ঢালাও মামলা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে

প্রকাশ : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশজুড়ে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়ে গেছে। অধিকাংশই হত্যা মামলা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত স্বৈরাচারের পুলিশ এবং দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলিতে প্রায় হাজারখানেক মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে কয়েক হাজার। এসব হতাহতের ঘটনায় মামলা হচ্ছে। মামলা করছে প্রধানত ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্য ও পুলিশ। এরইমধ্যে দায়ের করা বেশিরভাগ মামলায় দেখা গেছে, আসামি করা হয়েছে পতিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও অজ্ঞাত পরিচয়ের ব্যক্তিদের। হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ বা অভিযোগ থাকা আবশ্যক। অথচ, মামলাগুলোর বেশিরভাগ আসামিকে হুকুমের আসামি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মামলায় এমন আসামির নামও আছে যে ঘটনার সময় উপস্থিতই ছিল না। আবার ব্যবসায়ী, ব্যক্তিগত শত্রুদেরও আসামি করা হয়েছে। আইনবিদদের মতে, এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ এবং ভুয়া বা মিথ্যা মামলা টিকবে না। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হবে। প্রকৃত দোষী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিবর্গের নামে মামলা হতে হবে যথাযথ প্রতিকারের জন্য। এর বাইরে বিশেষ মতলবে অন্যদের আসামি করা হলে, সেটা হবে অন্যায়। এক্ষেত্রে ন্যায়বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। পতিত সরকারের আমলে ভুয়া মামলা, গায়েবি মামলা উদ্দেশ্যমূলক মামলা দায়েরের সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্য এই নজিরবিহীন সংস্কৃতির চর্চা বিস্তার লাভ করেছিল। এসব মামলায় মৃত ব্যক্তি, বিদেশে থাকা ব্যক্তি, চলৎশক্তিরহিত ব্যক্তি, হাসপাতালে থাকা রোগী ইত্যাদিকেও আসামি করা হয়েছিল। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে অসম্ভবপর ও হাস্যকর অভিযোগেও মামলা করা হয়েছিল। কোনো কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুই-চারটি নয়, অসংখ্য মামলা দায়ের করা হয়েছিল। মামলাগুলোর বাদী ছিল পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিপ্লবোত্তর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও যদি পতিত সরকারের সময়ের মতো ঢালাও মামলা ও ঢালাও আসামি করার অপসংস্কৃতি চলতে থাকে, তাহলে দুঃখিত ও বিচলিত না হয়ে পারা যায় না। আশঙ্কার বিষয়, এক্ষেত্রে সুবিচার পাওয়া যেমন বিলম্বিত হতে পারে, তেমনি নির্দোষ মানুষ অহেতুক হয়রানির শিকার হতে পারে। একটি হত্যা মামলায় যখন এজহারভুক্ত আসামিসহ বহুসংখ্যক অজ্ঞাত পরিচয়ের আসামি থাকে, তখন তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত কর্মে অনেক সময় ব্যয় হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। এজন্য বিচার প্রক্রিয়াও দীর্ঘ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তখন ‘বিচারে বিলম্ব বিচার না হওয়ার শামিল’ প্রবাদটিই সত্য বলে প্রতিভাত হবে।

দেখা যাচ্ছে, মামলা দায়েরের অপসংস্কৃতি যেমন দূর হয়ে যায়নি, তেমনি আদালতকেন্দ্রিক পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়নি। বলা হয়, আদালত নিরাপদ স্থান। কোনো আসামি, যত বড় অপরাধীই হোক। আদালত চত্বরে প্রবেশ করলে সে নিরপরাদ। পতিত স্বৈরাচারের শাসনামলে আদালতে আসামিসহ কারো নিরাপত্তাই নিশ্চিত ছিল না। আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান, সাংবাদিক-আইনজীবী মইনুল হোসেনসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির আদালত প্রাঙ্গণে হেনস্তা হওয়ার নজির রয়েছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেরকম ঘটনার অবতারণা হবে কেন? পতিত স্বৈরাচারের মন্ত্রী, উপদেষ্টা প্রমুখকে আদালত প্রাঙ্গণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এক শ্রেণির আইনজীবী ও রাজনৈতিক কর্মী এজন্য দায়ী বলে অভিযোগ রয়েছে। আদালত ও আদালত প্রাঙ্গণে সবার নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। সরকার এদিকে নজর দেবে বলে আমরা আশা করি। বিগত সরকারের আমলে রিমান্ড অতি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। তুচ্ছাতি তুচ্ছ কিংবা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগেও রিমান্ডে নেয়া ছিল রীতিমতো দস্তুর। সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীদের জব্দ করার জন্য রিমান্ড ছিল মোক্ষম হাতিয়ার। রিমান্ডের যে বিধান এবং উচ্চ আদালতের নির্দেশে, তার কোনো কিছুই মানা হতো না। এখনো রিমান্ডের অপব্যবহার হবে, সেটা প্রত্যাশিত নয়। এ ব্যাপারে বিচারকদের সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়। এরইমধ্যে কোনো কোনো রিমান্ড নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযুক্ত যে-ই হোক, তার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার আছে। অভিযুক্ত নিজেও আদালতে তার বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারে। আবার তার পক্ষে আইনজীবীও তা করতে পারে। আমাদের দেশে আইনজীবীই সাধারণত অভিযুক্তের পক্ষ আদালতে বক্তব্য রাখে। দু’য়েকটি ঘটনায় এমন দেখা গেছে, আসামির পক্ষে বক্তব্য রাখতে আইনজীবীকে বাধা দেয়া হয়েছে। এটা মোটেই ন্যায়বিচারের সহায়ক নয়।

ঢালাও মামলা, ঢালাওভাবে তাতে আসামি করা, আদালতে নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদি দুঃখজনক। এটা ন্যায়বিচার পাওয়ার অনুকূল পরিবেশের সাক্ষ্য বহন করে না। স্বৈরাচারের আমলে যে পুলিশ মামলা দায়ের করতো, এখনো সেই পুলিশই মামলা দায়ের করছে। পুলিশের রদবদল হতে পারে; কিন্তু তাদের স্বভাব ও অভ্যস্থতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে ঢালাও মামলা, ঢালাও আসামি হচ্ছে। অন্যদিকে তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা মামলা দায়ের করতো, এখন অন্যদলের প্ররোচনায় মামলা হচ্ছে। ওদিকে একশ্রেণির আইনজীবী তখন যা করত এখন অন্যশ্রেণির আইনজীবীও সেটাই করছে। স্বৈরাচারী সরকার ও বিপ্লবী সরকার এক হতে পারে না। এই দুই সরকারের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেই পার্থক্য বিচারাঙ্গনসহ সব ক্ষেত্রেই দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠতে হবে। সন্দেহ নেই অন্তর্বর্তী সরকারকে নানামুখী সংকট ও সমস্যার মধ্যদিয়ে যেতে হচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার ও তার সহায়ক শক্তি ভারত নিরন্তর চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। সরকারকে তা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জার্মানভিত্তিক মিরর এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত ত্রৈমাসিক একটি পরিকল্পনা নিয়েছে। ইউনূস সরকারকে বেকায়দায় ফেলা ও অজনপ্রিয় করা এই পরিকল্পনার লক্ষ্য। আগামীতে অন্তর্বর্তী সরকারকে পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের বিবিধ ষড়যন্ত্র ও পরিকল্পনা মোকাবিলা করতে হবে, এটা তার স্পষ্ট ইঙ্গিত বহন করে। সেইসঙ্গে অর্পিত দায়িত্বও পালন করতে হবে। সরকারের দায়িত্বের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা যে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, তার বিচার নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। আমরা আশা করবো, এ দায়িত্ব পালনে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।