কথিত বন্ধুদেশ কাছে আছে পাশে নেই

এ এইচএ খান রতন, লেখক : কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অধিকার সচেতন। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সরল সমীকরণে, জন্মগত এই স্বয়ংক্রিয় অনুভূতিতে বাধা এলে, স্বভাবজাত মানুষ প্রতিবাদী হয়ে উঠে। সৃষ্টির জন্মলগ্ন থেকে এ কারণে যুগে যুগে মানব জাতি হানাহানিতে জড়িয়ে, সভ্যতার বিনাশ ও রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছে। মিথ আছে পাগলেও নিজের স্বার্থটা বুঝে। নিকট অতীতে ফিরে তাকালে ১৯০ বছরের ব্রিটিশ শাসনে, অধিকার সচেতন মানুষের প্রত্যাশা পূরণের ব্যর্থতার ফলই ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগ। আবার ’৪৭-এর দেশ ভাগের কিছু কালের ব্যবধানেই স্বাধিকার সচেতন মানুষের মনে হলো তারা অধিকার বঞ্চিত, শোষণের শিকার। শুরু হলো প্রতিবাদ ও স্বাধিকার আদায় আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে দীর্ঘ ২৪ বছর স্বাধিকার আন্দোলন স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়ে অর্জিত হয় ’৭১-এর বিজয়। ১৯০ বছর ধরে ব্রিটিশ শাসনে মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির অসন্তোষ যেমন ’৪৭-এর দেশ ভাগ, ঠিক একই অভিযোগ, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাকই ডেকে আনে ’৭১। অবশেষে শোষণ ও অধিকার বঞ্চিত এ ভূখণ্ডের মানুষ ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর স্ফীতবক্ষে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে ভেবেছিল এবার আমরা মুক্ত। স্বাধীন ভূখণ্ড, নিজস্ব জাতিসত্তা, সংস্কৃতি কত কি! কিন্তু, গত ৫৩ বছর ধরে, সঙ্গত কারণেই শোষণে জর্জড়িত অন্তঃসারশূন্য বঞ্চিত এক জাতির, স্ফীতবক্ষে আত্মতৃপ্তির সে নিঃশ্বাস কতটা স্থায়ী হয়েছিল, এ প্রশ্ন আজ নিতান্তই অবান্তর। কেননা, ’৭১ থেকে ২০২৪ অর্ধশতাব্দীর এ কাল পরিক্রমায় সঙ্গত কানেই কোনো না কোনো দাবি আদায়ে শেষে মানুষ রাজপথ ছেড়ে ঘরে ফিরতে চাইলে ও রাজপথ মানুষকে ছাড়েনি। কখনো সরাসরি সামরিক স্বৈরাচার কখনো গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে মুখোশের অন্তরালে স্বৈরশাসনের কবলে মানুষকে বাধ্য হয়ে রাজপথে নামতে হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার অর্থ, ইতিহাস অস্বীকার করা, যা অসম্ভব, কারণ ইতিহাস তার গতিপথ বদলায় না। ’৭১ থেকে ২০২৪, জাতিসসত্তা হিসাবে আমাদের অগ্রগতি, আর একই অবস্থানের ব্রিটিশ শাসনমুক্ত অন্য দুটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

১৯৫৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করে মালয়েশিয়া। তার মাত্র ২০ বছরের ব্যাবধানে চোখ ধাধানো উন্নয়নে গোটা পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয় দেশটি। তার ৮ বছর পর ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভকরে সিঙ্গাপুর এবং এ দেশটি আরো কম সময়ে, এমনি এক যাদুকরি উন্নয়নে গোটা দুনিয়াকে অবাক করে দেয়, সারা পৃথিবীর কাছে যা এক বিস্ময়। এশিয়ার অর্থনৈতিক Emerging Tiger-এর রূপধারণ করে দেশ দু’টি। নিজ দেশের স্বার্থ বিবেচনায় রেখে, তাদের দক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ও মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণেই এ উন্নয়ন। স্বাধীনতা লাভের পর দু’টি দেশই National Development Manifesto প্রণয়ন করে, তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হয়। শুরু হয় দুর্নীতি মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক উন্নয়ন। আজ গোটা পৃথিবীর সামনে তারা উদাহরণ।

আর আমরা? প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছি অর্ন্তদ্বন্দ, খুন, জাতীয় সম্পদ লুট দুর্নীতি আর ক্ষমতা দখলের মহোৎসবে। ফলে ডিসেম্বর ১৬ তারিখের আত্মতৃপ্তির মুক্ত সেই নিঃশ্বাসটি অবলীলায় বাতাসে মিলিয়ে গেল। অর্ধশতাব্দী ধরে রাজনীতিবিদের উন্নয়নের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি আলেয়ার পেছনে ছুটছি আমরা। দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্যি যে, এমনি এক ভূখণ্ডের অধিবাসী আমরা, যাদের উর্বর ভূমি, দক্ষ শ্রমশক্তিসহ উন্নয়নের সব উপকরণ থাকার পরও দুর্নীতিমুক্ত নেতৃত্বের অভাবে দেশটির এ দুরবস্থা। উন্নত দেশের তুলনায় নাজুক অর্থনীতির এক ভয়াবহ চিত্র। শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শ্রমিক শ্রেণির বিদেশনির্ভরতা, আর পোশাক শিল্পের রপ্তানি হলো বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের একমাত্র ভরসা। অথচ টালমাটাল অর্থনীতির এ পরিস্থিতিতেও একশ্রেণির সরকারি আমলা ও বেসরকারি লুটেরারা স্ত্রী-সন্তানসহ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচারে মরিয়া, যা প্রতিরোধ করা প্রায় অসম্ভব। যেহেতু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশগড়ার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের, এ ব্যর্থতার দায় তাদেরই। তাই আজ জনগণের জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় তাদের নির্লজ্জ অবস্থান।

একটা দেশের জাতীয় ঐতিহ্যনির্ভর করে তার সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও মানবাধিকার সক্ষমতার ওপর; নতজানু পররাষ্ট্র নীতির মাধ্যমে নয়। আমাদের কথিত বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটিশ আমলের মহাজনি ঋণের মতো ভারসাম্যহীন ঋণের ফাঁদে আজও আমরা আঁটকে আছি, পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে যা বহুকাল আগে। বন্ধুদেশ বন্ধুদেশ বলে মুখে সফেদ সাদা ফেনা তুলে ফেললেই কোনো দেশ বন্ধুদেশ হয়ে যায় না। প্রতিটি দেশের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে, জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তা নির্ধারিত হয়। একেক দেশের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়ে থাকে। উদাহরণ স্বরূপ, ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে আমেরিকার অবস্থান যেমনটি হবে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমনটি নাও হতে পারে। বিষয়টি জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ও ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পর্যায়ের নয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি সংবর্ধনায় গালিচা কতটা লাল ছিল, বিমানবন্দরে স্বাগত জানাতে কে উপস্থিত ছিল, এসব নিয়ে যারা চর্চায় ব্যস্ত, তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। বন্ধুত্ব আর পররাষ্ট্রনীতিতে তারা জ্ঞানপাপী।

ঝুলে থাকা তিস্তা চুক্তিই-এর বড় উদাহরণ। দু’দেশের সরকারের মাঝে উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ গভীর সম্পর্কের ব্যাপক প্রচারণা রয়েছে, নিয়মিত আম, ইলিশ, জামদানি শাড়ি আদান-প্রদান হলেও জাতীয় স্বার্থ বিবেচনায় কোনো রূপ ছাড় দেয়নি দেশটি। যদিও আন্তর্জাতিক আইনে প্রকৃতির প্রবাহ নদীর পানিতে আমাদের অধিকার রয়েছে।

লক্ষ্য করুন : কথিত বন্ধুরাষ্ট্রটি ২০১০ সালে তাদের এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে ৭ সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ মঞ্জুর করে; যেটিকে LOC বা লাইন অব ক্রেডিট বলা হয়। শর্ত বেঁধে দেয়, ঋণের এই অর্থে কেনাকাটার ৭৫ শতাংশ তাদের দেশ থেকে ক্রয় করতে হবে। বিশেষ করে বাস, ট্রাক, লোকমোটিভ বা রেলের ইঞ্জিন ক্রয় বাধ্যতামূলক করে দেয়। শুধু তাই নয়, তাদের Transshipmen : বা পণ্য পরিবহনের সুবিধার্থে আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার সড়ক পথ নির্মাণ চলছে। শর্তানুযায়ী এই প্রকল্পের ৩৫৬৭.৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ মঞ্জুরীকৃত LOC বা লাইন অব ক্রেডিট থেকে ব্যয় করতে হয়েছে। পৃথিবীর কোথাও এমন আত্মঘাতী শর্তযুক্ত বন্ধুত্ব ঋণের উদাহরণ আগে কেউ শুনেছেন বলে জানা নেই। ঋণের এই অভিনব শর্তযুক্ত পদ্ধতিটি গিনেজ বুক অব রেকর্ডে স্থান পেতে পারে। কারণ, এ জাতীয় শর্তযুক্ত ঋণ পৃথিবীতে আর নাও হতে পারে।

পূর্বে উল্লেখ করেছি প্রতিটি দেশের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে, আমাদেরও আছে। তবে গণআন্দোলনে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেনের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী কথিত বন্ধুদেশটির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক না কি একেবারে স্বামী-স্ত্রী পর্যায়ের! যে দৃষ্টিকোণ থেকেই কথাটি তিনি বলে থাকুন, সাবেক মন্ত্রীর বক্তব্য দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য বটে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত আর্থিক সচ্ছলতা মানুষকে পরিবার আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও সামাজিকভাবে যেমন মর্যাদাশীল করে তোলে, দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী দেশের বিষয়টিও তেমনি।

Globalization-এর এ যুগে দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো শক্তিশালী কোনো দেশের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই ঘোষিত-অঘোষিত সব বিষয়ে নতজানু নীতিতে বাধ্য হয় বা পেরে ওঠে না। আয়তনের তুলনায় আমাদের দেশ সিঙ্গাপুরের ২০৪টি দেশের সমান। স্থান সংকোচনজনিত কারণে দেশটিতে বিমান ল্যান্ড করে ফ্লাইওভারের ওপর। এত ক্ষুদ্র একটি দেশের জনগণ কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের জন্য কোনো প্রকার ভোগান্তির শিকার হয়নি। এতে সহজে অনুমেয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মর্যাদার সূচকে তাদের ও আমাদের অবস্থানগত পার্থক্য। দুঃসময়ে ভ্যাকসিনের জন্য অগ্রিম অর্থ পরিশোধের পরও যথাসময়ে ভ্যাকসিন দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বিপদে ফেলে আমদের। নিত্য প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ নিয়ে বন্ধুরাষ্ট্রটি যে ঝাঁঝালো লংকাকাণ্ড ঘটায় এ দেশের মানুষ তার ভুক্তভোগী। গরু রাজনীতি, ভিসা রাজনীতি, চাল নিয়ে চালবাজির ধারাবাহিক নাটক তো চলছেই।

বন্ধুত্বের এমন অদ্ভুত নিদর্শন সম্ভবত পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া ভার, যার সমাধান বলে কিছু নেই। গত পাঁচ দশকে পাখির মতো নির্বিচার একতরফা সীমান্তহত্যা বন্ধ হয়নি। ঘটনার পর বড়জোর নিষ্ফল পতাকা বৈঠক আর প্রতিশ্রুতি পর্যন্তই আমাদের সান্ত¡না। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দু’দেশের সরকারের উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে প্রায় দুই ডজনের মতো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য এক অদ্ভুত শর্ত ছিল সীমান্তহত্যা কমিয়ে আনা! যে চুক্তির মাঝেই সীমান্ত হত্যার স্বীকৃতি রয়েছে। কমিয়ে আনা মানে, সীমান্তহত্যা চলবে, তবে কম; কি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত! বন্ধুরাষ্ট্রটি প্রকৃতির শ্বাশ্বত নিয়মে গঙ্গার উপর চলমান জলধারায় ফারাক্কাবাঁধ নির্মাণ করে শুষ্ক মৌসুমে পানি আটকে রেখে উত্তরবঙ্গে মরুভূমি তৈরি করে, আবার বর্ষা মৌসুমে গেট খুলে দিয়ে দুর্যোগ তৈরি করে। দীর্ঘদিন ধরে তিস্তা চুক্তির মূলা ঝুলিয়ে অবশেষে গত মাসে রাজ্য সরকারের মুখ্য মন্ত্রী এক বক্তব্যে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দিতে অপারগতার কথা জানায়। বরং আমাদের ফেনী নদীর পানি নেয়ার পাঁয়তারা করছে তারা।

‘৭১-এর ৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার স্বীকৃতি প্রদান করে দেশটি, যা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণীয়। কিন্তু, অদ্যবধি দ্বিপক্ষীয় যত চুক্তি কথিত বন্ধুদেশটির সঙ্গে সাক্ষরিত হয়েছে, তার কোনো একটিও বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনার তো প্রশ্নই আসে না, সমতার ভিত্তিতেও করা হয়নি। আমদের প্রয়োজন ছিল স্বাধীনতা, তারা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে সবচেয়ে বড় সহযোগী দেশ। সমরাস্ত্র, শরণার্থী আশ্রয়, বহির্বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়সহ সর্বাত্মক সহযোগিতা ও অবদান অবশ্যই আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু, এই সহযোগিতা তারা কেন করেছিল তার উত্তর এ ক্ষুদ্র নিবন্ধে লেখা সম্ভব নয়। স্বল্পপরিসরে শুধু এটুকু বলা যেতে পারে, বন্ধুত্বের টানে নয়, বন্ধু দেশটির বৃহত্তর স্বার্থেই আমাদের স্বাধীন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল, সেটিই তারা করেছে। বিনিময়ে ১৮ কোটি জনসংখ্যার এক Monopoly বাণিজ্যিক বন্দরে পরিণত করেছে আমাদের দেশকে। যেখানে এমনিতেই বিশাল বাণিজ্য ঘাটতিসহ অসম দ্বিপাক্ষিক সমস্য বিদ্যমান।

