব্যারেজ, ৫২ কিলোমিটার উজানে খোয়াই নদীর উপর খোয়াই ব্যারেজ এবং ৪৮ কিলোমিটার উজানে মনু নদীর উপর মনু ব্যারেজ নির্মাণ করা হয়েছে। আমরা ত্রিপুরার একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বরাতে শুধু ডুম্বুর ড্যামের গেট খুলে দেয়ার কথা জানি। অন্য ড্যামের গেটগুলোও খুলে দেয়া হয়েছে কি না, সে বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

এই ড্যামগুলো একযোগে খুলে দিলে বন্যার স্বাভাবিক প্রবাহের চেয়ে বেশি স্রোত মুহুরী, গোমতি, খোয়াই ও মনু নদী হয়ে বাংলাদেশের ফেনী, কুমিল্লা, হবিগঞ্জ, মৌলভিবাজার ইত্যাদি অঞ্চলে প্রবল বন্যার সৃষ্টি করবে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ সরকারের উচিত এই হীন কাজের তীব্র প্রতিবাদ জানানো। কারণ আগাম সতর্কতা পেলে অনেক মানুষকে সময় মতো নিরাপদে সরিয়ে আনা যেত। নদীতে বাঁধ দেয়ার ফলে ভারি বৃষ্টিপাতের মৌসুমে এই ধরণের পরিস্থিতি হবেই। বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর উপর ভারত একের পর এক বাঁধ নির্মাণ করে চলেছে বলেই একদিকে শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, পলি জমে বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতা কমে গেছে, অন্যদিকে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশকে না জানিয়ে বাঁধ খুলে দেয়ার কারণে ফ্ল্যাশ ফ্লাডের শিকার হচ্ছে।

ভারতীয় আগ্রাসনের পাশাপাশি বাংলাদেশের আবহাওয়া বিভাগ, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের দায়িত্বহীনতাও চরমভাবে ফুটে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের প্রভাবে চট্টগ্রাম, ফেনি, নোয়াখালী, কুমিল্লা এবং ভারতের ত্রিপুরায় ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আবহাওয়া অধিদপ্তর বন্যার বিষয়ে কোনো সতর্কতা প্রচার করেনি। ফেনী, নোয়াখালী, চৌদ্দগ্রামের পর বন্যার প্রভাব পরেছে কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলায়। গোমতী নদীর বাঁধ বুড়িচং উপজেলার বুরবুরিয়া নামক স্থানে ভেঙে নদীর উত্তরের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। তিন দশক আগেও কুমিল্লায় প্রতিবছর বন্যা হতো। এই বন্যার কারণেই গোমতী নদীকে বলা হতো কুমিল্লার দুঃখ। তাই বন্যা নিয়ন্ত্রণে গোমতী নদীর দুইধারে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল।

এবারের বন্যার কারণ হচ্ছে বাঁধ পানি ধরে রাখতে পারেনি। বাঁধ ভাঙার জন্য সাধারণ জনগণ দায়ী করছে, কিছু স্থানীয় ভূমিখেকোকে যারা নদীর বালু এবং বাঁধ সংলগ্ন মাটি অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণে সরবরাহ করেছে। কুমিল্লার বুড়িচং এর সমতল অঞ্চলে সৃষ্ট এবারের বন্যার পেছনে মানবসৃষ্ট এসব কর্মকাণ্ডকে এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা অঞ্চলগুলো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত হওয়ায় বৃষ্টি পরবর্তী পাহাড়ি ঢল খুব দ্রুতই সমতলে চলে আসে। বিভিন্ন অবকাঠামো, রেলসড়ক ও মহাসড়ক তৈরি হওয়ার কারণে এবং পাহাড়ি ঢলের পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকাও এবারের কুমিল্লা অঞ্চলের বন্যার একটি অন্যতম কারণ। অনাগত আগামীতে বন্যা পরিস্থিতি যেন আর ভয়াবহ আকার ধারণ না করতে পারে সেজন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করার দিকে মনোযোগী হতে হবে। অভিন্ন যেসব নদীতে ভারত বাঁধ কিংবা ড্যাম নির্মাণ করেছে, সেগুলো থেকে ন্যায্য হিস্যার পানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। নদীগুলোতে নাব্য ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি গঙ্গাচুক্তি নবায়ন করতে হবে। নতজানু পররাষ্ট্রনীতি পরিহার করে আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন আইন অনুযায়ী পানির হিস্যা প্রাপ্তিতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে। অভিন্ন নদীসমূহের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে প্রতিবেশী সুলভ মনোভাব নিয়ে দুদেশকে এগিয়ে আসতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত