রক্ত দিতে হয় সময়ে, অসময়ে নয়

অচিন্ত চয়ন, লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

সমাজ নির্মাণের স্থপতি হলেন শিক্ষক। শিক্ষকরাই ছাত্রদের জীবনকে আলোকিত করতে আলোর মিছিলে দাঁড় করান। অথচ সত্য-মিথ্যা যাচাই-বাছাই না করে পরিকল্পিতভাবে অভিযোগ তুলে জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরসহ জুতার মালা গলায় ঝুলানো, বিভিন্ন অশোভনীয় বাক্যে গালি দেয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মানুষ গড়ার কারিগরদের প্রতি এমন অমানবিক ঘটনা, জাতি হিসেবে আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জাকর। এটি সামাজিক অবক্ষয়ের চূড়ান্ত পরিণতি। এটিও দাবি! শিক্ষকদের অপমান করা কেমন দাবি- প্রশ্ন রেখেই ‘দাবির মুখে স্বাধীন দেশ’ এ বিষয়ে লেখার দুঃসাহস করছি। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে দাবি থাকবে, দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামবে, আন্দোলন করবে- এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সব দাবি হতে হবে নীতিগত যৌক্তিক। আবার আন্দোলনও সময়-পরিবেশ বুঝেই করতে হয়। অসময়ে যৌক্তিক দাবি নিয়েও আন্দোলন করা অযৌক্তি হয়ে যায়। ‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।’- এই বাক্যটি চিরসত্য হলেও অনেকে ভুল ব্যাখ্যা করে থাকেন। ‘সময়-অসময়’ বিষয়টি আগে বুঝতে হবে। না বুঝেই অনেকে গুলিয়ে ফেলেন- তখনই সৃষ্টি হয় যত ঝামেলা, যে ঝামেলার মাশুল দিতে হয় দেশ ও জাতিকে। ‘দাবি’ শব্দটিকে মানুষ বিভিন্নভাবে ব্যবহার বা ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকলেও দিনশেষে দাবিই হয়ে যায়। সরকার পতনের পর ঢাকা অনেকটা দাবির শহরে পরিণত হয়েছে। ব্যক্তিগত অনুভূতির জায়গা থেকে আলাদা আলাদা হলেও দাবির শহর হিসাবে ঢাকা গড়ে উঠেছে এ বিষয়ে দ্বিমত নেই অনেকের। কিছু হলেই প্লেকার্ড, ফেস্টুন ও ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আন্দোলন শুরু, শেষ হয় জনদুর্ভোগে।

দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও মানুষ ইতিহাস বা বিশেষ করে স্লোগানধর্মী কবিতার চরণ ভুলতে পারেন না। কবি হেলাল হাফিজের কবিতার চরণেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ এ পঙ্ক্তি ইতিবাচক না হলেও নেতিবাচকভাবেই কাজে লাগছে। এটি কবির দোষ নয়- আমাদের ব্যবহারে পঙ্ক্তিটি নিমজ্জিত হয়। এ আঁধার নেমে আসে অতি আবেগী ও উৎসাহী কতিপয় মানুষের জন্য। মানুষ হতে হতেই আমাদের জীবনে আঁধার নেমে আসে, দূরের যাত্রায় সময় না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে কাজ করার ফল ভালো হয় না। কথায় কথায় আন্দোলন, এক দফা এক দাবি। দেশটি দাবির মুখে, অসংখ্য দাবির কারণে ক্লান্ত হচ্ছে দেশ। অতীতের সেতুতে বিবেক রাখি না, আমরা দেশ নয়- নিজের জন্য হাঁটছি, হেঁটে যাচ্ছি বহুদূরে। রাত-দিন পার করে পায়ে তাকিয়ে দেখি পা স্থীর, কোনো পরিবর্তন নেই। একটু অতীতে ফিরতে চাই- ছাত্র-জনতার ‘গণ-অভ্যুত্থানে’ শেখ হাসিনার পতনের পর মুহূর্তেই পরিবর্তন হয় দেশের চিত্র। বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেয়া থেকে শুরু করে ভাঙচুর, দখল এবং বিভিন্ন অফিসে হামলা হয়। এ সংকটের মধ্যেই গঠন হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের উদ্যোগে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হতে থাকে। কিন্তু দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলন ক্রমেই বাড়তে থাকে।

