ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

শ্রীলঙ্কার নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক উত্তরণে যাত্রা

অলোক আচার্য, লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
শ্রীলঙ্কার নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক উত্তরণে যাত্রা

শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উত্তরণের ধাপগুলো বিশ্বের জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। রাজাপাকসে পরিবারের জনরোষে ক্ষমতা থেকে নামা, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি প্রায় দেউলিয়া হওয়া এবং পরবর্তীতে সবকিছু সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো এটা এক কথায় কল্পনাতীত। এত দ্রুত অর্থনীতিতে মুল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা দেশটির বর্তমান অবস্থাকে বিশ্বের সামনে পজিটিভ ধারণা এনে দিয়েছে। যেখানে করোনা থেকে বেরিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পারি দিয়ে অভ্যূত্থানের আগের অবস্থায় ফিরে এসেছে। মূল্যস্ফীতির হার আগস্ট মাসে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এএফপির সংবাদে বলা হয়েছে, আগের বছরের অর্থাৎ ২০২৩ সালের আগস্ট মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ শতাংশ; চলতি বছরের জুলাই মাসে যা ছিল ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

সেখান থেকে একধাপে তা ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শ্রীলঙ্কার পরিসংখ্যান মন্ত্রণালয় এই পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। খাদ্য থেকে শুরু করে খাদ্যবহির্ভূত পণ্য-সবকিছুর দাম আগস্ট মাসে কমেছে। সংবাদে আরো বলা হয়েছে, গত জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় বিদ্যুতের দাম ২২ দশমিক ৫ শতাংশ কমেছে। সেই সঙ্গে পানি, জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের দাম কমেছে। মূলত এসব কারণে আগস্ট মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি এতটা কমেছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি ৬৯ দশমিক ৮০ শতাংশে উঠেছিল। সেখান থেকে পরিস্থিতির উত্তরণ হয়েছে। ২০২২ সালে ঋণখেলাপি হয়ে যাওয়ার পর শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে জোর দেয়। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, তার ফল পেতে শুরু করেছে দেশটি। অর্থনীতি পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা। ফলে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। জুলাই মাসের শেষে দেশটির রিজার্ভ দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন বা ৫৭০ কোটি ডলার; ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৪ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ৪৪০ কোটি ডলার। অর্থাৎ সাত মাসে রিজার্ভ বেড়েছে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন বা ১৩০ কোটি ডলার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং অর্থ পাচার বন্ধ হওয়া।

অর্থনৈতিক সংকট থেকে শ্রীলঙ্কার উত্তাল পরিস্থিতির শুরু। এমন ভয়াবহ জনগণের বিক্ষোভে ঘটেছে বিপুল সংখ্যক আহত হওয়ার ঘটনাও। ক্ষুধার জ্বালায় একসময় প্রচুর মানুষ কাটিয়েছে। বেকারত্ব ঘিরে ধরেছিল দেশটিতে। সহিংসতায় এমপি নিহত হওয়ারও ঘটনা ঘটে তখন। সেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ২১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। পৃথিবী একটি গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হওয়ার সুবাদে একটি দেশের নির্বাচন মূলত সেই দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করে না। পারিপার্শ্বিক বিশ্ব এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিকেও প্রভাবিত করে।

মালদ্বীপের নির্বাচনেও সেই বিষয়টি লক্ষ্য করা গেছে। কারণ কোনো দল এবং নেতার উপর নির্ভর করে সে কোন বলয়ে যাবে। পৃথিবী এরইমধ্যে দুটি বলয়ে বিভক্ত হয়েছে। পরাশক্তির দেশগুলো চায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে নিজেদের পছন্দের মানুষকে ক্ষমতায় আনতে। এই নিয়ে শুরু হয় প্রতিযোগীতা। অতীতেও শ্রীলঙ্কার নির্বাচন নিয়ে এই প্রতিযোগীতা হয়েছে। এবারও হবে। এই নির্বাচনে যে-ই ক্ষমতায় আসুক প্রধান লক্ষ্যই থাকবে অর্থনীতির উত্তরণ ধরে রাখা এবং অতীত বা সাম্প্রতিক ঘটনা বিশ্লেষণ করে পূর্বের ভুলগুলো শুধরে নেওয়া এবং ভুলের পুনরাবৃত্তি না করা। শ্রীলঙ্কার ঘনিষ্ট দুই প্রতিবেশী ভারত ও চীন। চীনের কাছ থেকে নেয়া বিপুল অংকের ঋণ এবং পরিশোধ করার ক্ষমতা না থাকাও ছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বিপর্যয়ের একটি কারণ। এরপর উন্নয়ন এবং ঋণ নিতে শ্রীলঙ্কাকে দুবার ভাবতে হবে। কিন্তু চীনকে এড়িয়ে যাওয়াও শ্রীলঙ্কার পক্ষে সম্ভব না। কারণ এই মুহূর্তে চীন বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। আবার তাদের অর্থনৈতিক উত্তরণে ভারতেরও যথেষ্ট সহায়তা রয়েছে। ধারণা করা যায় তারা একটি ব্যালান্স রেখেই চলবে। জনবিদ্রোহের আগে সেখানে গত দুই দশক ধরে রাজাপাকসে পরিবার ক্ষমতায় ছিল। তাদের পিতা আলউইন রাজাপাকসের হাত ধরেই গড়ে ওঠে এসএলএলপি (শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি)। ২০০৫ সালে মাহিন্দ রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট ও তার ভাই গোতাবাইয়া প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন। এরপর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয় পান এবং ২০২০ সালের পার্লামেন্টারি নির্বাচনেও জয় পান।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী করা হয় এই রাজপাকসে পরিবারকে। সেই পরিস্থিতিতে ২০২২ সালের জুলাই মাসে নতুন প্রেসিডেন্ট হন ৭৫ বছর বয়সি বিক্রমাসিংহে। দেশটিতে এক কোটি ৭০ লাখ বৈধ ভোটার আছেন। তারা আগামী ৫ বছরের জন্য দশম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন ব্যবস্থায় একজন ভোটার তার পছন্দের তিনজন প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবেন। যে প্রার্থী শতকরা ৫০ ভাগ বা তারও বেশি ভোট পাবেন তিনি বিজয়ী হবেন। কিন্তু কোনো প্রার্থীই যদি শতকরা ৫০ ভাগ ভোট না পান তাহলে সবচেয়ে বেশি ভোট যে দু’জন প্রার্থী পাবেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভোট হবে। তাতে যিনি বেশি ভোট পাবেন তিনিই হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট। কঠোর নিরাপত্তায় কয়েক হাজার ভোটকেন্দ্রে হবে ভোটগ্রহণ। শ্রীলঙ্কার বিট্রিশ উপনিবেশের অংশ ছিল। স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালে। এখন যিনি প্রেসিডেন্ট গোতাবায় রাজাপক্ষের পিতা ডি এ রাজাপক্ষে ১৯৪৭ সালে হামবানটোটা ডিস্টিক্ট থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৫১ সালে শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে পরিবারটি গুরুত্বপূর্ণ হতে শুরু করে। অর্থাৎ রাজাপক্ষে পরিবার বহু বছর ধরেই শ্রীলংকা রাজনীতিতে পরিচিত, জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি মুখ। ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন গোতাবায় রাজাপক্ষে। শ্রীলঙ্কার নির্বাচনের দিকে এখন শুধু ভারত ও চীনের মনোযোগই না বরং আমেরিকাও পরোক্ষভাবে রয়েছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে দুই প্রতিবেশী দেশ যে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে সেটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। কারণ দুই দেশেরই বাণিজ্যিক এবং আনুষঙ্গিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে দেশটির সাথে। ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যগত সম্পর্ক বেশ পুরোনো এবং গভীর। যদিও শ্রীলঙ্কা উভয় দেশের সাথেই ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে।

১৯৪৮ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সংসদীয় কাঠামো ছিল শ্রীলঙ্কায়। পার্লামেন্টের নির্বাচনে সর্বাধিক আসন পাওয়া দল প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করত। তিনি মন্ত্রিসভা গড়তেন। তিনিই ছিলেন সরকারের প্রধান। শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২২৫। তাদের মধ্যে ১৯৬ জন সারা দেশের ২৫টি প্রশাসনিক জেলা থেকে সরাসরি ভোটে জিতে আসেন। বাকি ২৯ জন এমপি মনোনীত হয়ে আসেন- কোন দল কত ভোট পাচ্ছে, সেই অনুপাতের ভিত্তিতে। ভোটের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। শ্রীলঙ্কার পরবর্তী নেতৃত্বকে অবশ্যই দুর্নীতিমুক্ত হতে হবে। লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো যে, রাজপাকসের পরিবারের দিকে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে ডোবানোর এবং অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির জন্য দায়ী সেই রাজপাকসেও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতার জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। জনগণের সমর্থন পাওয়া বা না পাওয়া সেটি পরের ব্যাপার। যে দল বা ব্যক্তিই ক্ষমতায় আসুক শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে পুরোপুরি একটি সন্তোষজনক অবস্থায় আনাটাই হবে চ্যালেঞ্জের। বেকারত্ব কম করা, পর্যটন শিল্প আরো উন্নয়ন করা, অর্থনীতির গতি আনা ইত্যাদি কাজগুলো করতে হবে। এবং অবশ্যই দুর্নীতিকে না বলতে হবে। কারণ এখন শ্রীলঙ্কা যার হাতে থাকবে সে নিশ্চয়ই একটি নতুন শ্রীলঙ্কা পাবে। সেই শ্রীলঙ্কাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব থাকবে তার হাতে। পেছনে থাকবে একটি ইতিহাস যেখান থেকে সে শিক্ষা নিতে পারে। আর না নিলে কি হবে তা শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ প্রজন্মই বলে দিবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত