সাংবিধানিক স্বীকৃতিতে কেন উপেক্ষিত নজরুল?

রাজু আহমেদ

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

তোমাদের পানে চাহিয়া বন্ধু আর আমি জাগিব না/কোলাহল করি সারা দিনমান কারো ধ্যান ভাঙিব না/ নিশ্চল নিশ্চুপ/আপনার মনে পুড়িব একাকী গন্ধবিধুর ধূপ।’ - এমন ধূপের মতো নিভৃতে কাটিয়ে যাওয়া মানুষটি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মনের আকাশে আজও সুখের দ্যোতনা ছড়ান, সুরের ঝাণ্ডা ওড়ান। কথা হচ্ছে আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। তার ভূমিকা শুধু স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে নয় বরং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বাংলা ও বাঙালির স্বাধীকার আদায়ের প্রতিটি মঞ্চে আজও তিনি প্রেরণার বাতিঘরের ভূমিকা পালন করেছেন। কখনো কলম হাতে, কখনো সুরের সাথে আবার কখনোবা রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে। উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিমকে এক সুতোয় গাঁথার চেষ্টায় আত্মনিয়োগকারী মহান ব্যক্তিটির অসাম্প্রদায়িক চেতনাপ্রসূত কাব্য-গান-গদ্য বাঙালি জাতির জন্য বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপহার। মানুষের মুক্তির কথা বলতে গিয়ে যে মানুষটি শাসন-শোষণ ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অকপট ও সোচ্চার থেকে অবিচলভাবে বলে গেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’-সে মহান ব্যক্তিকে আমরা আমাদের স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পেরিয়ে যাওয়ার সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে না পারায় আমাদের মানসিকতা ও রাষ্ট্রের দৈন্যভাবের প্রকাশ ঘটিয়েছি। কোন অজ্ঞাত কারণে গণমানুষের কবি নজরুলকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি আজও প্রদান করা হয়নি তা সত্যিকারেই স্পষ্ট হওয়া দরকার।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, মহান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ চেষ্টায় এবং বাংলাদেশের আগ্রহে ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুল ইসলামের জন্মদিনকে সামনে রেখে সপরিবারে তাকে ‘রাষ্ট্রীয় অতিথি’র মর্যাদায় স্থায়ীভাবে ও জাতীয় কবির অভিধা দিয়ে ঢাকায় আনা হয়। তেজগাঁও বিমানবন্দরে সেদিন বিপুল সংবর্ধনায় কবিকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং ২১ ফ্রেব্রুয়ারি নজরুলের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের প্রীতি, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার স্বীকৃতি হিসেবে সরকার নজরুলকে সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একই বছরের ২৪ মে কবির জন্মদিনে তাকে তদানীন্তন সামরিক সরকারের পক্ষ থেকে আর্মি ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয় এবং চল্ চল্ চল্ গানটিকে বাংলাদেশের রণসঙ্গীত ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সে সময় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কবির হাতে ক্রেস্ট তুলে দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর যখন দেশে সংস্কৃতির আগ্রসন শুরু হয় তখন মাটি ও মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং বাংলাদেশের সংস্কৃতির অভিভাবকত্ব করার জন্যই মূলত তিনি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। নানারকম চক্রান্ত আর অবহেলা, অসহযোগিতার কারণে ১৯৪২ সালে নির্বাক ও কবি তার ৩৪ বছরের অসুস্থ জীবনে কখনোই মাটি, মানুষ ও মানবতার জয়গান গাইতে ভুল করেননি। অনাদর অবহেলায় বেড়ে ওঠা কবিকে শেষমেষ আমরাও রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দিয়ে তার প্রতি অকৃতজ্ঞতার মাত্রাকে দীর্ঘায়িত করেছি। শুধুমাত্র কাগজে-কলমে নজরুল ইসালমকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তাকে জাতীয় কবি হিসেবে উল্লেখ করার পরেও তাকে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় কবির মর্যাদা ও স্বীকৃতি না দেয়ার মানসিকতা নিংসন্দেহে অশুভ লক্ষণ। দেশের কোটি মানুষের প্রাণের কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য তার ভক্ত-অনুরক্তদের এককণ্ঠ হওয়া আবশ্যক। রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে কাজী নজরুলকে দেয়া জাতীয় কবির সেই ঘোষণা মানুষের হৃদয় মন্দিরে স্থান করে নিলেও আমাদের সংবিধানে সেটা স্থান না পাওয়া দুঃখজনক। রাষ্ট্রীয় গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে তাকে অদ্যাবধি জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেয়া শুধু বড় রকমের একটি ‘জাতীয় ভুল’ই নয় বরং জাতীয় কবি নজরুলের জন্যও এটা অবমাননাকর বলে অনেকেই মনে করেন।

১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর অবিভক্ত ভারতে কলকাতা এলবার্ট হলে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু, বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এস ওয়াজেদ আলী, দীনেশ দাসসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে যে কবিকে সমগ্র বাঙালির পক্ষ থেকে জাতীয় কাণ্ডারি ও জাতীয় কবির স্বীকৃতি দেয়া হয় সে কবিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুত জাতীয় কবির সাংবিধানিক স্বীকৃতি না দেয়াটা সত্যিকারেই রহস্যেভরা দুঃখের প্রাচীরসম।