অনেকটা কথায় কথায় আন্দোলনে নামার হিড়িক। রাজধানীতে আবার শুরু হয় দাবি আদায়ের আন্দোলন- ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নানা দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় নেমে যায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, যাদের কারণে যানজটের এ শহরে ভোগান্তির মাত্রা অরো তীব্র হয়। এরইমধ্যে সরকার অনেকের দাবি মেনেও নিয়েছেন, তবু বন্ধ হচ্ছে না আন্দোলন।

নতুন সরকার গঠনের পর থেকে দাবির মিছিল শুরু হয়েছে। আঠারো কোটি মানুষের সবার কোনো না কোনো দাবি আছে। সেই দাবি মেটানোর এখনই সময়। কারো দাবি কর্তৃপক্ষের পদত্যাগ। কেউ কেউ ডাক্তার পরিচয়ের জন্য মেডিকেল লাইসেন্স চাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ চাচ্ছেন নতুন পারমিট। রিকশাচালকরা মোটরচালিত রিকশার ওপর নিষেধাজ্ঞা চান, মোটরচালিত রিকশাচালকরা চান উল্টো। কেউ কেউ তাদের চাকরি নিয়মিত করতে চান। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে টানা কয়েকদিন আন্দোলন করেছেন বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে থাকা আনসার সদস্যরা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লীবিদ্যুৎ সমিতিকে একীভূত করে অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়ন এবং চুক্তিভিত্তিক ও অনিয়মিতদের চাকরি নিয়মিত করার দুই দফা দাবি বাস্তবায়ন এবং মন্ত্রণালয়ের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন আন্দোলনরত ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ব্ল্যাকআউটের শঙ্কাও ছিল কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সমাধানের আশ্বাস দেয়ার পর আন্দোলন প্রত্যাহার করেছেন তারা। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। সর্বশেষ গতকাল দাবি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন সদ্য অপসারণ করা ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানরা। তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান করেন। তাদের দাবি আমরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচন করেছি, কিন্তু দলের অপরাধে আমাদের কেন অপসারণ, এ অপসারণ অযৌক্তিক ও বৈষম্য। যদি কোনো উপজেলা নির্বাচনে অনিয়ম হয়ে থাকে তদন্ত সাপেক্ষে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন এমনই প্রত্যাশা তাদের। আবার কেউ কেউ তাদের বকেয়া দাবি-দাওয়ার দাবিও জানিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ যে-ই হোক, দাবি যার কাছেই হোক, কাজ একটাই রাজপথ বন্ধ করে দিতে হবে। এটাই একমাত্র রাস্তা। এসব দাবিদারদের কাছে মানুষ এখন অসহায়। তারা রাস্তা অবরোধ করছে। সাধারণ মানুষ হেঁটে গন্তব্যে যাচ্ছে কিংবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে বসে থাকছে।

একটি বিষয় না বললেই নয়- বিগত সরকার পতনের পর থেকে পুলিশের তৎপরতা না থাকায় বিভিন্ন সড়কে কয়েকদিন ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ বাহিনী ধর্মঘটে যাওয়ার পর রাস্তাঘাটে যানবাহনের আইনকানুন মেনে চলার মতো কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে যে যার মতো চালাচ্ছিল বাহন। এই অব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুহূর্তের মধ্যেই দাঁড়িয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। শুধু তাই নয়, যানবাহনের শৃঙ্খলাসহ বিভিন্ন জনসেবামূলক কাজ করেন শিক্ষার্থীরা। এ শৃঙ্খলায় যানজট অনেকটা কম ছিল। কিন্তু এই আশার প্রদীপ বেশি জ্বলেনি। ক্ষমতার পালাবদলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে নানা দাবি নিয়ে ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় প্রতিদিন নামছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ বাড়ে। যানজটের এই শহরে ভোগান্তির মাত্রা আরো তীব্র হয়। যানজটে নগরবাসীর জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। কথা হচ্ছে- বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের দাবি থাকতেই পারে, তারা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সরকারের কাছে দাবিও করতে পারেন কিন্তু পরিবর্তিত রাষ্ট্রে এভাবে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাস্তা অবরোধ থাকলে দুর্ভোগে পড়ে নগরবাসী। যানজটের কবলে পড়ে মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি কমছে। আর এতে জাতীয় অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বৈদেশিক বিনিয়োগ পিছিয়ে পড়ার অন্যতম কারণ যানজট। আমাদের মনে রাখতে হবে এ দেশ আমার, আমাদের। আমাদের কারণে দেশের ক্ষতি হলে সে দায়ও আমাদের নিতে হবে। তাই দাবি আদায়ের জন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে- ‘সময় সাপেক্ষে সবার দাবি নিয়ে কথা বলা হবে।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে- দাবি আদায়ের মৌসুম এসেছে। এ যেন মামা-বাড়ির আবদার। কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ আমাদের অবস্থা হয়েছে যৌবন থাকুক বা না থাকুক, রাস্তায় নামার এখনই সেরা সময়। দাবি আদায়ের আন্দোলনে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবরোধ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে জনদুর্ভোগ বাড়ে। যানজটে নগরবাসীর জীবন অনেকটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে নতুন সরকারের প্রধান কাজ দেশ সংস্কার করা, সেই কাজেও আন্দোলন বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমরা কোথায় নতুন দেশের, নতুন সরকারকে সহযোগিতা করবো, তা না করে আরো বাধা দিচ্ছি- যা খুবই দুঃখজনক। কথা হচ্ছে- বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের দাবি থাকতেই পারে, তারা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সরকারের কাছে দাবিও করতে পারেন কিন্তু পরিবর্তিত রাষ্ট্রে এভাবে আন্দোলন কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে এ দেশ আমার, আমাদের। আমাদের কারণে দেশের ক্ষতি হলে সে দায়ও আমাদের নিতে হবে। তাই দাবি আদায়ের জন্য ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা জরুরি। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে এদেশে ‘গণঅভ্যুত্থান’ ঘটেছে, এ বিষয়টি এত সহজে ভুলে গেলে চলবে না। কথায় কথায় আন্দোলনের নামে রাস্তা অবরোধ এবং নতুন সরকারকে সহযোগিতা না করা অযৌক্তিক। এ অবস্থা কোনোমতেই কাঙ্ক্ষিত নয়। আমরা মনে করি আলোচনার মধ্য দিয়ে যে কোনো সংকটের সমাধান করা সম্ভব। আমরাও চাই এ সমস্যার দ্রুত একটি সমাধান আসুক। এ ব্যাপারে দু’পক্ষকেই নমনীয় হতে হবে। বিগত সরকারের মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিলে নতুন সরকার ইমেজ সংকটে পড়বেন। তাই সদ্য গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিষয়টি সমাধানের জন্য বুদ্ধিভিত্তিক উদ্যোগ নিতে হবে। সময়ক্ষেপণ না করে- এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মনে রাখা জরুরি- ‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার শ্রেষ্ঠ সময় তার।’ পঙ্ক্তিটি চিরসত্য কিন্তু যৌবন থাকলেই যুদ্ধে যেতে নেই। যুদ্ধেরও সময় থাকে, থাকে বিবেকের দৃশ্য- আবেগ নয়, বিবেক কাজে লাগিয়ে যুদ্ধের ময়দানে যেতে হয়, রক্ত দিতে হয় সময়ে, অসময়ে নয়।