আমদানিনির্ভর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এদেশের মানুষ জানে না, আজ যে দামে চাল, ডাল, পেঁয়াজ কিনছে, কাল তার দাম কি হবে! পরমুখাপেক্ষিতার এই দায়ভার অধিকার আদায়ে নির্বাক নতজানু নীতিনির্ভর মেরুদণ্ডহীন রাজনীতিকদের, আর ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। যারা গত ৫৩ বছর ধরে জাতিকে অর্থনৈতিক মুক্তির মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে নিজেরা ফুলেফেঁপে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ বিদেশে পাচার করছে।

আক্ষেপের সুরে বলতে হয়- স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও খাদ্য, শিল্প, শিক্ষা, প্রযুক্তি কোনো ক্ষেত্রেই আমরা স্বনির্ভর নই। সাইনবোর্ড সর্বস্ব প্রতিভাহীন রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা দেশ প্রেমের স্লোগানে লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন জাতি আমরা, যে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির মাস্টার প্ল্যান বা চূড়ান্ত রোডম্যাপ বলে কিছু নেই। পৃথিবীর প্রায় দুইশতাধিক দেশের মধ্যে, পশ্চিমাদের নিজস্ব স্বার্থে, খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ আফ্রিকার কিছু দেশকে দরিদ্র বানিয়ে রাখা ছাড়া বলতে গেলে গোটা বিশ্ব আজ স্বনির্ভর। জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, গবেষণা, শিক্ষায় উন্নতির এমন স্তরে পৌঁছে গেছে যে, নিজেদের প্রয়োজন না থাকায় বিনিয়োগের জন্য এখন উপযুক্ত স্থান ও পরিবেশ খুঁজছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এরই মধ্যে আমাদের দেশেও বিনিয়োগ করেছে। দক্ষ-মেধাসম্পন্ন এক্সপার্ট বা প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগকারীদের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারার ব্যর্থতায় শোষণের পরিণতি ভোগ করতে হতে পারে। আন্তর্জাতিক মানের বৈদেশিক চুক্তির ওপর দক্ষ জনশক্তির অভাবে গ্যাস চুক্তি, দিনাজপুরের কঠিন শিলা প্রকল্পের মতো বেশ কিছু চুক্তিতে পুঁজিবাদের নতুন সংস্করণ ফেঁসে আছি আমরা।

প্রযুক্তি জ্ঞান ও সক্ষমতা না থাকায় পরনির্ভরশীলতাই আমাদের বাধ্য করেছে বিনিয়োগকারীদের অসম শর্তে ঝুঁকি জেনেও তা গ্রহণ করতে। যদিও আধুনিক বিশ্বে মেধাসম্পন্ন জনশক্তি তৈরি থাকলে ভৌগোলিক অবস্থান কোনো সমস্যা নয়, যদিও ভৌগোলিকভাবে এমনই এক স্থানে আমাদের অবস্থান যে, নিজ দেশের মানচিত্র খুঁজে পেতে অন্য একটি দেশের ভেতর খুঁজে নিতে হয়। ভাগ্যিস বিধাতার ইচ্ছায় দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান, নাহলে কথিত বন্ধু রাষ্ট্রটির আচরণ কিরূপ হতো তা বলাবাহুল্য। দুঃখজনক হলেও বলতে দ্বিধা নেই স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পরও খাদ্যে, শিল্পে, প্রযুক্তিতে কোনো ক্ষেত্রেই আমরা স্বনির্ভর নই। জাতীয়বাদ আর দেশপ্রেমের মিথ্যা স্লোগানে লক্ষ্য উদ্দেশ্যহীন এক গন্ত্যব্যের যাত্রী আমরা।

তার ওপর পার্শ্ববর্তী বৃহৎ একটা দেশ, সামরিক অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব সক্ষমতা থাকার পরও অর্ধশতাব্দী ধরে ক্ষুদ্র একটি দেশের সঙ্গে কৌশলী বন্ধুত্বের ছদ্মবেশেী অবন্ধুসুলভ যে আচরণ তারা করছে, তা নিতান্তই দূঃখজনক। তাই আমাদের বুঝতে হবে, আমেরিকার নাকের ডগায় ফিদেল কাস্ত্রোর কিউবা কেউ আমাদের বানিয়ে দেবে না, আমাদেরই হয়ে উঠতে হবে। নতজানু নীতি পরিহার করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্তটি আমাদেরই নিতে হবে। দরকার শুধু দেশপ্রেম।